ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ‘মোহাম্মদ মনিরুজ্জমান স্মারক বক্তৃতা’ দিতে ডেকেছেন। আমি পরে জেনেছি এই বক্তৃতা এ-বছরই শুরু হচ্ছে ও সেই বার্ষিক বক্তৃতার প্রথম বক্তা হিসেবেই তাঁরা আমাকে ডেকেছেন।
আমি জানি এই ধরণের নির্বাচেনের পেছনে এই বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচকদের একটা বিশেষ প্রত্যাশা কাজ করে। নানা কথা ভেবেচিন্তেই কিছু কিছু মত বিরোধিতা উৎরে তারা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছন। তার ওপর এম কোনো বক্তৃতাসূচি শুরু করার সময় নির্বাচকদের প্রত্যাশায় অনেক টাটকা মতপার্থক্যও থাকতে পারে, তীব্র মতৈক্যও গড়ে উঠে থাকতে পারে কোনো এক অনির্দিষ্ট ভরসা থেকে।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক নিমন্ত্রণ কিছু না ভেবেই গ্রহণ করে ফেলেছি, যেহেতু বাংলাদেশ সম্পর্কিত যে-কোনো বিষয়েই আমার উৎসাহ আত্যন্তিক। পরে যখন জানলাম এটাই হবে প্রথম ‘মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান স্মারকবক্তৃতা’, তখনই ভেবেছি এমন তৎপর রাজি হওয়াটা ঠিক হয়নি বোধ হয়। সেই বক্তৃতার প্রস্তুতির জন্য মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের নিজের কিছু লেখা পড়তে পড়তে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, পালানো ছাড়া আমার বাঁচার পথ নেই অথচ পালানোর কোন পথ আমার সামনে-পেছনে-পাশে চাক্ষুষ হচ্ছে না। শুরুতেই আমি সেই গল্পটা বলতে চাই মোহাম্মদ মনিরুজ্জমানই আমাকে বক্তৃতার এই বিষয়টিতে কী করে পৌঁছে দিলেন।
না, তাঁর লেখালেখি বা গবেষণা থেকে আমি আমার বিষয়ের কোনো সংকেত পাইনি, যদিও সেই লেখাগুলিতে যে তথ্যনিষ্ঠা ও সিদ্ধান্তের ফলপ্রসূ সম্ভাবনার প্রমাণ আছে তাতে তাঁকে সাহিত্যের একজন এমন আদর্শ গবেষক বলে সহজেই মনে হবে যে-আদর্শ গবেষক সাহিত্যে সব দেশেই দুর্লভ। গবেষণার সেই আদর্শ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বড়ই প্রয়োজন ছিল সেই উদ্যম। বাংলাদেশের। বড়ই প্রয়োজন ছিল গবেষকের সেই নিস্পৃহতা। তার গবেষণা ছিল একটা দর্শনের অন্তর্গত। তাই তো বাংলা সাহিত্যের কোনো একটি বিষয়কে বা পর্বকে তার গবেষণার বিষয় হিশেবে নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন এমন চিহ্নিত করা যায় না।
তার কবিতাগুলি সময় চিহ্নিত। কবিতার যেগুলি প্রাথমিক শর্ত- ছন্দ, উপমাদি, অলংকার, চিত্রকল্প ও টি.এস.এলিয়ট যাকে বলেছিলেন ইউনিভার্সালাইজেশন, সে সব গুণ আয়ত্ত করার প্রমাণ তাঁর কবিতায় স্পষ্ট। কিন্তু কবিতা তো প্রথমত একটা সময়স্রোতের ওপর দিয়ে কথা বলা। তাতে এমন কিছু ইঙ্গিত থাকে, এমন কিছু কিছু ঘুরিয়ে বলা থাকে, যেগুলো ওই সময়স্রোতের অব্যবহিত পাঠকের কাছেই কেবল নিশ্চয়তা নিয়ে পৌঁছয়। বহু সময় বয়ে গেলে সেই অব্যবহিতের প্রয়োজন আর থাকে না। মোহাম্মদ মনিরুজ্জমানের কবিতাগুলির ওপর দিয়ে ততটা সময় এখনও বয়ে যায়নি, যা আমার মত দূরবর্তী বিদেশী পাঠককে তার সন্ধাভাষা বুঝিয়ে দেয়। কবিতা তো সন্ধাভাষাতেই লেখা হয়। তাঁর কবিতাগুলি, যা পড়েছি, আমাকে আবিষ্ট করেছে কিন্তু সে আবেশ থেকেও এমন কোনো ভূমি আমার পক্ষে তৈরি করে তোলা সম্ভব হয়নি যার বেধ আছে, ব্যাস আছে, তলদেশে আছে। সেই বেধ-ব্যাস-তল আমি আবিষ্কার করতে পারিনি একমাত্র এই কারণে যে, কবিতা সব সময়ই দুর্গম ও দুরূহ।
তাঁর লেখা গান ছাপার হরফে পড়েছি- সুরহীন। কিন্তু তাঁর গান নিয়ে কিছু অনুভবের কথা তাঁর আত্মজীবনী ‘স্মৃতি যে অচঞ্চলা’-তে তিনি বলেছেন। তিনি খুব বিশদে বলেননি, খুব স্পষ্ট করেও বলেননি, শুধু উল্লেখ করেছেন গীতিকার হিশেবে তাঁর নাম ও তাঁর মুখ পাক-বাহিনীর হাত থেকে তাঁর আত্মরক্ষাকে কেমন কঠিন করে তুলেছিল।
আমি তো সারাজীবন শুধু গল্প-উপন্যাসই বানিয়েছি। গল্প-উপন্যাস বানানোর এই এক মজা যে বাস্তবের একটা ছুতো ধরে অবাস্তবের, বা, বলা ভাল, অপ্রমাণিতের একটা জগৎ বানিয়ে তুলে তাকে বাস্তবের চাইতেও বাস্তবতর প্রমাণ করা।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জমানের ঢাকায় আত্মগোপনের ঘটনা পড়তে-পড়তে আমার মনে হয়েছিল- তাঁকে তাঁর নিজেরই কাছ থেকে লুকোতে হচ্ছে। যেহেতু তাঁর মুখ বহুদৃষ্ট, যেহেতু তাঁর গান বহুগীত ও যেহেতু তাঁর নাম বহুশ্রুত তাই তাঁর আত্মগোপন এত কঠিন। এটাই, এই সংকটটাই তো হতে পারে এখনকার উপন্যাস, সেই অলিখিত উপন্যাসের নায়কের জীবনযাপন করে মোহাম্মদ মনিরুজ্জমান আমার আত্মার সহোদর হয়ে উঠলেন। জ্বরো ছেলের জ্বর দেখার উপায় নেই কারণ তাহলে আলো জ্বালতে হবে। বাইরে পাকফৌজের পায়ের আওয়াজ। সকালের প্রাকৃতিক আলো, সূর্যের, যেন ঘরের জানলার চিলতে ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকতে না পারে, সেজন্য কাপড় গুঁজে সেসব ফাঁক বন্ধ করতে হয়। এমনই এক আত্মগোপনে তাঁর ছেলে হঠাৎ পোষা টিয়েপাখির জন্য কান্না জোড়ে। আর মনিরুজ্জমান সেই মরণ-শহরের রাস্তা বেয়ে চলেন অলিগলিপথ বেয়ে তাঁদের পুরনো বাড়িতে ছেলের টিয়েপাখিকে বাঁচাতে। এ তো এক মহৎ উপন্যাসের ঘটনা। পাকফৌজ তাঁকেও খুঁজছে ও তাঁকে পেলেই হত্যা করবে। আর তিনি চলেছেন ছেলের পোষা টিয়ার প্রাণ বাঁচাতে। পাকফৌজ সর্ব শক্তি দিয়ে তাঁদের পরাভূত করতে চাইছে আর মনিরুজ্জমান সর্বশক্তি নিয়ে দুটি পাখির প্রানকে রক্ষা করতে ও তাদের স্বাধীনতা দিতে চলেছেন।
তারপর ঢাকা থেকে বেরোনোর অভিযান। তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ঢাকাতেই থাকবে এমনই ঠিক ছিল। কিন্তু যাত্রার সময় দেখা গেল তাঁর স্ত্রী রশিদা, তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেই নিরুদ্দেশযাত্রার সঙ্গী হলেন। সেই নীরবতা এক মহাকাব্যিক নৈঃশব্দ্য। ডেমরা ঘাটের পথে ছেলেকে কোলে বসিয়ে ছেলের আড়ালে নিজের মুখ গোপন করতে হয়। ডেমরা ঘাটে তখনো ব্রাশ ফায়ারের শবদেহগুলি ভাসছে। অত মৃত্যু যেন কিছুক্ষণের জন্য জায়গাটিতে ফৌজি পুনরাক্রমণ থেকে রক্ষা করছিল। রসুল্লাবাদের দিকে সেই যাত্রা, নদী পথে, আর এক-এপিক যাত্রা। রসুল্লাবাদে পরিবারের দুই কিশোরের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে চলে যাওয়া আর গাছতলায় দাঁড়িয়ে রশিদার লোক ধরে-ধরে জিজ্ঞাসা- তারা কি রোগা, লম্বা কোনো ছেলের মৃতদেহ দেখেছে? বাংলাদেশে মৃতদেহই তখন সবচেয়ে সহজ দৃশ্য। ‘মহাভারত’-এ কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের পর মেয়েদের স্বামীপুত্র সন্ধান এক চিরন্তন বিবরণ। বাংলাদেশ তখন সেই ‘মহাভারত’-এর জীবনযাপন করছিল প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্ত।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জমান আমাাকে আমার বিষয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যে এপিক জীবন বাংলাদেশ যাপন করেছে ও করছে এখনো, সেই এপিকের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার পক্ষে অন্য কোন বিষয় কল্পনা করাও সম্ভব হল না।
