মোদির রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন ছুতা- ‘আরবান নকশালিস্ট’

মোদির রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন ছুতা- ‘আরবান নকশালিস্ট’

যতদূর মনে করতে পারি, খুব সম্ভবত মাওবাদী নকশাল ন্যারেটিভ’র উপর তিনটা কি চারটা মোম্বাই সিনেমা দেখেছিলাম। এগুলোর সবই বিজেপির মোদি শাসন আমল শুরুর আগে তৈরি। কিন্তু এগুলাতে যথাসম্ভব পুরো নকশালী বয়নটাকে একটা নিরপেক্ষ জায়গা থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেহেতু একধরনের নিরপেক্ষতা সিনেমাগুলোরতে আছে তাই আলোচনার খাতিরে এই সিনেমাগুলো আমলে নেওয়া যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে মোদি সরকার  আরবান মাওবাদী -নামে যে নতুন ছুতা হাজির করে শহুরে বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী ও ভিন্ন চিন্তার মানুষদের উপর স্টিম রোলার চালাচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হতে পারে এটা বুঝি হুট করেই শুরু করা হয়েছে। সামনে নির্বাচন। এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদকে আবারও জানান দেয়া ও ভিন্নমতের মানুষদের কণ্ঠকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্যই যে এই আয়োজন তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই অত্যাচারের ক্ষেত্র তারা তৈরি করছে অনেকদিন ধরে। জেএনইউর ছাত্রনেতা উমার খালেদ, কানায়া কুমারসহ এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা থেকে এটা  প্রথম ব্যাপকভাবে  আলোচনায় আসে। এবং বিজেপি’র এই কনসেপ্ট বাস্তবায়ন এর পেছনে পুরাপুরি মদদ দিয়েছে, তাদের পোষ্য মিডিয়াগুলো।

মিডিয়া হাউসগুলো মোদি সরকারের বিরিুদ্ধে ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন উত্তোলনকারী প্রায় সকলকে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে হাজির করেছে আর ক্রমাগত এই প্রচারণার ফলে পাবলিক পার্সেপশন কিছুটা হলেও সরকারের পক্ষে আনা গেছে।

তারপরও কবি ভারভারা রাও, ভারতের শীর্ষ মানবাধিকার সংগঠন পিইউসিএল’র প্রধান সুধা ভরদ্বাজ, প্রাবন্ধিক গৌতম নওলাখা, মানবাধিকার কর্মী অরুণ ফেরেরা ও ভেনন গঞ্জালভেজ মতো ব্যক্তিদের আটক এবং গৃহবন্দি রাখা মোদি সরকারের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার ব্যাপারকেই সামনে হাজির করে।

বাংলাদেশে যেমন যে কোন ভিন্নমতকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী বলে নির্মমভাবে দমন করা হয়। ভারতে মোদিও একই কৌশল ব্যাবহার করছেন। উভয়েই ভয়ের সংষ্কৃতি চর্চা করে ক্ষমতা পাকা-পোক্ত করতে মরিয়া। মোদির ভারতে নকশালবাড়ি একটি ঐতিহাসিক নাম। তথাকথিত ভদ্রলোকদের কাছে আতঙ্কও বটে। এই আতঙ্ককে ভারতবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। অথচ ৭০এর দশকের পরে নকশাল আন্দোলন আর তেমন সক্রিয় নাই। কিন্তু এখন ভিন্ন চিন্তার শিক্ষিত বুদ্ধিজিবি, সমাজ কর্মী, কবি-লেখকদের আরবান নকশালিস্ট হিসেবে ডাকছে মোদি সরকার। আর জেলে নিয়ে যাচ্ছে সরকারের সমালোচকদের। একজন পিএইডি ছাত্রী মোদি সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলায় জেলে নেয়া হয়েছে। অনেক প্রতিবাদের পরে অবশ্য জামিন দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে অমিল হল, আদালত ভিন্নতমকে সম্মান জানাতে রাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে। আর বাংলাদেশে আদালত রাষ্ট্রের ভাষায় ও ইশারায় রায় দেয়।

 

মোট কথা বামপন্থীদের সন্ত্রাবাদী আকারে হাজিরের চেষ্টা চলছে। এবং তাদরে অবস্থানের সাথে ভারতীয় দেশপ্রেমের ন্যারেটিভ নিয়ে ইন্টারেস্টিং এক বিতর্ক ভারতে চলমান আছে। অন্যদিকে, হিন্দত্ববাদীরা ইতিহাসবিদরা দেশপ্রেম’র যে ব্যাখ্যা হাজির করছে, আধুনিক শিক্ষিত তরুণেরা সেসব নিয়ে ক্রমাগত তাচ্ছিল্য করে বেড়াচ্ছে। আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, মিডিয়ার মাধ্যমে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যে দেশপ্রেম জনগণকে গেলানোর চেষ্টা করছে সেটা নিয়েও একই তাচ্ছিল্য দেখা যায়। যেমন অক্ষয় কুমারের সাম্প্রতিক একটা সিমেন্ট’র বিজ্ঞাপনের চিত্রায়ণ নিয়ে একজন স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানকে কৌতুক করতে দেখা গেল। যে বিজ্ঞাপনে মূলত সৈনিকের দৃঢ়তার সাথে সিমেন্টের একটা সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। তার মানে আমরা দেখছি এই দেশপ্রেম এখন কেবল উগ্রজাতীয়তাবাদ বিস্তারে নয় এটা পুঁজির উৎস হিসেবে বেশ লাভজনক।

