গত মৌসুমের পুরোটা তো বটেই এ মৌসুমের শুরুতেই মাদ্রিদ সমর্থকদের মনে খায়েশ ছিল বেনজেমার বদলে মুখতালিফ গড়ে দিতে পারে এমন একজন আদমির। বিশেষ করে রোনাদলোর আকস্মিক দল বদলের ঘোষণার পর এই দাবি আরো জোরালো হয়। পুরো ট্রান্সফার উইন্ডোতে অলস সময় কাটানো পেরেজ এবং কর্তৃত্বের আসনে বসা নব্য কর্তা লোপেতিগে সেসবে সামান্য কর্ণপাতও করেননি।
সন্দেহ নেই বিগত সিজনে বিগ বেনজুর ব্যর্থতার ধারাবাহিক স্মৃতি এখনো টাটকা থাকার পরেও এমন সিদ্ধান্ত হতাশ করেছে সমর্থকদের। আস্থার সাওয়ালে সন্দিহানদের জওয়াব দেয়ার জন্য একমাত্র মোক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বেনজেমা। চলতি মৌসুমের শুরুর তিন ম্যাচেই নাজাকাতের সাথে যে নৈপুণ্য তিনি দেখিয়েছেন, সে ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে তাহলে সমালোচকরা কোন ঢাল ব্যবহার করে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন, সেটিই হবে দেখার বিষয়।
গত মৌসুমেও যিনি ফাকা বার মিস করে মাঠের মাঝেই ফাঁক ফোকর খুঁজে ফিরছিলেন চেহারা লুকোবার জন্য, তিনিই আচমকা কোন যাদুবলে অসামান্য ফিনিশিংয়ে লেগানেসকে ফানা করলেন সেটি নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি কি অাদৌ বিস্ময়কর? যারা লিওঁ অথবা ব্লাঙ্কোসদের হয়ে বেনজমার শুরুটা দেখেছেন তাদের কাছে এটি বিস্ময়কর কিছুই নয়। বিপত্তিটা রন রাজত্ব শুরু হবার পরে বেনজেমার ভূমিকা বদল হয়ে যাবার পর থেকেই শুরু।
বিষয়টা প্রথমেই পরিষ্কার করা দরকার যে বেনজেমা বিহীন রোনালদো বিকল কিংবা রোনালদোর জন্য নিঃস্বার্থভাবে বেনজেমা নিজের ক্যারিয়ার কুরবানি দিয়েছেন, বিষয়টি তেমন নয়। আবার বেনজেমা দলের স্বার্থে যে ত্যাগটি করেছেন সেটি ভিন্ন তর্ক। আমার আগ্রহের বিষয়টি হল, রোনালদোর সাথে অদ্ভুৎ রকমের এক রাবতা থাকার পরেও বিগ বেনজু কেন কিছুতেই বার খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেটি।
শুরুতেই যেটি পরিষ্কার করা হয়েছে সেটি হল বেনজেমা তথাকথিত ফলস নাইন না। তিনি বরং মূল স্ট্রাইকার রুপেই নজর কেড়েছেন। কিন্তু আপনার দলে যদি রোনালদোর মত একজন খেলোয়াড় থাকে তাহলে আপনি মূল নাইন যেই হোক, তাকে সরিয়ে রোনালদোকে কেন্দ্র করেই দল সাজাবেন মুখতালিফ গড়ে দিতে রনের ক্ষমতা বিবেচনায়। সে ক্ষেত্রে রোনালদো যেন প্রয়োজনীয় পথ পরিষ্কার পায়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য একজনের প্রয়োজন ছিল, এবং সে প্রয়োজনটিই মিটিয়েছেন বেনজেমা।
একজন পিওর স্ট্রাইকারের জন্য ফলস নাইন খুব একটা স্বস্তিদায়ক কিছু না। এটার নতুন ধারা আয়ত্বে আনতে বেনজেমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কখনো তো ডিপ মিডে নেমেও আক্রমণ রচনায় ভূমিকা রাখতে দেখা গিয়েছে তাকে। এমন অবস্থায় গোল সংখ্যা যে স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর অনেক সময়ই নিশ্চিত সুযোগ কাজে লাগানোর তাবদির খুঁজে না পেয়ে আত্মবিশ্বাসই নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছিলেন তলানিতে। যার ফলে সমালোচনাটা এক অর্থে স্বাভাবিকই ছিল। অস্বাভাবিক যেটি ছিল সেটি হচ্ছে জার্সির নাম্বারের সাথে মিল রেখে বেনজেমাকে পিওর নাইন ঠাওরে তার পিন্ডি চটকানো।
লোপোতিগের বেলায় যেটা হচ্ছে, বার্নাব্যুতে পা রাখার আগেই তিনি হারিয়েছেন রোনালদোকে। যার ফলে আক্রমণভাগটাকে পুরোই নতুন করে সাজাতে হয়েছে এই স্প্যানিশ কোচকে। আর এখানেই বেড়েছে বেনজেমার গুরুত্ব। নতুন কোনো সাইনিং না করানোয় আক্রমণভাগের দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে বেনজেমা-বেল-অ্যাসেন্সিওর ওপর। আর বেনজেমা ফিরে পেয়েছেন নিজের পছন্দের পজিশন। যার ফলে, খেলার ধাঁচেই শুধু না, শরীর ঠিকরেও বের হচ্ছে হারানো আত্মবিশ্বাস। পিওর নাম্বার নাইনের জন্য যারা এতদিন গলা ফাটিয়েছেন তাদের গলা ফাটা বাঁশের মত ফ্যাসফ্যাসে করে দেয়ার কাজটি অসাধারণ ভাবেই করছেন এই মাদ্রিদ অন্তঃপ্রাণ স্ট্রাইকার।
তবে এইখানে একটি বিষয় বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে। তিন ম্যাচ শেষে বেনজেমায় বুদ হয়ে যারা ইতোমধ্যেই রোনালদোর সাথে তুলনায় ব্রতী হচ্ছেন তাদের ফুটবল বোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। মেসুত, মারিয়া মাদ্রিদ ছাড়ার পরেও অনেকে রোনালদোর সম্ভাব্য গোলখরা নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। সেটি যে অসাঢ় প্রমাণিত হয়েছে তা তো ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়। য়্যুভেন্তাসের জার্সিতে যুবরাজের গোলখরার পেছনে বেনজুর অনুপস্থিতিকে যারা হেতুরুপে হাজির করছেন সেটি হাস্যকর। কারণ, তুড়িনে রনকে সাহায্য করার মত ডিবালা-কস্তাদের মতো তারকা রয়েছেন। এখন যেটুকু সময় লাগছে তা মূলত দলের সাথে মানিয়ে নেয়া এবং রক্ষণাত্বক ইতালিয়ান ফুটবলের সাথে অভ্যস্ততার অভাবে।
তুলনা বরাবরই সংবাদ বিকোনোর একটি ভালো মাধ্যম। তর্কের জন্যও এটি আদর্শ। তবে, সেটি যদি শুধুমাত্র তুলনার নিমিত্তেই করা হয় তাহলে বিষয়টি হয়ে ওঠে হাস্যকর। বেনজেমার আগুন ফর্ম রিয়ালের জন্য নিঃসন্দেহে আশির্বাদ। তবে সেটিকে বড় করে দেখাতে গিয়ে অনাবশ্যকভাবে রোনালদোকে টেনে এনে পুরো বিষয়টিকেই হাস্যকর করে তোলা হচ্ছে।