আমাকে বলতে হবে উপন্যাসের দায়, দায়িত্ব বা বাধ্যতা নিয়ে। যে-উপন্যাস পাশ্চাত্য শিল্পতত্ত্বের দ্বারা শাসিত নয়। যে জীবন মনিরুজ্জমান ও তাঁর মত কত সহস্র মানুষ যাপন করে ফিরে এসেছেন। নতুন বাংলাদেশ রচনার কাজে -সেই দুই টিয়াপাখিকে মুক্তি দেয়ার কাজের মত- সেই সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতিতেই আজ আমি ‘উপন্যাসের সংকট’ নিয়ে বলব ও সেই ভাষণের নেপথ্যে সব সময়ই থাকবে মনিরুজ্জমানের উপস্থিতি।
উপন্যাস কাকে বলে ও কোন বিশেষ ধরনের সমাজে উপন্যাস তৈরি হতে পারে— এই দুটি প্রশ্ন নিয়ে একটা সর্বসম্মত ভুল সিদ্ধান্ত সাহিত্যের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এমন সর্বসম্মতি ও অন্তর্ভুক্তির কারণ একটাই— প্রশ্নদুটি প্রশ্ন বিশেষে যতটা গ্রাহ্য, এর উত্তরটা ততই অমীমাংসিত হতে বাধ্য। যে-প্রশ্নের কোনো একটিমাত্র উত্তর হয় না, হওয়া সম্ভব নয়, সেই প্রশ্নের যে-কোনো একটা উত্তরে একমত হয়ে যাওয়াটা হাতের নাগালের কাজ চালানোর পক্ষে নেহাৎ দরকারি। মানুষের সামাজিক বিকাশ ও অর্থনৈতিক জীবনের পক্ষে সাম্রাজ্যবাদী বা আধিপত্যশীল প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির পর্ব, যাকে আমরা সাম্রাজ্যবাদী বা ঔপনিবেশিক পর্বই বলতে পারি, মাত্র দু-তিনশ বছরের পুরনো, আর-একটু বাড়িয়ে না হয় চার-পাঁচশ বছরই ভাবা যায় বড় জোর, তার বেশি তো নয়। অথচ যেহেতু সেই পর্বে পৃথিবীর সব দেশ পরস্পরের কাছাকাছি হয়েছে অনেক বেশি, তাই শিল্পসাহিত্যগত প্রশ্নের ওপরও এই আধিপত্যবাদী চিন্তার জবরদখল চালুই থেকে যায়, এ নিয়ে প্রতিবাদ বড় একটা হয় না।
গল্প-উপন্যাস কাকে বলে ও কোন বিশেষ ধরনের সমাজে উপন্যাস তৈরি হতে পারে— এমন প্রশ্নের উত্তরে যে সর্বসম্মতি আমাদের অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার কারণটা একটু বিদ্ঘুটে। এই প্রশ্নের উত্তরে ধনতন্ত্রে বিশ্বাসী সাহিত্যতত্ত্ববিদরা ও মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী সাহিত্যতত্ত্ববিদরা একমত হয়ে গেছেন অনেক দিন, প্রায় মার্ক্স-এর সময় থেকেই। সেই মতৈক্যটা হচ্ছে এই— উপন্যাস তৈরি হয় সেই সমাজে, যে-সমাজে ব্যক্তি প্রধান হয়ে ওঠে। একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের কাহিনীই উপন্যাস। সেই বিকাশোন্মুখ ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষার বিষয় হতে পারে বেশ বড়সড় এক জমিদারির মালিক হওয়া, সেই কারণে সে তেমন জমিদারির জন্য অপরিহার্য ক্রীতদাস সংগ্রহ করলে করতে পারে। কিন্তু তার ক্যাশের জোর না থাকায় সে ঘুরে-ঘুরে বড়-বড় জমিদারদের কাছ থেকে তাদের মরা-ক্রীতদাসদের নামগুলো কিনে বেড়ায়। তাতে অনেক জমিদার নামগুলো দেয় বটে কিন্তু দাম নিতে তাদের ইজ্জতে লাগে। এই লোকটির শস্তায় জমিদার হওয়ার ব্যক্তিগত বাসনা প্রায় যেন পূর্ণ হয়। গোগোল-এর ‘ডেডসোলস’ বা, একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের অনুকূল সেই সমাজে কোনো একটি মেয়ে বার বছর বেশ্যাবৃত্তি করতে পারে, পাঁচবার বিয়ে করতে পারে— একবার নিজের ভাইকে, বারো বছর ধরে চুরি করে যেতে পারে, চৌর্যবৃত্তিই তার পেশা, আট বছর অপরাধী হিসেবে নির্বাসনদণ্ড ভোগ করতে পারে, শেষে বড়লোক হতে পারে, ভালো মানুষ হতে পারে ও মৃত্যুর আগে অনুতপ্তও হতে পারে। ডেনিয়েল ডিফো-র ‘মল ফ্লান্ডার্স’ (১৭২২)। বা, তেমন ব্যক্তিত্ব নির্মাণক্ষম কোনো সমাজে এক বড় অমাত্যের বৌ ট্রেনে দেখা হয়ে-যাওয়া এক ছোকরার প্রেমে এমন পড়ে যেতে পারে যে ঘর-সংসার ছেড়ে তাকে বিয়ে করে তার ছেলের মাও হতে পারে ও শেষে এক ট্রেনের চাকার তলায় ঝাঁপ দিতে পারে। তলস্তয়-এর আনা কারেনিনা। কিংবা আর-একটি মেয়ে, কাপালিকের তন্ত্রসীমার সঙ্গিনীদশার বন্দিত্ব থেকে এক আচমকা দেখা পুরুষেরর সঙ্গে জনপদে আসে বটে কিন্তু সেই পুরুষটির সব প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে গঙ্গায় ভেসে যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’। বা, এক ভাগ্যান্বেষী মানুষ কোত্থেকে একটা গাধার চামড়া পেয়ে যায় এই শর্তে যে তার সব উচ্চাকাঙ্ক্ষাই মিটবে বটে কিন্তু চামড়াটা ছোট হতে-হতে সে শেষ পর্যন্ত মরে যাবে। বালজাক-এর ‘মরা গাধার চামড়া’ বা, সিপাহি বিদ্রোহের সময় এক পথে পড়ে থাকা শিশু গোঁড়া বামুন হয়ে বড় হয়ে ওঠে ও জীবনের এক সংকটে নিজের সেই আদি পরিচয়ের মুখোমুখি হয়ে যায়, সে তো ভারতীয়ই নয়, বামুন তো দূরের কথা। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’। বা, সুইজারল্যান্ডের এক স্যানাটোরিয়ামে যক্ষ্মারোগাক্রান্ত কিছু মানুষ শুধু তর্ক করে যায় ঘনায়মান ফ্যাসিবাদ নিয়ে। কথা, কথা আর কথা ব্যক্তিগুলোকে ছেয়ে ফেলে। টমাস মান-এর ‘ম্যাজিক মাউন্টেন’। বা, মৃগীরোগের চিকিৎসায় নিজের যৌবনকালের অনেকটা ইয়োরোপে কাটিয়ে রাশিয়ার ফিরে-আসা এক কপর্দকহীন ছোকরা, যে নাকি একই সঙ্গে একজন প্রিন্সও বটে ও একজন ইডিয়টও বটে হয়ে ওঠে এক প্রগাঢ় দার্শনিক, তার পায়ের তলায় পড়ে থাকে টাকা আর সম্পদ আর নারী। দস্তয়েভ্স্কির ‘ইডিয়ট’। বা, আফ্রিকা থেকে জাহাজের খোলে ভরে যাদের নিয়ে আসা হয়েছিল উত্তর আমেরিকায় শিল্পশ্রমিক হিসেবে তাদেরই বংশধর এখন এই বিশ-একুশ শতকে প্রশ্ন তুলছে তার দেশপরিচয় ও বংশ পরিচয় নিয়ে। টনি মরিসন-এর ‘বিলাভেড’। অসউইৎস-এ যে বন্দী ছিল তখন এক লেখক বেঁচে ফের প্রশ্ন তুলছে— সে কি জীবনে ফিরল। কার্টেজ-এর ‘রিকুইম ফর অ্যান আনবোর্ন চাইল্ড’। বাংলা পশ্চিম আর পুবে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর এক ব্যক্তি তার পশ্চিম থেকে পুবে চলে যাওয়ার পথ বাইছে। পথের দুটি স্তর। স্বচ্ছ বরফের ওপর দিয়ে দেখা যায় তলার কাল পথ। শুধু পথবাহন। একই পদ-থেকে দুটো পথ। মাহমুদুল হক-এর ‘কালো বরফ’। এক বুড়ো মাঝি ফিরছে সমুদ্রে তার ডিঙিতে হাঙরের সঙ্গে যুদ্ধ সেরে। হাঙর, রক্ত, মৃত্যু ও মুক্তি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দি সি’।
এই সবই কি ব্যক্তির গল্প? ব্যক্তির আত্মসন্ধানের বা আত্মধ্বংসের? সব উপন্যাসের গল্পই কি ব্যক্তির উত্থানের সোপান বা ব্যক্তির ধ্বংসের এক ধ্বস্ত প্রাকার? সেই কথাই কি বলছেন পাশ্চত্যে বুর্জোয়া উত্থানের মহত্তম দার্শনিক হেগেল ও হেগেল থেকে মার্ক্সবাদে উত্তীর্ণ গেয়র্গ লুকাচ?
