ধীরে ধীরে চলে যাবেন কিংবদন্তিরা যুগে যুগে রেখে যাবেন তাদের পথ চলার হাজারো স্মৃতি। তেমনি একজন কিংবদন্তি কফি আনান জিনি গত ১৮ই আগস্ট চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
পরিবারের ভাষ্যমতে, কফি আততা আনান শুক্রবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তার নাম রাখা হয়েছিল কফি আনান। কারণ ঘানার শব্দ নিয়ম অনুযায়ী আকান ভাষায় এই কফি শব্দের অর্থ শুক্রবারে জন্মগ্রহণকারী ছেলে সন্তান। তারা একসাথে জন্মগ্রহণ করা দুই ভাইবোন একজন ছেলে আর একজন মেয়ে হয়ত যমজ সন্তানের মধ্যে কফি আনান ছেলে ছিল বিধায় তার নাম রাখা হয়েছিল কফি আনান আর আততা শব্দের অর্থ যমজ এই নিয়ে তার সম্পূর্ণ নাম হয় কফি আততা আনান।
এই বর্ণবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সৈনিকের ব্যাক্তি ও কর্মজীবনে তাঁর অনুসারীদের জন্য অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা সবার জানা দরকার।
ব্যাক্তিজীবনে কফি আনান
১৯৩৮ সালের ৮ই এপ্রিল ঘানার কুমাসি শহরে জন্ম নেন মহান এই নেতা। ১৯৫৪ সালের ঘানার মফানসিপিম স্কুলে পড়াশোনা করেন। ব্যাক্তিজীবনে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী কফি আনান স্কুলের গণ্ডি পার হন ১৯৫৭ সালে। ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন।
কর্মজীবন
কর্মে পরিশ্রমী ও ধৈর্য্যশীল এই নেতা তার কর্ম জীবন শুরু করেন ১৯৬২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় বাজেট কর্মকর্তা হিসেবে। ১৯৭৪ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ছেড়ে তিনি যোগ দেন ঘানার পর্যটন উন্নয়ন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন সহকারি মহাসচিব হিসেবে জাতিসংঘের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা সমন্নয়ক এবং জাতিসংঘের কর্মসূচি পরিকল্পনা, বাজেট ও অর্থায়ন এবং কন্ট্রোলারের দায়িত্বে। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কফি আনান দায়িত্ব পালন করেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের সহকারি মহাসচিব হিসেবে। ১৯৯৬ সালে তিনি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্তেটারি জেনারেলেরও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে কফি আনান জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘে কর্মরত কোন ব্যাক্তি হিসেবে কফি আনানই এই সংস্থায় সর্বোচ্চ পদ মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।.২০০৮ সালের ১১ই আগস্ট তাকে ইউনিভার্সিটি অব ঘানার আচার্য করা হয়।
২০১২ সালে সিরিয়া সংকট সমাধানের জন্য জাতিসংঘ ও আরব লীগ কফি আনানকে দূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। সিরিয়ার সংকট সমাধানে তাঁর উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়, যদিও পরে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত না হওয়ায় তিনি নিজেকে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কফি আনান আকান, ফরাসি, ইংরেজিসহ আফ্রিকার কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
বৈবাহিক জীবন
১৯৬৫ সালে কফি আনান নাইজেরিয়ার টিটি আলিকিজাকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে তার প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর ন্যানে মারিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
সাফল্য ও স্বীকৃতি
