দুটো দলের জার্সিতেই রয়েছে স্ট্রাইপ। একটি আকাশি-সাদা অপরটি বেগুনি-মেরুন। আলাদা দুটি জার্সি গায়ে দেয়া মাত্রই যে পারর্ফম্যান্সটাও আলাদা হয়ে যায় লিও মেসির। বার্সার জার্সি গায়ে যেমন প্রতিপক্ষকে নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন সেখানে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মনে হয়, খেলা ভুলতে বলা এক অসহায় আদমি। একই মানুষের দুটো আলাদা জার্সিতে আলাদা পারফর্ম্যান্স অবাককর বৈকি। আজকে সেদিকটায় একটু আলোকপাত করতে চাই।
জাতীয় দল হিসাবে আর্জেন্টিনা মোটেই ফেলনা না। মেসিকে সঙ্গ দেয়ার জন্য রয়েছে আগুয়েরো, মারিয়া, বানেগদের মতন সঙ্গী। যাদের দলে পেলে বর্তে যাবেন যে কোনো কোচই। তবু, আকাশি-সাদায় মেসি বড্ড ম্রিয়মান। অচেনা একজন যেন। এর পেছনে রয়েছে দলের পেছনের কর্তারা। মেসি দলে থাকলে দলের খেলা মেসিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাফল্য বা ব্যর্থতা যাই ঘটুক না কেন, পুরো দায়টাই যখন মেসির ওপর এসে পরে সেটি হয়ে উঠে অসহনীয়। একই সাথে রয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট এর ক্রমাগত অস্থিরতা। নিত্য নতুন কোচ, নিত্য নতুন ধরন, মেসি কেন, ধরণীর যে কাউকেই দ্বিধায় ফেলতে যথেষ্ট। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মেসিকে এমন একটি পজিশনে খেলানো হয়েছিল যার ফলে ক্রোয়াট ডিফেন্ডাররা না, মেসি নিজেই আটকা পড়ে গিয়েছিলেন দ্বিধার জালে। ফলাফল সকলেরই জানা।
আরো একটি বিষয় যেটি বিষম চাপের হয়ে দাড়ায় সেটি হচ্ছে আর্জেন্টিনা জিতলে মেসির নাম, হারলে মেসির দোষ। অথচ, ফুটবল একটি দলীয় খেলা। অতিমাত্রায় মেসি নির্ভরতা বাকি তারকাদের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। যার ফলে আর্জেন্টিনা কখনোই একটি দল হয়ে উঠতে পারে না। আরো একটি বিষয় আমার কাছে বেশ কৌতুককর মনে হয়। চাপ নিতে মেসির অক্ষমতা নিয়ে বেশ একটি আলোচনা আছে। যে ব্যক্তি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল মাত করতে পারেন, বাঁচা মরার লড়াইয়ে বাছাই পর্বে হ্যাট্রিক করে দলকে নিয়ে যেতে পারেন বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে; তিনি চাপ সামলাতে পারেননা এটিই চরম হাস্যকর মনে হয়।
‘নিস্তব্ধ লন্ঠন
অস্তিত্ব সজাগ করে বারান্দার কোণ
বসে থাকে
‘কোনো দিন পাবে না আমাকে_
কোনোদিনই পাবে না আমাকে
—শক্তি চট্টোপাধ্যায়
অভিমানে একবার তো জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষনাও দিয়েছিলেন। সরল অংকের হিসেবটা কিছুতেই মিলতে চায় না। ক্লাব পর্যায় রেকর্ড যার পায়ে এসে লুটিয়ে পরে তিনি কেনো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে বারবার ব্যর্থ? চলতি মৌসুমটাই দেখুন। দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপের সমাপ্তি হবার পর ক্লাব মৌসুমের শুরুতেই মেসি সেই অদম্য, দুর্দমনীয়। পার্থক্যটা কোথায়?
মেসি মূলত বার্সার আতুর ঘর লা মেসিয়ার প্রোডাক্ট। যার ফলে বার্সার যে সহজাত ঘরানা সেটি তিনি আত্বস্ত করেছেন কৈশরেই। সাথে পেয়েছেন এমন সব সতীর্থদের যারা এ ঘরানায় অভ্যস্ত। যার ফলে নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়াটা চমৎকার। বার্সার মূলে মেসি হলেও বার্সা শুধুই মেসি সর্বস্ব নয়। যার ফলে চাপটাকে একপাশে সরিয়ে খেলাটা তিনি উপভোগ করতে পারেন।
একবার দুবার তো না, বার্সার হয়ে যাদু দেখিয়ে আরাধ্য ব্যালন জিতেছেন পাঁচবার। সে মেসিই ম্রিয়মান হয়ে যায় দেশের জার্সি গায়ে। আর্জেন্টিনার অদ্ভুতরে কোচ সিলেকশন, এবং তার চেয়েও অদ্ভুত কৌশল শুধু মেসিকেই না, বিভ্রান্ত করে দেয় সকলকেই। এবারের বিশ্বকাপেই সাম্পাওলি এমন এক গোল রক্ষকের ওপর আস্থা রাখলেন যার অস্তিত্বেক কথা ফুটবল বিশ্বের কয়জন জানতো সন্দেহ। এমন অবস্থায় বল পায়ে সবুজের গালিচায় ফুল ফোটানো মেসিকে পাওয়া যায় না, পাওয়া সম্ভবও না।
সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে ইউয়েফা বা দ্য বেস্ট কোনো ব্যক্তিগত পুরষ্কারের জন্যই মনোনিত হননি তিনি। বিস্ময়কর এ বিষয়টি বাস্তব হয়ে দেখা দিলেও, যে কোনো বিবেচনাতেই বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। সেটি যে মেসির পছন্দ হয়নি বার্সার জার্সি গায়ে প্রথম তিন ম্যাচেই বুঝিয়ে দিয়েছেন সেটা। আলসাবিলেস্তেদের আক্ষেপ হয়ে থাকলেও বার্সার মেসিই বরং জাদু দেখাতে থাকুন। যে জাদুয় অবশ হয়ে যায় সময়, অলস হয়ে যায় ঘড়ির কাটা। মেসিদের জন্ম যে বারবার হয় না…