বাংলাদেশে গুম

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস

বাংলাদেশে গুম

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসটা অন্য কোন দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ না হলেও বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর যদি পরিসংখ্যান সামনে আনা হয়, তাহলে এই গুমের গুরুত্ব এতটাই ভয়াবহ হবে যে- মনে হবে আপনিই রয়েছেন গুমের ঝুঁকিতে।এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসেব মতে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৪৩২ জন গুমের শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে ২৫০ জনের খোঁজ মিলেছে। বাকিরা উধাও। এমনকি তারা কোথায় আছে, কারা গুম করেছে সেরকম কোন দায় স্বীকারের ঘটনাও ঘটেনি।

বাংলাদেশে গুমের ব্যাপারটা অন্যরকম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, র‌্যাব, ডিবি ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করা হয়। আর যে কারণে জিডিও করা সম্ভব হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বরাবর গুমের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে তারাই যে গুমের সাথে যুক্ত তার প্রমানেও মিলেছে।‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতাও প্রশ্নবিদ্ধ।যদিও বিভিন্ন সময় তারা মিডিয়ার সামনে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন বলে বিবৃতি দিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশে ঘটা আলোচিত ‘গুম’গুলো হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।দেখা গেছে, দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের গুম হওয়ার বিষয়টি বেশি ছিল। ২০১০ সালে বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সাবেক ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কাউন্সিলর চৌধুরী আলম গুম হন। পরের বছরগুলোতেও রাজনৈতিক নেতাদের গুম হওয়ার বিষয়টি চলমান থাকে। ২০১২ সালে গুম হন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী। রাজধানীর রুপসী বাংলা হোটেলের সামনে থেকে নিখোঁজ হয় ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ির ড্রাইভার। তাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে তার সমর্থকেরা রাস্তায় নেমে আসলে পুলিশকে বাধ্য হয়ে খোঁজখুঁজি করতে হয়। কিছুদিন যাবার পর কোন সর্বশেষ তথ্য না দিয়েই অনুসন্ধান বন্ধ করে দেয় তারা। রাজনৈতিক হট্টগোল আর গুমের ভয়াবহ গতিতে, একসময় সামনেই আসতে পারেনি গোলাম আযমের ছেলে ও মীর কাশিম আলীর ছেলের গুমের ঘটনা।

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের গ্রেফতার শুরু হয়। সে সময় দলটির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছিলেন তখনকার যুগ্ম মহাসচিব এবং সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমেদ।গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনেও ছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ১০ মার্চ তাকে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’ পরিচয়ে তুলে নেয় একদল অস্ত্রধারী। ২০১৫ সালে তাকে পাওয়া যায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যে চোখ বাঁধা অবস্থায়।

রাষ্ট্রীয় গুমের তালিকা শুধু রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই তালিকায় রয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবীরাও। কোটা আন্দোলনের সময়ও আন্দোলনের নেতাদের সাথে গুমের ঘটনা ঘটেছে। অনেককে গুম করে, গোপন করতে না পেরে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।যদি গুম করার ইচ্ছেই না থাকে তবে হেলমেট পরিয়ে গ্রেফতারের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।

গুম দিবসের আগের দিনও ঘটেছে গুমের ঘটনা।গুম হয়েছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং প্রকাশক ওয়াসিম ইফতেখার। গতকাল ২৯ আগস্ট ভোরে তাকে রাজধানীর উত্তরা থেকে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’র পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন পর্যন্ত কোথাও কোন গ্রেফতার দেখানো হয়নি মেলেনি সন্ধান।

‘গুম’ কখনো কখেনো হত্যার চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে। গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার পরিজনদের মধ্যে মারাত্মক মানসিক চাপ কাজ করে। তারা বুঝতে পারেন যে, গুম হওয়া ব্যক্তি জীবিত আছেন না মৃত। নতুন করে বেঁচে থাকার তাগিদের মধ্যে মনিস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে। অনেকে বছরের পর বছর প্রিয়জনের আশায় কাটিয়ে দেয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় অবহেলায় খোঁজও মেলে না কারো কারো।

নিখোঁজ হওয়া মানুষদের স্মরণে এবং গুমের বিরুদ্ধে সচেতনতা গেড়ে তুলতেই দিবসটি পালনের ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। ২০১১ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। কিন্তু যেখানে গুম করা হয় ক্ষমতার আধিপত্য প্রকাশে, গুম করা হয় বাক-স্বাধীনতা রোধ করতে, গুম করা হয় রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে আর এর সাথে যুক্ত থাকে এর নিয়ন্ত্রকরা; তখন সচেতনতা কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।