দুই
উপন্যাসের এই লিস্টটাতে যেন একটু তাৎক্ষণিকতা আছে, লিখতে লিখতে যেমন মনে আসছে উপন্যাসগুলোর উল্লেখ করে যাচ্ছি। কথাটা অর্ধেক ঠিক। আমি কোনো লিস্ট তৈরি করে নিজেকে বাঁধতে চাই নি। তেমনি আবার একটা বিশৃঙ্খল লিস্টি তৈরি করে নিজেকে সেই লিস্টিতেও বাঁধতে চাই নি এই সূত্রটা পরীক্ষা করতে যে সমাজে ব্যক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কার্যকারণে ও নভেল সেই কার্যকারণের শিল্পরূপ। মানুষের জীবনযাপনের উপাদানগুলিই তার ভাবজীবনের ভিত্তি— এই সত্যটি এতই জটিল যে সত্যটিকে বুঝে নেয়ার বা তথ্যগুলিকে সত্যের অনুকূলে সাজানোর তড়িঘড়ি দরকারে মানুষের ভাবজীবন ও জীবনযাপনের ভিতরকার পারস্পরিক নির্ভরতাকে একটা চৌকো খোপের ওপর আর-একট চৌকো খোপ বসিয়ে দেয়ার মত ছেলেমানুষি খেলা, বা একটা ত্রিভুজাকৃতি তৈরি করার মত জ্যামিতিক খেলায়, মেতে ওঠাটাকেই একটা তত্ত্বজিজ্ঞাসা মনে করা হয়।
এই লিস্টটাতে ১৭২২ সালে লেখা ‘মল ফ্লান্ডার্স’ আছে। তখন উপন্যাস সবে মাত্র তৈরি হচ্ছে। যাঁরা এটা লিখছেন তারাও জানেন না যে একটা নতুন শিল্পরূপের জন্ম দিচ্ছেন তারা। মল ফ্ল্যান্ডার্স সত্যিকারের অনেকগুলি মেয়ের একটি ঔপন্যাসিক চরিত্র, বানানো ও বানানো নয়। সে ব্রিটেন ও তার নতুন কলোনিগুলির ভিতর একটি সেতু বা সম্বন্ধ হয়ে উঠেছে। সে নিশ্চয়ই ব্রিটেনের তখনকার অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগে নিজেকে পকেটমার, চোর ও বেশ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল ও তার মত মানুষজনের জীবযাপন ব্রিটেনের নতুন সামাজিক জীবনের পক্ষে কলঙ্ক হয়ে উঠতে পারে ভেবেই তাকে ব্রিটেনের নতুন কলোনি আমেরিকাতে নির্বাসনে পাঠানো হল। কলোনির অপরাধ-প্রধান মুক্ত পরিবেশে মল ফ্ল্যান্ডার্স বেশ প্রতিষ্ঠিত হতে পারল। শেষ পর্যন্ত সে এতটাই ভদ্রলোক হয়ে উঠল যে খ্রিস্টধর্মের রীতি অনুযায়ী অনুতাপ পর্যন্ত করে ফেলল। মল ফ্ল্যান্ডার্স-এর ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়ে উঠল কি সেই তখনই, যখন সে তার একান্ত ব্যক্তিত্বশীল পেশা ও পেশান্তরের জোরে আহৃত কিছুটা টাকাপয়সা ও কিছুটা আইন মোতাবেক শাস্তিসহ পুরনো স্বীকৃত খ্রিস্টান ভদ্রলোক সমাজের যোগ্য হয়ে উঠল?
গোগোলের ‘ডেড সোল্স’-এর চিচিকভ, বালজাকের ‘গাধার চামড়ার’ নায়ক, বাংলার ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর ঠকচাচা কিন্তু একই রকম মানুষ। এই তিনজন, মল ফ্ল্যান্ডার্সসহ নভেলের অনিবার্য চরিত্র হয়ে উঠেছে। এরা কেউই নিশ্চয়ই নতুন শিল্পরূপ নভেলের সেই প্রতিনিধি-পুরুষ বা নায়ক নয়, এবং এরা তো সামাজিকভাবে পরিত্যক্ত।
তেমনি এর বিপরীতে এই লিস্টে শিল্পরূপ হিসেবে নভেলের কিছু প্রবল চরিত্রের উল্লেখও আছে। দস্তয়েভ্স্কি-র প্রিন্স, তলস্তয়-এর আনা কারেনিনা, রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের প্রবল ব্যক্তি। এমন চরিত্রগুলিই নভেলকে করে তুলেছে ব্যক্তির জীবনী, জীবনের মূল্যেও ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠার কাহিনী।
উপন্যাস সম্পর্কে ইয়োরোপেই সবচেয়ে বেশি তত্ত্ব তৈরি হয়েছে, সে-সব কোনো তত্ত্বচিন্তাকেই এমন কী উত্তর আমেরিকার উপন্যাসগুলিকেও তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় না, কখনো-সখনো ব্যতিক্রম হিসেবে ফকনারকে বুুড়িছোঁয়া করে রাখা হয় মাত্র। উত্তর আমেরিকারই যদি এই হাল, তাহলে বিরাট পৃথিবীর বাকি সব মহাদেশের অন্তর্গত অজস্র দেশের অজস্র ভাষায় যে-লক্ষ লক্ষ উপন্যাস লেখা হয়েছে ও হচ্ছে সে-সব উপন্যাস ইয়োরোপীয় নভেলতত্ত্বের আওতার মধ্যে, আসেই না। অথচ পৃথিবীর উপন্যাস-সাহিত্যবিচারের একমাত্র নিরিখ ইয়োরোপীয় নভেলতত্ত্ব। সে-নভেলতত্ত্বে আবার বুর্জোয়া বিকাশের তত্ত্ববিদ আর মার্ক্সবাদী তত্ত্ববিদরা একমত।
কিন্তু একই সঙ্গে আছে টনি মরিসন, কার্টেজার, মাহমুদুল হকের উপন্যাসের চরিত্রগুলির কথা। সে চরিত্রগুলি একেবারেই একা একা এমন জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে, যে-জীবন একান্তভাবে তারই জীবন। সে-জীবনের কোনো শরিক হয় না। পশ্চিমবঙ্গের একজন মুসলমান, আফ্রিকার এক নারী ও হিটলায়ের বৃহত্তর জার্মানির এক কিশোরের পক্ষেই মাত্র সে-জীবনগুলি সত্য হতে পারে। মরিসন, মাহমুদুল হক ও কার্টেজার যখন উপন্যাস লিখছেন তখন তাঁরা সেই চরিত্রগুলির ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাচ্ছেন না। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের সমানুভূতি তৈরি করে সহৃদয়হৃদয়সংবেদী হওয়া ঐ উপন্যাসগুলির ঔপন্যাসিক প্রকল্পই নয়। এই পরিস্থিতি এখন উপন্যাস-সম্পর্কিত তত্ত্বচিন্তার অনিবার্য বিষয় হয়ে ওটা প্রয়োজন। ধনতন্ত্র যে সাম্রাজ্যতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের আকার নিল, ও ক্ষমতাবিস্তারের জন্য এমন সব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্রায়ত্ত করে ফেলল, ও কোনো এক স্তর পর্যন্ত সেই পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াকে গণতন্ত্রেরও সমার্থক করে তুলল, সাম্রাজ্যবিস্তারের সেই দু-তিনশ বছরের ইতিহাসে উপনিবেশের মানুষজনকে অধস্তন স্তরের জীব হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই কয়েক বছর আগেও দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের কোনো মানবিক অধিকার ছিল না, নাগরিক অধিকার তো দূরস্থান। ঢাকার তাঁতিদের বুড়ো আঙুল কেটে দেয়া বা পশ্চিম আফ্রিকার দাসদের হাতের তেলো ফুটো করে জাহাজের খোলে ভরে আমেরিকার শিল্পশ্রমিক করে নিয়ে আসা অমানবিকতায় নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চাইতে কম কোনো অপরাধ নয়।
টনি মরিসন যখন অ্যাফ্রো-আমেরিকান অতীত নিয়ে বা কার্টেজার যখন অস্উইথস্-এর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নিয়ে বা বাংলাদেশের অনেক ঔপন্যাসিক যখন পাকিস্তান-সেনাবাহিনীর ন-মাসের বর্বরতা নিয়ে উপন্যাস লেখেন, তখন সেগুলি ব্যক্তির কাহিনী হয় না, ব্যক্তির বিকাশের বা ধ্বংসের কাহিনী থাকে না, তখন সেগুলি হয়ে ওঠে ব্যক্তিত্ববিনাশী এক সিস্টেমের সশস্ত্র আক্রমণের কাহিনী। ও সিস্টেমের বিজয়গাথা।
তখন ধনতন্ত্র ও উপন্যাসের বিকাশ নিয়ে বুর্জোয়া তাত্ত্বিক ও মার্ক্সবাদীদের এমন অনুমান আর মেনে নেয়া যায় না যে These hypotheses concern, on the one hand, the homology between the structure of the classical novel and the structure of exchange in the liberal economy, and on the other hand certain parallels in their later evolutions.