বাংলাদেশে যেমন যে কোন ভিন্নমতকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী বলে নির্মমভাবে দমন করা হয়। ভারতে মোদিও একই কৌশল ব্যাবহার করছেন। উভয়েই ভয়ের সংষ্কৃতি চর্চা করে ক্ষমতা পাকা-পোক্ত করতে মরিয়া। মোদির ভারতে নকশালবাড়ি একটি ঐতিহাসিক নাম। তথাকথিত ভদ্রলোকদের কাছে আতঙ্কও বটে। এই আতঙ্ককে ভারতবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। অথচ ৭০এর দশকের পরে নকশাল আন্দোলন আর তেমন সক্রিয় নাই। কিন্তু এখন ভিন্ন চিন্তার শিক্ষিত বুদ্ধিজিবি, সমাজ কর্মী, কবি-লেখকদের আরবান নকশালিস্ট হিসেবে ডাকছে মোদি সরকার। আর জেলে নিয়ে যাচ্ছে সরকারের সমালোচকদের। একজন পিএইডি ছাত্রী মোদি সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলায় জেলে নেয়া হয়েছে। অনেক প্রতিবাদের পরে অবশ্য জামিন দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে অমিল হল, আদালত ভিন্নতমকে সম্মান জানাতে রাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে। আর বাংলাদেশে আদালত রাষ্ট্রের ভাষায় ও ইশারায় রায় দেয়।

দক্ষিন এশিয়া অঞ্চলের এই দুটি দেশে এই বিকৃত রাজনৈতিক চর্চা ততদিন অব্যাহত থাকবে যতদিন এখানে অশিক্ষিতের হার বিপুল থেকে যাবে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ত্রাস সবচাইতে বেশি ফলপ্রসু বিহার, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যগুলোতে যেখানে নিরক্ষর জনগণের সংখ্যা বেশি।

‘আরবান নকশাল’র নামে গ্রেফতার হওয়া পাঁচ ভারতীয় বুদ্ধিজীবী

মাওবাদী, নকশালবাদীদের ভারতের শাসকশ্রেণি যতই রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করুক তাদের যে দাবি বা বক্তব্য তা থেকে একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে যে, এটা মূলত রাষ্ট্রের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। প্রয়োজনে এই প্রতিরোধে এরা মাওবাদী ট্যাগকে বরণ করে নিবে। অনেক জায়গায় সেই আলামত দেখাও গেছে।

অভয় দেওল অভিনিত একটা মুভি (নাম মনে আসছেনা) যেটা তে দেখা যায় একজন শহুরে শিক্ষিত তরুন মিলিটারির গুপ্তচর হিসেবে নকশালদের সাথে মিশে যায় এবং পরবর্তীতে সে তাদের মতাদর্শের প্রতি এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়ে যে সে তাদেরই একজন হয়ে সেখানে বসবাস শুরু করে তাদের আর্মিতে যোগ দেয়। এমন বিক্ষোভের জন্মের কারণ হিসেবে বোপাল গ্যাসট্র্যাজেডির পর ফ্যাক্টরির মালিককে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার নামে মূলত রাষ্ট্র অপরাধীকে রক্ষা করার যে নগ্ন উদ্যোগ নেয় তাকেই দায়ী করা হয়।

এক কথায় এগুলাকে আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলা যায়। অর্থাৎ যে রাষ্ট্র তার শ্রমিক, নিম্মবিত্ত শ্রেণীর রক্ত-ঘামের বদৌলতে গুটিকয়েক মানুষের কল্যাণে কাজ করে আর তাদের ত্যাগকে থোরাই কেয়ার করে – তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ হতে বাধ্য।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, এখানে যে দেশদ্রোহিতার ধারণা আমদানি করে রাষ্ট্র নিপিড়ণ চালাচ্ছে তা অনেক সাধারণ জনগনের কাছে পরিস্কার না। তাই হয়তো ব্যাপক প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে না। সুতরাং মোদি সরকারের এইসব কাজ চোখ ধাঁধানো, চাতুরী ধীরে ধীরে জনগণের কাছে পরিস্কার হয়ে উঠছে। আমরা বিশ্বাস করি সত্য চিরদিনই মিথ্যা বিনাশকারী। তাই আপাত দৃষ্টিতে ক্ষমতার এই মিথ্যে প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে আমরা কেবল সত্যগুলোকে সামনে তুলে ধরতে পারি। বাকিটা সময় বলবে।