নারীদের শোভা বর্ধনে গহনার কোন জুড়ি নেই নারীর রুপের আরেক চমক হল গহনা। এই গহনার কদর সব ছেয়ে বেশি নারীদের কাছে। সোনার কদর নারীর কাছে অনেক আর এই আকাশ চোয়া দামের কারণে তারা এখন জুগছে এমিটেশন গহনার দিকে। আর এই ইমিটেশন গহনার সিংহভাগ আসে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর আর বেড়িবাঁধ এলাকার ঠিক উল্টো দিকেই তুরাগ নদী পেরিয়ে জনপদ ভাকুর্তা থেকে। সাভার উপজেলার এই ইউনিয়নে রয়েছে ৩৬টি গ্রাম। এসব গ্রামের সর্বত্র গহনা তৈরির দৃশ্য চোখে পড়বে।
ভাকুর্তায় গিয়ে দেখা যাবে, বেশিরভাগ বাড়ির বারান্দায় আগুনের ফুলকি উঁকি দিচ্ছে। পুরো গ্রামে এ কর্মযজ্ঞ চলে। গ্রামের নামেই গড়ে উঠেছে বাজার। সারি সারি গহনার দোকান। সব দোকানে একই রকমের জিনিস। গহনা তৈরিতে যত কাঁচামালের প্রয়োজন সবই সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। গহনা তৈরির কাঁচামাল বিক্রির দোকানের মালিক ও কারিগর দুলাল চন্দ্র রাজবংশী। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ রাজবংশী। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিন প্রজন্ম ধরে তারা এই কাজ করছেন। গ্রামের প্রায় সবার পেশা গহনা গড়া। বাজারের সকল ঘরই সাজানো-গোছানো। দোকানের বলের মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেক ডিজাইনের গহনা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। রঙ, আকার ও প্রকারভেদে এগুলো রাখা আছে।
ভাকুর্তার কারিগরদের ইতিহাস অনেক পুরনো। প্রায় ৩০০ বছর ধরে ভাকুর্তার জনপদ গহনা তৈরি করে আসছে। বাংলার নবাবী আমলের শেষ দিকে ও ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে অনেক কারিগরই প্রাণভয়ে কলকাতা থেকে বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। এরপর বেশখানিকটা সময় পার হয়। একটা সময় ব্রিটিশ শাসনও শেষ হয়। বাংলাদেশের উৎপত্তি হয়। ১৯৮০ সালের দিকে কারিগররা স্থায়ীভাবেই তাঁতীবাজারে অলংকার তৈরির কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৯০ সালের দিকে স্বর্ণের চাহিদা পড়ে যাওয়ায় লোকসানে পড়তে হয় তাদের। অতঃপর রূপা দিয়েই চলতে থাকে কাজ। কিন্তু বিধিবাম। ২০১০ সালের দিকে রূপার ব্যবসায়ও ভাটা পড়লে বাধ্য হয়েই কপার ধাতু দিয়ে অলংকার তৈরি শুরু করেন। কেননা এই একটি কাজেই তারা পারদর্শী। উপরন্তু কপার সহজলভ্য ও স্বল্পমূল্য়েই কেনা যায়। গহনা তৈরির বেশকিছু কাঁচামাল ভারত থেকে আসে। এছাড়া ভাকুর্তা গ্রাম থেকে চুড়ির বেস, তাঁতিবাজার ও বাবুবাজার থেকে ছোট ছোট কাঁচামাল এনে গ্রাহকের মনমতো নকশা বানিয়ে স্বর্ণ বা রূপার রঙে গড়িয়ে নিলেই কাজ শেষ। ভাকুর্তার দোকানগুলোতে দেখা মেলে অনেক ধরনের গহনা। গলার হার, নাকের নোলক, মুকুট, চুড়ি-বালা, শিতাহার, আংটি, পায়ের নূপুর কি নেই এই ভাকুর্তা বাজারে। দাম কম হওয়াতে এইসব অলংকারের চাহিদাও দিন দিন বেড়েই চলছে।
এক সময় চিকন পাইপ দিয়ে ফুঁ দিয়ে দিয়ে গহনা তৈরির কাজ করা হতো। এখন শুরু হয়েছে গ্যাস দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে কাজ।
এছাড়াও বাংলাদেশের কিছু জায়গায় এই ইমিটেশন গহনা বানান হয়। এর মধ্যে বগুড়া, নওগাঁ, খুলনা এসব জায়গাতে শুধু চুড়ি তৈরি হয়। এসব জায়গার মাল ভাকুর্তাতে প্রথম আসে এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায়। শুধু ভাকুর্তাতেই তৈরি হয় সারা দেশের চাহিদার ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ইমিটেশন গহনা। এখান থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ী-দোকানিরা আসেন গহনা কিনতে। দোকানিরা ক্রেতার সাধারণের চাহিদার কথা মাথায় রেখে গহনার কাঠামো এখান থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কালার পাথর বসায় নিজেদের মতো করে ডিজাইন করিয়ে নেন।