তিন
গেয়র্গ লুকাচ, লুসিয়েঁ গোল্ডমান, এঁরা, খুবই শ্রদ্ধেয় মার্ক্সবাদী তত্ত্ববিদ— তাঁরা উপন্যাসের সমাজতত্ত্ব ও শিল্পতত্ত্ব নিয়ে আমাদের ধ্যানধারণার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁদের উপন্যাস সংক্রান্ত সমস্ত তাত্ত্বিক ধারণাই তৈরি হয়েছে ইয়োরোপীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। উপন্যাস সম্পর্কে ইয়োরোপেই সবচেয়ে বেশি তত্ত্ব তৈরি হয়েছে, সে-সব কোনো তত্ত্বচিন্তাকেই এমন কী উত্তর আমেরিকার উপন্যাসগুলিকেও তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় না, কখনো-সখনো ব্যতিক্রম হিসেবে ফকনারকে বুুড়িছোঁয়া করে রাখা হয় মাত্র। উত্তর আমেরিকারই যদি এই হাল, তাহলে বিরাট পৃথিবীর বাকি সব মহাদেশের অন্তর্গত অজস্র দেশের অজস্র ভাষায় যে-লক্ষ লক্ষ উপন্যাস লেখা হয়েছে ও হচ্ছে সে-সব উপন্যাস ইয়োরোপীয় নভেলতত্ত্বের আওতার মধ্যে, আসেই না। অথচ পৃথিবীর উপন্যাস-সাহিত্যবিচারের একমাত্র নিরিখ ইয়োরোপীয় নভেলতত্ত্ব। সে-নভেলতত্ত্বে আবার বুর্জোয়া বিকাশের তত্ত্ববিদ আর মার্ক্সবাদী তত্ত্ববিদরা একমত। ইয়োরোপের বিভিন্ন ভাষায় কলোনিবিস্তারী ধনতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবন যেমন উপন্যাসের বিষয় হয়ে ওঠে, তেমনি উপনিবেশের বৃহত্তর পৃথিবীর নানা ভাষার নানা স্তরের উপনিবেশিত সমাজ, ও নানা বিচিত্র পদ্ধতিতে শোষিত মানুষজনও উপন্যাসের বিষয় হতে পারে। ইয়োরোপীয় নভেলতত্ত্ব অনুযায়ী তারা দুজনই হিরো বা নায়ক। এই দুজনের একজন যে প্রভু ও আরেকজন যে তার প্রভুত্বের শিকার— এই বৈপরীত্যের কোনো স্বীকৃতি ইয়োরোপীয় নভেলতত্ত্বে নেই। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি, যার আর-এক নাম উদার-অর্থনীতি, তার বিকাশের নানা স্তরের সঙ্গে নভেলের বিকাশের নানা ধরনের যে মিল লুসিয়েঁ গোল্ডমান অনুমানের আকারে উপস্থিত করেছেন, সেটা প্রত্যাখ্যানের সময় পেরিয়ে গেছে।
উপন্যাসের শিল্পতত্ত্বও তো নন্দনতত্ত্বেরই অন্তর্গত। উপন্যাসের শিল্পতত্ত্বের এই পশ্চিম ইয়োরোপীয় আধিপত্যবাদ তৈরি হয়েছে বুর্জোয়া বিপ্লবের মহত্তম দার্শনিক হেগেল-এর নেতৃত্বে।
হেগেল-এর মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর ‘লেকচার্স অন এসথেটিক্স’ (১৮১৮)-এ তিনি গ্রাহ্য শিল্পপ্রকরণগুলির একটি তালিকা দিয়েছিলেন। হেগেল এই বক্তৃতাগুলিতে বিষয় ও আঙ্গিকের ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে বলেছিলেন— এই ঐক্য কখনো ভাঙতে পারে না, সৌন্দর্যের একটা কুৎসিত ধারণাই সৌন্দর্যের একটা কুৎসিত আকার তৈরি করতে পারে। হেগেল বলেছিলেন, ‘বিষয়টিই আকার।’ আরো বলেছিলেন, ‘বিষয়ের দোষ থেকেই আকারের দোষ ঘটে।’ এই খারাপ বিষয় ও খারাপ আকারের উদাহরণ দিতে গিয়ে হেগেল বলেছিলেন, ‘চিনের লোকরা, ভারতীয়রা, ইজিপ্টের লোকজন কখনো যথাযথ সৌন্দর্য আঁকতে পারেনি। তারা আমাদের দেবদেবীর যে-সব ছবি ও মূর্তি তৈরি করেছে, সেগুলো হয় আকারহীন অথবা আকারের এক মিথ্যা ও ভয়ঙ্কর চেহারা।’
হেগেল যখন এই তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন, তখন কলকাতার ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে ও যে-সব সাহেবপণ্ডিতদের আমরা পরবর্তী কালে ‘অরিয়েন্টালিস্ট’ বলব, তাঁরা ইয়োরোপে ভারতীয় ও ইজিপ্টীয় স্থাপত্য, দেয়ালচিত্র, ভাস্কর্য, চিনের বস্ত্রশিল্প, ইজিপ্টের সমাধিশিল্প— এই সব কিছুর নিদর্শন দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন।
হেগেল-এর নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক বক্তৃতাগুলি থেকে বোঝা যায়— তিনি সে-সব খবরই জানতেন না। নাই জানতে পারেন। কিন্তু তথ্য সম্পর্কে তাঁর স্পর্শকতারতার যে-সব গল্পকথা আমরা শুনেছি পরে, সে-সব আজগুবি ঠেকে ও তাঁর তত্ত্ব অথ্যনির্ভর নয় এটাই প্রমাণিত হয়।
১৮১৮-তে প্রকাশিত তাঁর ‘নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক বক্তৃতা’য় হেগেল শিল্পপ্রকরণের যে-তালিকা দিয়েছিলেন, তাতে নভেল ছিল না। অথচ ততদিনে সারভেন্তেস-এর ‘ডন কুইকজোট’ বই-আকারেই ২১৩ বছরের পুরনো, র্যাবলে-র ‘গারগানটুয়া-রও একশ বছর পার হচ্ছে। লেরমনতোভ-এর নায়ক ককেশাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুশকিন-এর ফেরার মাস্তানরা মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবুর্গ-এর বড়লোকদের বৈঠকখানায় ঢুকে পড়েছে, গোগোলের মরা দাসরা নভেলের লোক হয়ে যাচ্ছে ও মধ্যরাতে শহরের কালভার্ট পেরচ্ছে যারা তাদের কাঁধ থেকে কেরানির ভূতগুলো শুধুই ওভারকোটগুলো খুলে নিচ্ছে।
ইয়োরোপেই যে গল্প-উপন্যাস লেখা হচ্ছে হেগেল তারও খরব রাখতেন না। নাই রাখতে পারেন। কিন্তু তিনি তো বুঝতেই পারেননি ‘নভেল’ বা ‘গল্প’ বলে একটা সম্পূর্ণ নতুন শিল্পপ্রকরণ তৈরি হয়ে উঠছে। যাকে তিনি কুৎসিত বিষয় বলেছেন— সেই চুরি, জোচ্চুরি, মেয়েবাজি, কেরানিগিরি, মাস্তানি শিল্পের বিষয় হয়ে উঠছে। বুর্জোয়া বিপ্লবের তাত্ত্বিক গুরু নতুন সমাজের ওপর এক গ্রিস-সমতুল্য এরোস-এথোস-এর নিরিখ আরোপ করছিলেন। তত দিনে সেই সব গ্রিক আদর্শ তো লোপাট হয়ে গেছে। আধুনিক শিল্পপ্রকরণ তৈরি হয়ে উঠেছে ও উঠবে— নভেল, খবরের কাগজ, সিনেমা, স্টেডিয়ামে খেলা ও নাটক, ইলেকট্রিক আলো, ধীরে-ধীরে নতুন সব শিল্পপ্রকরণের জন্ম দিচ্ছে। বার্লিন অলিম্পিকেই প্রথম হিটলার মাটি থেকে উৎক্ষিপ্ত সার্চলাইটের কলায় সাজিয়ে দুনিয়াকে ভড়কে দিয়েছিলেন। শিল্পের নিভৃত ব্যক্তিচর্চা বদলে যাচ্ছে পরিবর্তিত টেকনোলজির সঙ্গে-সঙ্গে। ছাপাখানায় বই ছাপা হচ্ছে হাজার হাজার কপি। নভেলই হচ্ছে সেই আধুনিক শিল্পের প্রথম নিদর্শন। ইয়োরোপীয় নন্দনতত্ত্ব নভেলের হদিশ করতে পারে নি।