কর্মজীবনে কফি আনান নানা ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছেন আর এই অর্জনের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে দেয়া হয়েছে বহু পুরস্কার।তিনি ছিলেন বিচক্ষণ এবং অপূর্ব ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী। তিনি তার কাজগুলকে গুছিয়ে করতে পছন্দ করতেন। তিনি সময়কে গুরুত্ব দিতেন বেশি। তিনি ছিলেন খুবই গোছালো একজন মানুষ। আর তার এই কর্মচাঞ্চল্য এবং কঠোর পরিশ্রম তার জীবনে এনে দিয়েছে দুনিয়ার বড় বড় পুরস্কার। ২০১১ সালে কফি আনান ও জাতিসংঘ যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। শান্তির দূত হিসেবে এবং শান্তির সংস্কৃতি চালুর বিষয়ে কফি আনান সদা সচেষ্ট ছিলেন।
বন্ধুত্বপরায়ণ কফি আনান
খুবই সাধারণ ছিলেন ব্যাক্তি জীবনে এই জনপ্রিয় মানুষটি। সরলতা পছন্দ করতেন তিনি। বলতেন, সাদামাটা জীবনযাপন করলে অনায়াসে খুব অল্প সময়ে সব জায়গায় নিজেকে সহজে মানিয়ে নেওয়া যায়। বন্ধুত্ত্বপরায়ণ বলি আর মানুষের জন্য ভালবাসা যাই বলি না কেন দুটি শব্দই মানিয়ে যায় এই কিংবদন্তির সাথে। সহকর্মীদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন কফি আনান। অন্তত কয়েকশ সহকর্মীর নাম তিনি অনায়াসেই মনে রাখতে পারতেন এবং তিনি তাদের নাম ধরে ডাকতেনও।
অবলীলায় তিনি জাতিসংঘের লিফটম্যান থেকে শুরু করে উচ্চ পদের মানুষের সাথে একই টেবিলে বসে চা পান করতেন এবং বই পড়তেন। সহকর্মীসহ আশপাশের মানুষ জনের খোঁজখবর নিতে পছন্দ করতেন। তার সহকর্মীদের মতে তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন আনন্দদায়ক বিষয়ে নিয়ে অট্টহাসি দিতেন। এই নিরহংকারী মানুষটি ছোট মহল থেকে শুরু করে বড় মহল পর্যন্ত সবার সাথেই গল্পগুজব করতে পছন্দ করতেন। এমনও দেখা গেছে কোন গুরুত্বপূর্ণ সভায় তার বক্তব্য প্রদানকালে যদি তার পরিচিত মানুষের সাথে তার দেখা হয় তিনি তার খোঁজখবর নিয়ে পুনরায় সভায় বক্তব্য দিতেন। তিনি এই সমস্ত ব্যাপারকে খুব সাধারণ ভাবেই দেখতেন।
কফি আনান ফাউনডেশন
কফি আনানকে বিশ্বের দারিদ্র এবং মানুষের অসহায় অবস্থা খুব ভাবাতো। তাই তিনি এই দুরবস্থার মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য গড়ে তোলেন একটি প্রতিষ্ঠান। ২০০৭ সালে তিনি বিশ্বে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য গড়ে তোলেন কফি আনান ফাউন্ডেশন। তাছাড়াও মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় বিষয়ে কফি আনানকে প্রধান করে ২০১৬ সালের আগস্টে দ্য অ্যাডভাইজরি কমিশন অব রাখাইন স্টেট নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়। এটি মিয়ানমারের সরকার ও কফি আনান ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছিল।
বাংলাদেশ ও কফি আনান
একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে উন্নয়নশীল দেশের পথে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলার বিষয়টি কফি আনানের নজরে পড়েছিল। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশের ওপর কফি আনানের দৃষ্টি ছিল বেশ আগে থেকেই। অবশেষে ২০০১ সালের মার্চে ঢাকায় আসেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাথে নিয়ে তিনি সেগুনবাগিচায় আন্তজাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের প্রতিটি উদ্যোগের প্রতি সমর্থন ছিল কফি আনানের.১৯৯৯ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের যোগদানের রজতজয়ন্তী পালন করেন তিনি।
কফি আনানের জীবনাবসান
গত ১৮ আগস্ট ২০১৮ এই মহান সংগঠক চলে যান না ফেরার দেশে। কিংবদন্তি এই ব্যাক্তিটি তার সরল জীবন যাপন ও শান্তির দূত হিসেবে আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন যতদিন এই পৃথিবী থাকবে। সুইজারল্যান্ডের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। আগামী.১৩ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে।
হাজার শ্রদ্ধা ও সালামের মধ্যে আমরা চিরবিদায় দিব শান্তির দূত এই কিংবদন্তিকে। বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে তাঁর কর্মের মধ্যে দিয়ে।