রূপার মূল্য বৃদ্ধির আর সোনার আকাশছোঁয়া দামের কারণে অনেকের পক্ষে সোনার গহনা কেনা সাধ্যের বাইরে। তাই তামা-পিতলের গহনাই এখন সম্বল। সিটি গোল্ড নামে পরিচয়। সোনা ও রূপার উচ্চমূল্যের বাজারে তামা, দস্তা, পিতলই ভরসা। মার্কেটে আজকাল সিটি গোল্ড নামে এসব গহনা বিক্রি হয়। সাধারণ একটি অপরিশোধিত তামার গহনার দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, যা জিংকে ধুয়ে পরিশোধিত হয়ে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি করা যায়। ডিজাইন অনুযায়ী দাম কম-বেশি হয়। ভাকুর্তার কারখানা থেকে একটি ভালো ডিজাইনের এক সেট গহনা কিনতে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা, শপিং মলে সেটা বিক্রি হয় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায়। কারখানা থেকে এক জোড়া কানের দুল কেনা যায় ৩০ থেকে ৪০ টাকায়, বিক্রি করা যায় ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। সিতাহার কেনা যায় ৮০০ টাকায়, বিক্রি করা যায় ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকায়। হাতের বালা এক জোড়া কিনতে লাগবে ৮০ টাকা, বিক্রি করা হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়।
ভাকুর্তা বাজারের গহনার কারিগর অখিল সরকার জানান, এক সময় আমরা রূপার গহনা তৈরি করতাম। দাম বাড়ায় এর বিক্রি কমে যেতে শুরু করে। তাই এখন তামা আর পিতল বেশি ব্যবহার করি। ঢাকার চাঁদনীচক, নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেটসহ প্রায় সব মার্কেট ও শপিংমলে ভাকুর্তার গহনা যায়।
ভাকুর্তার কারখানাগুলোতে হাজারো নকশার গহনা পাওয়া যায়। চাইলে নিজের পছন্দমতো ডিজাইন দিয়েও তৈরি করানো যায়। যে সব গহনা বেশি বিক্রি হয় তার মধ্যে নেকলেস, সিতাহার, গলার চেইন, কানের দুল, ঝুমকা, হাতের বালা, চুলের ব্যান্ড, ক্লিপ ও আংটি অন্যতম।
ভাকুর্তায় প্রায় সাত হাজার নারী-পুরুষ রূপার অলঙ্কার তৈরি করেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে কারিগররা অর্ডার নিয়ে আসেন। অর্ডার অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা পৌঁছে দেন অলঙ্কার। তার পূর্বসূরীরা রূপার অলঙ্কার তৈরির কাজ করতেন। তারা বংশপরম্পরায় এই পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
পাঁচ শতাধিক দোকান রয়েছে শুধু ভাকুর্তা বাজারে এছাড়া প্রতিটি বাড়িতে মহিলারা কাজ করেন। তবে কাজ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। জানা গেছে, অনেকে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেমন লাভ হচ্ছে না দেখে। সংসার চলে না তাই অনেকে কাজ ছেড়ে ইজিবাইক কিনেছেন অনেকে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশ।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে চোরাইপথে অনেক গহনা আসে এবং সেগুলো অনেক কম দামে বাজারে পাওয়া যায়। কাঁচামালের বেশি আসে ভারত থেকে। ঈদ, পূজা-পার্বণে বিক্রি তেমন না হলেও শীতের সময় একটু বেচাকেনা ভাল হয় বলে জানালেন কারিগর নিত্য রাজ।
গহনা ও কাঁচামাল বিক্রেতা আব্দুল মালেক বলেন, বর্তমানে ৫০ শতাংশ মাল ভারত থেকে আসে কাঁচামালেও ওপর ট্যাক্স বাড়ার কারণে। এ কারণে আগের মত লাভ হচ্ছে না। বেতন কম দেখে কারিগররাও কাজ করতে চাইছে না।
এইসব আক্ষেপের পরও ব্যবসায়ীদের মনে রয়েছে কিছু ক্ষোভ। ভাকুর্তার যোগাযোগ দুরাবস্থা বর্ণনাতীত। নেই কোন ভালো পাকা রাস্তা, যাতায়াতের পথগুলো খানাখন্দে ভরা। মাটির রাস্তাগুলো অল্প বৃষ্টিতেই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীদের মতে যোগাযোগের দুরাবস্থার কারণে ভাকুর্তা অনেকটাই ঢাকার মূল শহর থেকে বিচ্ছিন্ন। আবার দেশের বাইরে তাদের গহনা রপ্তানি হলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ভাকুর্তার গহনার বাজার আন্তর্জাতিক ভাবে পাচ্ছে না বিশেষ পরিচিতি।
এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারে এর প্রসারে সরকারি সহায়তামূলক উদ্যোগ নেয়া দরকার। এর মধ্যে কাঁচামালের ওপর আমদানি শুল্ক কমানোটা সবচাইতে জরুরি। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল যেন উদ্যোগী হয় এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।