চার
কথাটা আচমকা শুনতে একটু ধাক্কা লাগতে পারে। আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস প্রধানত ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসের কাঠামোতেই যে-ভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে এমন ধারণা তো আমাদের ভিতর বদ্ধমূল, যে ইংরেজদের কাছ থেকেই আমরা নভেল লেখা শিখেছি ও সাহেবদের লেখাপত্র পড়ে-পড়েই আমরা চিরকাল জেনে আসছি নতুন ব্যক্তিপ্রধান সমাজের শিল্পপ্রকরণ হয়েই নভেল তৈরি হয়েছে, বাংলা নভেলও।
বাংলা নভেল লেখা শুরু হওয়ার প্রক্রিয়াটা আমরা পরে আলোচনা করব কিন্তু আপাতত আমাদের আরো কিছু সাক্ষ্য হাজির করতে হবে— এই প্রাথমিক প্রতিপাদ্যের পক্ষে যে ইয়োরোপ উপন্যাস যখন লেখা হচ্ছিল তখন ইয়োরোপ উপন্যাসের শিল্পপ্রকরণ বুঝে উঠতে পারে নি।
হেগেল-এর পর গেয়র্গ লুকাচ-এর একটা দৃষ্টান্ত নেয়া যাক কারণ লুকাচ আমাদের উপন্যাস সম্পর্কিত অনেক ধ্যান-ধ্যারণার আদিপুরুষ।
১৯২০-এ লুকাচের ‘দি থিয়রি অভ দি নভেল’ বইটি বেরয়। তার আগে ১৯১৪ ও ১৯১৬-তে লেখাটি পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছে। ১৯৬২-র জুলাইয়ে বইটির নতুন সংস্করণের ভূমিকায় গেয়র্গ লুকাচ বইটি লেখার ইতিহাস, তৎকালীন মার্ক্সবাদী ও কিছু অমার্ক্সবাদীর ওপর এই বইটির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ও বইটির পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। সেই ভূমিকার দুই-একটি জায়গা এখনো প্রাসঙ্গিক। যেমন, লুকাচ বলছেন, ‘দি থিয়রি অব দি নভেল’ বইটির সাধারণ পদ্ধতিগত আদর্শ হেগেল। নান্দনিক ও দার্শনিক দিক থেকে হেগেল-এর সঙ্গে বইটির কোনো বিরোধিতা নেই। যেটুকু বিরোধিতা তা শুধুই সামাজিক। আর-এক জায়গায় লুকাচ বলছেন, ‘আমি যদ্দুর বুঝি তাতে বলতে পারি, দি থিয়রি প্রথম জার্মান বই যেখানে সামগ্রিক বিপ্লবমুখী বামপন্থী নীতি ও ন্যায়ের সঙ্গে বাস্তবের ঐতিহ্যসম্মত ও প্রচলিত ভাষ্য মেলানো হয়েছে।’
লুকাচের এই ধারণাটি যথার্থ। এই বইয়ের তাই দুটি ভাগ। প্রথম ভাগ— ‘তৎকালীন সভ্যতা সঙ্গতিপূর্ণ না সংকটপূর্ণ সেই প্রশ্নের মীমাংসায় মহান এপিক সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকার।’ দ্বিতীয় ভাগ— ‘নভেলের প্রকরণের চরিত্র সন্ধান।’ প্রথম ভাগে— গ্রিস, খ্রিস্টান ধর্ম, বিভিন্ন সাহিত্যপ্রকারের সমস্যা, এপিক ও নভেল, নভেলের ভিতরের গঠন, নভেলের ঐতিহাসিক-দার্শনিক আবহ— এই পাঁচটি পরিচ্ছেদ। দ্বিতীয় ভাগে— বিমূর্ত আদর্শবাদ, রোম্যান্টিসিজমের স্বপ্নভঙ্গ, গ্যেটের উইলহেলম মেইস্টারস-এর শিক্ষানবিশিপর্ব, তলস্তয় ও সমাজসংগঠনের বহির্মুখ— এই চারটি পরিচ্ছেদ। পৃষ্ঠার দিক থেকে প্রথম ভাগটি দ্বিতীয় ভাগের দেড়া। তাতে বোঝা যায়, নভেলের সঙ্গে প্রাচীন সাহিত্যের, প্রধানত এপিকের সংযোগসূত্র তৈরি করতে লুকাচ প্রাচীন সাহিত্যের পুনর্পাঠে বা পুনর্গঠনে যত্মশীল, আর সেই অভিজ্ঞতাতেই দ্বিতীয় ভাগে ডন কুইকজোট, বালজাক, গোলচারভ, ফ্লবেয়ার, গ্যেটে, তলস্তয়, দস্তয়েভ্স্কিকে সংযুত করেছেন।
লুকাচ-এর এই চেষ্টা সাহিত্যের ইতিহাসের ইতিহাসে পথিকৃতের কাজ। এই বইটির প্রায় পনের-বিশ বছর পর মিখাইল বাখতিন প্রধানত দস্তয়েভ্স্কি প্রসঙ্গে উপন্যাসের নতুন দায়িত্বকে মিনান্মিয়ান ট্র্যাজেডির মত প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। যদিও বাখতিন-এর সে-সব লেখা পুনরুদ্ধার করতে অন্তত আরো বছর তিরিশ কেটে গিয়েছিল।
লুকাচ তাঁর এই কাজের যে-বৈশিষ্ট্য ৪২-বছর পরের সংস্করণে উল্লেখ করেছিলেন, সামগ্রিক বিপ্লবমুখী বামপন্থী নীতি ও ন্যায়ের সঙ্গে বাস্তবের ঐতিহ্যসম্মত ও প্রচলিত ভাষ্য-এর ভিতর সংযোগ তৈরি আর বাখতিন স্তালিনের আদর্শবাদী স্বৈরাচারের এক বিপরীত ভাষ্য যে-খুঁজছিলেন র্যাবলে ও দস্তয়েভ্স্কির রচনায়— এই দুইয়ের ভিতরও মিল যথেষ্ট। মিল হয়তো আরো একটু বেশি। ১৯২৩-এ লুকাচ, কারো-কারো মতে তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ, ‘হিস্টরি অ্যান্ড ক্লাসকনসাসনেস’ বের করেন। বেরবার পরপরই এল রুদাস, ও এ. ডেরোরিন বইটির একটি মারাত্মক সমালোচনা করেন। লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন তখন পার্টির ওপর তাঁর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছেন কিন্তু তখনো সেই আধিপত্য সর্বস্বীকৃত হয় নি। ১৯২৫-২৬ নাগাদ লুকাচ ঐ স্তালিনীয় সমালোচনার উত্তরে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সে প্রবন্ধ কোথাও ছাপা হয় না ও লুকাচ তাঁর অসংখ্য মুখোমুখি কথাবার্তায় কখনো একবারের জন্যও এই লেখাটির উল্লেখ করেন নি। পেরেস্ত্রোইকা-র পর সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিলেখ্যাগারের নথিপত্র সারা দুনিয়ার সামনে খুলে দেয়া হলে এই লেখাটি পাওয়া যায়। ২০০২ সালে লেখাটির ইংরেজি অনুবাদ ‘ভের্সো’ কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
মার্ক্সবাদী চিন্তা, মননবিশ্বের দ্বান্দ্বিক সংঘাত ও সৃষ্টিশীল সাহিত্যের বিশেষ রকম ব্যাখ্যা এই সব কিছুই যে একটি সূত্রে গেঁথে ফেলার চেষ্টা চলছিল বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পরের দশকেও, তার এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্রে উত্তরণের অবধারিত পথ সম্পর্কে নিশ্চয়তায় পৌঁছুনো।
সেই কারণেই লুকাচ ও বাখতিনের মত মনীষীদের এমন প্রয়াস— পৃথিবীর প্রাচীন সাহিত্যকে তার আধুনিক রূপান্তরের সঙ্গে গ্রথিত করে দেয়া। আমরা যখন বিশেষ করে সময়টার কথা মনে রাখি— মোটামুটি বিশ শতকের প্রথম তিনটি দশক— তখন তো বিস্মিত না-হয়ে কোনো পথ থাকে না যে লুকাচ ও বাখতিন, তাদের মত পণ্ডিত সূত্রকাররা প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে আধুনিক উপন্যাসের সম্বন্ধ বিচারে একবারের জন্যও এমন প্রাচীন এপিকে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ ভারতের রামায়ণ-মহাভারত পুরানসাহিত্য-জাতককাহিনীর নামোল্লেখ পর্যন্ত করেন না। পশ্চিম এশিয়ার ইসলাম অধ্যুষিত দেশগুলিতে ইসলামি ও প্রাগিসলামি ঐহিক সাহিত্য— আরব্য উপন্যাস, সিন্দাবাদের কাহিনী ইত্যাদি দ্বারা ইয়োরোপের উপন্যাস সাহিত্যের প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টিও তোলেন না। ও এই ১৯২০ বা ১৯৪০ নাগাদ ভারত-উপনিবেশে উপন্যাস-সাহিত্যের যে নতুন বিস্ময়কর অভ্যুদয় ঘটেছে, তাকে বিশ্ব-সংস্কৃতির ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতার এক সম্পূর্ণ নতুন উদাহরণ হিসেবেও পাঠ করেন না। অথচ ১৯২০-নাগাদ তো লেনিন প্রাচ্যদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনকে বিশ্ববিপ্লবের অন্তরঙ্গ উপাদান হিসেবে স্পষ্ট চিহ্নিত করেন। আজ যখন ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ একটা বিশিষ্ট বিষয় হিসেবে সারা পৃথিবীর বিদ্যাচর্চাতেই স্বীকৃত, তখন তো চোখের সামনে দেখতে পাই— ১৯১০ সালে ১৯৪০-এর মধ্যে ভারতের বিভিন্ন ভাষায়, বিশেষ করে ছোটগল্প ও উপন্যাস, এমন লেখা হচ্ছে যে-তৎকালীন বিশ্বের যে-কোনো দেশের তুলনায় সেগুলি বিশ্বসাহিত্যের অংশ ও উপন্যাসের কোনো-কোনো গড়ন ইয়োরোপের কোনো ভাষার আগে ভারতের কোনো ভাষায়, বিশেষ করে বাংলায়, তৈরি হয়ে উঠেছে। ছোটগল্পের আকার রুশ ও ফরাসি ভাষার সঙ্গে-সঙ্গে বাংলাতেই প্রথম স্থিরীকৃত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে উনিশ শতকের শেষ দশকে।
‘ঘরে বাইরে’র রচনাকালে গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে এসেছেন বটে কিন্তু ভারতে রাজনীতিতে তখনো গান্ধীযুগ শুরু হয়নি। গান্ধীজি ছোটখাটো দু-চারটে আন্দোলনে তাঁর আন্দোলন ও সত্যাগ্রহ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন বটে কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক তত্ত্ব ও আদর্শ তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ‘ঘরে বাইরে’-তে যে বিদেশী দ্রব্য বয়কটের কথা বলা হয়েছে সেটা ১৯০৫ থেকে ১৯০৮-এর স্বদেশী যুগের ঘটনা।
এই একপেশে বিচারের একটা উদাহরণ দিলে হয়তো স্পষ্ট হবে, কোন্ কথাটার ওপর জোর দিতে চাই।
লুকাচ রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটির একটা খুব ছোট, খুবই ছোট, আলোচনা করেছিলেন। লুকাচ বলেছিলেন, এটা রবীন্দ্রনাথের ‘এ গান্ধী নভেল।’ লুকাচ উপন্যাসটির গল্পটিও বুঝতে পারেন নি, একজন সাধারণ পাঠকও গল্পের ঘটনা যেমন পরপর পড়ে যান, তেমন ওপর-ওপরও উপন্যাসটি পড়েন নি তিনি। সেটা ধরা পড়ে যায় তিনি গল্পটির টুকরো টুকরো যে-বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে।
‘ঘরে বাইরে’ লেখা হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধর বছরগুলিতে— প্রথমে কাগজে ধারাবাহিক বেরয়, পরে বই হয়ে (১৯১৬)। ১৯১৯ নাগাদই এর ইংরেজি অনুবাদ Home and Abroad বেরিয়ে যায়।
‘ঘরে বাইরে’র রচনাকালে গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে এসেছেন বটে কিন্তু ভারতে রাজনীতিতে তখনো গান্ধীযুগ শুরু হয়নি। গান্ধীজি ছোটখাটো দু-চারটে আন্দোলনে তাঁর আন্দোলন ও সত্যাগ্রহ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন বটে কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক তত্ত্ব ও আদর্শ তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ‘ঘরে বাইরে’-তে যে বিদেশী দ্রব্য বয়কটের কথা বলা হয়েছে সেটা ১৯০৫ থেকে ১৯০৮-এর স্বদেশী যুগের ঘটনা। অথচ লুকাচ এটাকে গান্ধীজির বিদেশী পণ্যবর্জনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন।
গুলিয়ে না-হয় ফেললেন কিন্তু সেটাই হয়ে দাঁড়াল বইটির সাহিত্যমূল্য নির্ধারণের প্রধান নিরিখ। লুকাচ এতদূর পর্যন্ত গেলেন যে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে ব্রিটিশ-পুলিশের স্তাবকতা করেছেন রবীন্দ্রনাথ এমন কথাও লিখলেন।
আমি জানি— লুকাচ সম্পর্কে আমরা এতটাই সশ্রদ্ধ যে তাঁর সম্পর্কে এই কথাগুলি ঠিক কী না, অনেকে এমন সন্দেহ করতে পারেন। সেই কারণে, এই নিবন্ধের সঙ্গে লুকাচের মূল লেখার ইংরেজি অনুবাদের কপিটি সংযোজন হিসেবে জুড়ে দিলাম।
ইয়োরোপে ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক সূত্রপাত থেকে সেখানকার যে-সমস্ত উপন্যাসে গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ নিয়ে আলোচনা ঘটেছে, লুকাচ তাঁর উপন্যাস সম্পর্কিত রচনাগুলিতে সেই উপন্যাসগুলির বিশেষ উল্লেখ করেছেন ও এই বিচারেই টমাস মান-এর মাহাত্ম্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন, অথচ ‘ঘরে বাইরে’ জুড়ে জাতীয় মুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে যে তর্কবিতর্ক, তা তিনি পড়লেনই না।
পাঁচ
ঐ প্রবন্ধে অপর প্রতিপাদ্য ছিল— উপন্যাসের শিল্পকর্ম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে ইয়োরোপের, তাত্ত্বিক চিন্তা অসম্পূর্ণ ও উপন্যাস শিল্পের পৃথিবীব্যাপী অনুশীলনের যথাযোগ্য তত্ত্ব নয়। আমি এও বলেছি— উপন্যাসকে বুর্জোয়াপর্বের বা ধনতন্ত্রিক যুগের শিল্পরূপ বলে বর্ণনা করাও অনৈতিহাসিক। আমার যুক্তিবিন্যাসে এমন কথারও আভাস আছে যে, উপন্যাস ব্যক্তির বিকাশের বা বিকাশের সংকটের কাহিনী নয়, অনেক সময়ই সামাজিক বিকাশ ও সংকটের কাহিনী, অনেক সময়ই সিস্টেমের সংকটকথা।
এগুলো সবই এতকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত উপন্যাস সম্পর্কিত ধারণার বিপরীত নেতিবাচক কথা। উপন্যাসের সংজ্ঞা ও স্বভাব সম্পর্কে আমার ধারণা কী, এর প্রমাণ দেয়ার দায়-দায়িত্ব যদিও আমার ওপর বর্তায় না, তবু সে বিষয়ে আমার কিছু অনুমান না থাকলে পাশ্চাত্যের উপন্যাসতত্ত্ব অস্বীকারের কথা আমার মাথায় আসত না।
এই সিদ্ধান্তগুলিতে আমি পৌঁছেছি আমার কাজের মধ্য দিয়ে ও কাজের প্রগতির প্রয়োজনে। প্রায় ষাট বছর ধরে গল্প-উপন্যাস লিখছি। সেই অব্যাহত চর্চার মধ্যে দিয়ে এমন অনুভবে পৌঁছেছি বারবার যে বাংলা উপন্যাসের সৃষ্টি বাংলা লেখকের নিজস্ব তাড়নায়, ও শিল্প-আকাঙ্ক্ষায়। কোনো ক্রমেই ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় লেখা কাহিনীর অনুকরণ থেকে নয়।
এমন কি কখনো-কখনো কোনো ইয়োরোপীয় ঔপন্যাসিক বা ইয়োরোপীয় কোনো উপন্যাস যদি কোনো বাংলা লেখককে প্রভাবিত করেও থাকে তবে সেই বিশেষ রচনার মধ্যেই তিনি সেই প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছেন তাঁর স্বাধীন ও স্বয়ম্ভর সৃষ্টিশক্তি ও বাংলা সাহিত্যের অন্তনির্হিত প্রবল গতিময়তার জোরে। ১৮৫৮ ও ১৮৬১-১৮৬২-তে যথাক্রমে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ থেকে এই আমাদের এখনকার সময় পর্যন্ত কিঞ্চিদধিক দেড়শ বছর ধরে বাংলা উপন্যাস লেখা হয়ে আসছে স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সাহিত্য হিসেবে। কী সূচনাপর্বে, কী আধুনিকপর্বে বাংলা উপন্যাস নিজের এমন ইতিহাস তৈরি করে তুলেছে যা পৃথিবীর যে-কোনো ভাষার সাহিত্যের ইতিহাসের উপন্যাসকীর্তির সমতুল্য। বিশেষ করে এখন, যখন এই কথাগুলি ভাবছি, বাংলাদেশের গত তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছরে লেখা কিছু উপন্যাসে-উপন্যাসশিল্পে বাংলা লেখকদের অভীপ্সা ও সামর্থ্যরে এমন প্রমাণ আমরা পেয়েছি, যাতে এ-কথা দায়িত্ব নিয়ে ভাবাও যায়, বলাও যায়, ভাবা উচিত ও বলা উচিত যে বাংলাদেশের লেখকরাই এখন দুনিয়ার সেরা উপন্যাসগুলি লিখছেন। এ-কথা আমি অন্যত্র সবিস্তার বলেছি। এখানে লেখক ধরে-ধরে ও বই ধরে-ধরে সে-আলোচনায় যাচ্ছি না— প্রধানত তাত্ত্বিক এই প্রবন্ধের গতি তাতে ব্যাহত হতে পারে। তবু প্রবন্ধের শুরুতেই উপন্যাসের সংজ্ঞা কত বিচিত্র হতে পারে তার যে একটা লিস্টি তৈরি করা হয়েছিল, তাতে কিছু বাংলা উপন্যাসের উল্লেখ অকারণ ছিল না ও আরো অনেক বাংলা উপন্যাস অনুল্লেখিত ছিল, বলাই বাহুল্য।
ইয়োরোপীয় ভাষায় বাইরে শিল্পতত্বের এই চর্চা খুব একটা ঘটে নি, এমন কি আমেরিকাতেও নয়। ইয়োরো-আমেরিকার বাইরের দেশে তো প্রায় কিছুই ঘটে নি বলা যায়। ফলে সাহস করে একটু ঠাট্টা মিশিয়ে এমন কথা বলে ফেলা যায় যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ইয়োরোপ একজিসটেনসিয়ালিজম, অ্যাবসার্ড, ডিকোডিফিকেশন, ডিকনস্ট্রাকশন, টেক্সচুয়ালিটি, পোস্ট-মডার্নিটি, ডেথ অব দি অথর, ম্যাজিক রিয়ালইজম ইত্যাদি ইত্যাদি নানা তত্ত্ব আবিষ্কার করে যাচ্ছে— আর তাতে আমাদের বোঝাবুঝির যে একটু-আধটু সুবিধে হচ্ছে না তাও নয়, কিন্তু ইয়োরোপ উপন্যাস ভাবতেও পারছে না, লিখতেও পারছে না। উপন্যাসের প্রধান কর্মশালার স্থানান্তর ঘটে গেছে লাতিন আমেরিকার কোনো-কোনো দেশে, পশ্চিম আফ্রিকায়, আরব দুনিয়ার, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ও বাংলাদেশে।
কিন্তু সাহিত্য বা অন্য যে-কোনো শিল্পের প্রসঙ্গে মৌলিক তত্ত্বভাবনা ছাড়া কোনো মৌলিক শিল্প তৈরি হতে পারে না। শিল্পতত্ত্ব নিশ্চয়ই তাত্ত্বিকদেরই ক্ষেত্র নয়। কোনো শিল্পীই তাঁর রচনার তত্ত্বভিত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত না-হয়ে শিল্পসৃষ্টি করতে পারেন না। এমন হতেই পারে যে শিল্পী বা লেখক যুক্তিবিকাশের পদ্ধতি অনুযায়ী তাঁর তত্ত্ব তৈরি করে তুলতে চান না। এমনও হতে পারে যুক্তিবিন্যাসের অতিনির্দিষ্টতায় লেখার বা শিল্পের আড় বা রহস্য ভেঙে এড়িয়ে যান হয়তো। আবার, এও তো সত্য যে যত বড় দার্শনিক ও তাত্ত্বিকই হন, তিনি যখন শিল্পতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন তখন তাঁর হাতে থাকে কতগুলি নির্দিষ্ট শিল্প— লেখা বা ছবি বা ভাস্কর্য বা সংগীত— আর তাঁর তত্ত্ব আমাদের নিয়ে আসে বারবার সেই তত্ত্বের অব্যবহিত শিল্পেরই কাছে।
ইয়োরোপীয় ভাষায় বাইরে শিল্পতত্বের এই চর্চা খুব একটা ঘটে নি, এমন কি আমেরিকাতেও নয়। ইয়োরো-আমেরিকার বাইরের দেশে তো প্রায় কিছুই ঘটে নি বলা যায়। ফলে সাহস করে একটু ঠাট্টা মিশিয়ে এমন কথা বলে ফেলা যায় যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ইয়োরোপ একজিসটেনসিয়ালিজম, অ্যাবসার্ড, ডিকোডিফিকেশন, ডিকনস্ট্রাকশন, টেক্সচুয়ালিটি, পোস্ট-মডার্নিটি, ডেথ অব দি অথর, ম্যাজিক রিয়ালইজম ইত্যাদি ইত্যাদি নানা তত্ত্ব আবিষ্কার করে যাচ্ছে— আর তাতে আমাদের বোঝাবুঝির যে একটু-আধটু সুবিধে হচ্ছে না তাও নয়, কিন্তু ইয়োরোপ উপন্যাস ভাবতেও পারছে না, লিখতেও পারছে না। উপন্যাসের প্রধান কর্মশালার স্থানান্তর ঘটে গেছে লাতিন আমেরিকার কোনো-কোনো দেশে, পশ্চিম আফ্রিকায়, আরব দুনিয়ার, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ও বাংলাদেশে।
ইয়োরোপ তত্ত্ব করে, আমরা লিখি— এমন আত্মসন্তুষ্টিতে নেশাগ্রস্ত হয়ে থাকলে উপন্যাসের ওপর এই কর্তৃত্ব এই সব দেশেরও থাকবে না। এটাই উপন্যাসের বর্তমান সংকট।
কথাটা এখানেই শেষ করে দেয়া যেত, যে-দেশগুলি আগে ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ বা কলোনি ছিল, সেই দেশগুলিকে তাঁদের উপন্যাসের জন্য নতুন তত্ত্ব রচনা করতে হবে।
সেই নতুন তত্ত্ব ভাবা ও তৈরি করে তোলাও একটা নিরবধি লড়াই। সেই কথাটায় না-পৌঁছে আমার এই কথাটা শেষ করা যায় না।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দি রেচেড অব দি আর্থ’ বইটিতে ফ্রানজ ফ্যানন প্রথম বলেছিলেন— কলোনিগুলি থেকে পাশ্চাত্য মননজাত ও সৃষ্টিজাত সম্পদ লুট করেছে। কলোনিগুলি রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও সেই লুটের সম্পত্তি বহাল আছে। ফ্যানন বলেছিলেন, কলোনিযুগ শেষ হয়ে গেলেও পাশ্চাত্য বা ইয়োরোপ কলোনিগুলির মনন ও সৃষ্টির ওপর দখল ঢিলে করেনি। কিন্তু তাঁর এই কথাগুলি বলতে গিয়ে ফ্যানন ‘উপনিবেশোত্তর’ বা পোস্ট-কলোনিয়্যাল পদটি ব্যবহার করেন নি।
এডোয়ার্ড সয়িদ-এর ‘অরিয়েন্টালিস্ট’ বইটি বেরয় ১৯৭৮-এ। তার পর থেকে তিনি যে-টুকরো লেখাগুলি লিখছিলেন ও লিখিত যে-বক্তৃতাগুলি লিখছিলেন সেগুলোর একটি সংকলন বেরয় ১৯৯৬-এ। বইটির নাম ‘কালচার অ্যান্ড ইমপিরিয়্যালইজম।’ আমি লক্ষ করেছি— সয়িদ তাঁর এই লেখাগুলিতে কোথাও ‘পোস্ট-কলোনিয়্যাল’ শব্দটি ব্যবহার করেননি।
কিস্তু তাঁদের মধ্যে ২০ বছর সময়ের ব্যবধান সত্ত্বেও ফ্যানন ও সয়িদ উপনিবেশের মানুষের ধন ও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন চিন্তা উসকে দিলেন। এই নতুন চিন্তা কিন্তু ইতিহাস নিয়ে ফুকো-র, পাঠ্য নিয়ে দেরিদা-র ও ভাবতত্ত্ব নিয়ে দেল্যুজ-এর নতুন চিন্তার সমান্তরাল ছিল।
গত শতকের ৯০-এর দশকে কয়েকজন পণ্ডিত মানুষ— গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভ্যাক, অমিভাবা, জ্ঞানপ্রকাশ প্রমুখ— কলোনি পরে লেখা সাহেবদের বইপত্র নতুন করে পড়ে বললেন কোনো সাম্রাজ্যের কোনো লেখাই কলোনিগুলির প্রভু ও প্রজা কাঠামোর বাইরে যায় না।
এই প্রমাণের পর সাহেবদের হাস্যশোভন মিষ্টি দাঁত খেঁচিয়ে উঠল ও ওঁদের তৈরি পোস্ট-কলোনিয়ালিজম-এর ধারণা আক্রান্ত হল।
যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁরা ইংল্যান্ড-আমেরিকাতেই স্থায়ীভাবে থাকেন ও তাঁদের বিদ্যাচর্চার কাজ করেন। কিন্তু তাঁরা যখন পোস্ট-কলোনিয়্যাল বা উত্তর-উপনিবেশ ধারণাটা তৈরি করলেন ও ব্যবহার করলেন তখন আমেরিকার বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের আক্রমণ করে এমনও বললেন— তাঁরা এই সব নতুন কথা বলে তাঁদের চাকরি-বাকরির সুবিধে করতে চাইছেন। ‘প্রফেশন্যাল অ্যাকোমোডেশন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড কোয়াটারলি’র ১৭ খণ্ডের ২য় সংখ্যায় ১৯৯৬-এ জেসপার গস সবচেয়ে নোংরা আক্রমণ করেছিলেন। ১৯৯৪-এ শীতের ২০-তম সংখ্যার ‘ক্রিটিক্যাল এনকোয়্যারি’তে ‘পোস্ট-কলোনিয়্যাল অরা’ শিরোনামে আরিখ ডিরলিক একটি যুক্তির্পূণ প্রবন্ধ লেখেন।
এই সব বিপরীত আলোচনায়, প্রশ্নগুলি কী ছিল?
১. উত্তর উপরিবেশ কোন সাম্রাজ্যের অন্তর্ঘাত ঘটাচ্ছে?
২. এমন কোনো বাস্তব পরিস্থিতি কি নির্দিষ্ট করা যায় যেগুলিকে উত্তর-উপনিবেশের লক্ষণ বলে চিনে নেয়া যায়?
৩. উত্তর-উপনিবেশ বলতে কি নির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতি বোঝায় না কী সম্পূর্ণ আলাদা ও পৃথক কোনো অবস্থা বোঝায়?
৪. উত্তর-উপনিবেশ বলতে বোঝায়টা কী? কলোনি পেরিয়ে? কলোনির ভিতরে? কলোনি থেকে আলাদা?
৫. পোস্ট-কলোনিয়্যাল পদটির জোরটা কোন অংশের ওপর ‘পোস্ট’-এর ওপর না ‘কলোনিয়্যালিজম’-এর ওপর?
একে বলে সাহেব! আমেরিকার ইতিহাস সিলেবাসে ‘থার্ড প্যাসেজ’ পড়ানো হয় না। কারণ, ‘থার্ড প্যাসেজ’-এর অর্থ সমুদ্রপথে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে জাহাজের খোল ভর্তি করে দাস আমদানি। আমেরিকা এটা ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চায়।
সাহেবরা এখন ‘কলোনি’র মানে বোঝে না। অথচ ব্রিটিশ সরকারের লন্ডনে একটা মন্ত্রকই ছিল, তার নাম কলোনিয়্যাল অ্যাফেয়ার্স।
কলোনি বলতে বোঝায় জমি। সেই জমি যে দখল করে সে কলোনাইজার। সেই জমির তো অধিকারী আছে, মালিক আছে যাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। উত্তর-উপনিবেশ বলতে বোঝায় সেই মুহূর্ত যখন থেকে মাটি-জমির মালিক যে ছিল সে জানে সে বসবাস করলেও সে ঐ জমির মালিক নয়। তখন তার এটা ভৌতিক পরজীবন শুরু হয়— মারা না গিয়েও পরলোকের জীবন। সেই জীবনযাপনই উত্তর-ঔপনিবেশিক জীবন। কলোনি প্রতিষ্ঠার পরের মুহূর্ত থেকে এই জীবন। কলোনি মুক্ত হয়ে যাবার পরের জীবন নয়। সেই জীবনের গল্পই লিখেছেন— কলোনির গল্পকার ঔপন্যাসিকরা। কলোনিতে এমন কোনো লেখক থাকতেই পারেন না যিনি কলোনির সেই জীবনের কাহিনী ছাড়া অন্য কোনো কাহিনী লেখেন। সেই কাহিনীই নতুন তত্ত্বের ভিত্তিতে পুনরুদ্ধার করা গল্প-উপন্যাসের লেখকদের কাজ। গল্প-উপন্যাস কোনো বিমূর্ত শিল্প নয়। যেমন বলেছিলেন এডোয়ার্ড সয়িদ, Narrative is crucial to my argument here, my basic point being that stories are at the heart of what explores and novelists say about strange regions of the world, they also become the method colonized people use to assert their own identity and existence of their own history.
এর সঙ্গে আমি যোগ করতে চাই— সেই গল্পের তত্ত্ব উদ্ঘাটন করার দায় এই আমাদের প্রাক্তন উপনিবেশের গল্পকার-ঔপন্যাসিকদের। সে-দায়িত্ব কোনো ঐতিহাসিক বা সমাজবিজ্ঞানীও নিতে পারেন। কিন্তু গল্পকার— ঔপন্যাসিকদের পক্ষে সেই দায়িত্ব অনিবার্য। সেই স্বাদেশিক ও স্বভাষিক তত্ত্বভূমি ছাড়া স্বাদেশিক ও স্বভাষিক উপন্যাসের ভূমিকা তৈরি হবে না। উপন্যাসকে তার পাঁচশ বছরের জালি সর্বজনীনতা থেকে বের করে আনবেন প্রাক্তন কলোনির গল্পকার-ঔপন্যাসিকরা, নতুন করে পাঠোদ্ধার করবেন পুরনো লেখকদের ও সাহিত্যের। পৃথিবীর উপন্যাস তার সংকট মোচনের জন্য আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।