তিনি ছিলেন স্বঘোষিত স্পেশাল ওয়ান। সময়ের পরিক্রমায় প্রবল প্রতাপশালী সে স্পেশাল ওয়ান এখন দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্টুপিড ওয়ান ঘোষিত হবার দারপ্রান্তে। ‘থিয়েটার অফ ড্রিম’ খ্যাত ওল্ড ট্রাফোর্ডে মোরিনহোর ইউনাইটেডকে নাইটমেয়ার উপহার দিয়েছে স্পার্সরা। বিদায়ের গুঞ্জনতো আগেই ছিল, যেটুকু সম্ভাবনা ছিল মোরিনহো ম্যাজিকের কালকের ম্যাচের পর সেটিও বোধহয় মিইয়ে গেল।
নিজ থেকেই নিজেকে স্পেশাল ওয়ান আখ্যা দেয়া ছিল মোরিনহোর দাম্ভিকতার একটি অনন্য নজির। বহুদিন সেটি নিয়ে প্রশ্নও ওঠেনি। বলা যায়, উঠার সুযোগ দেননি মোরিনহো নিজেই। পোর্তো থেকে ইন্টার, যেখানেই গিয়েছেন সাফল্যকে আলিঙ্গন করেছেন সহাস্যে। দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, আলাদা চারটি দেশে লিগ শিরোপা জয়, মোরিনহো মানেই যেন ছিল ম্যাজিক। কিন্তু বহু প্রত্যাশা নিয়ে বার্নাব্যুতে যাবার পর থেকেই যেন উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করলো ঘড়ির কাটা।
বার্নাব্যুতে যে মোরিনহো একদমই ব্যর্থ ছিলেন সেটি বলার সুযোগ নেই। লা দেসিমা এনে দিতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু রিয়ালকে এনে দিয়েছিলেন আকাঙ্খিত লিগ শিরোপা। ফাটল ধরিয়েছিলেন বার্সার একাধিপত্যেরও। এটুকু যদি সাফল্য হয়, তাহলে বাকিটুকু শুধু বিতর্কের ইতিহাস। চড়া মূল্যে কেনা এক সময়ের বিশ্বসেরা কাকাকে ক্রমাগত অবহেলা, শেষ দিকে ইকারের সাথে দ্বন্দে জড়িয়ে বার্নাব্যু ত্যাগ। মোরিনহো এখনো অনেক রিয়াল সমর্থকের কাছেই এক অপ্রিয় নাম। বিশেষ করে, কাকার ক্যারিয়ারের অকাল পরিণতির জন্য এখনো অনেকেই দায়ী করে থাকেন মোরিনহোকে। কিন্তু স্বভাসুলভ ভঙ্গিতেই সে সব সমালোচনার তির্যক জওয়াব দিয়েছেন তিনি।
মোরিনহোর পতনের পিছনের কারণ যদি খুব মনোযোগের সাথে দেখা হয়, তাহলে প্রথমেই আসবে তার একগুয়েমি। এক্ষেত্রে চলতি মৌসুমটি একটি আদর্শ উদাহারণ হতে পারে। ইংলিশ এবং স্প্যানিশ লিগে অন্যতম শীর্ষ দুই দল, চেলসি এবং রিয়াল; যে দুটি দলের দায়িত্ব তিনি আগে সামলেছেন, তারা মৌসুমটি শুরু করেছে দুজন নতুন ম্যানেজারের অধীনে। আক্রমণাত্বক ফুটবলের জন্য পরিচিত সারি নাপোলিতে যে ধাঁচের ফুটবল খেলিয়েছিলেন দলকে সেটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সারিগোল নামে। চেলসিতেও সে ধারা থাকবে কি না, এমন সাওয়ালের জওয়াবে তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন নাপোলির ধাঁচ তিনি নাপোলিতেই রেখে এসেছেন। চেলসিকে খেলাবেন সেভাবেই যেটি চেলসির বর্তমান স্কোয়াডের সাথে মানানসই। রিয়ালের কোচ লাপোতেগুই রোনালদোকে হারানোর ফলে বিকল্প পন্থায় এগুচ্ছেন। এখন পর্যন্ত দুজনই ভালো শুরু করেছেন বলেই বলা যায়।
এখানে মোরিনহোর একগুয়েমিটা কোথায়? মোরিনহো মূলত পরিচিত তার ট্যাক্টিস পার্ক দ্য বাসের জন্য। চূড়ান্ত রক্ষণাত্বক ধারার এই ট্যাক্টিস প্রয়োগ করে তিনি পূর্বে যে সাফল্য পেয়েছেন ইতিহাসই তার সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু যে দলের হয়ে তিনি এটি করে সাফল্য পেয়েছেন এবং পরবর্তিতে যে দলের দায়িত্ব নিয়ে এটি পুনরায় প্রয়োগের চেষ্টা চালিয়েছেন, তাদের স্কোয়াড, ইতিহাস সবই ভিন্ন। সেটি বিবেচনায় এনেও মোরিনহো নিজের ধরণ বদলাননি।
ইউনাইটেডের বর্তমান যে স্কোয়াডটি সেটির আক্রমণ এবং মধ্যমাঠে অসাধারণ কিছু খেলোয়াড় রয়েছে। সানচেজ, মাতা, পগবা, মার্শিয়াল, লুকাকু যে কোনো কোচের জন্যই চমৎকার কিছু নাম। এসব খেলোয়াড় থাকার পরেও মোরিনহো তার রক্ষণাত্বক নীতি থেকে সরেননি। ক্লাব হিসাবে ইউনাইটেডের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। সব সময় আক্রমণাত্বক ফুটবল উপহার দেয়া ইউনাইটেডের সমর্থকদের জন্যও বিষয়টি নেতিবাচক। যার ফলে ক্লাব সমর্থকরাও তার পাশে নেই।
তার এই খেলার ধরণের সমালোচনা করে মোরিনহোর রোষানলে পড়েছেন দলের সবচেয়ে বড় তারকা পগবা। সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে মার্শিয়ালসহ আরো বেশ কিছু তারকার সাথেও। যার প্রভাব ফলাফলেই স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে মোরিনহোর একমাত্র রক্ষাকবচ হতে পারত ক্লাব ম্যানেজমেন্ট। প্রাক মৌসুম পর্ব থেকে সে সম্পর্কও এসে ঠেকেছে তলানীতে। মোরিনহো মানেই এখন ব্যর্থতা, অভিযোগ আর অনুযোগের গল্প।
একই সাথে নতুন করে উঠে আসছে প্রতিভা চিনতে না পারার ব্যর্থতাও। চেলসিতে মোরিনহোর আমলে ব্রাত্য ডি ব্রুইনি, সালাহরা এখন প্রিমিয়ার লিগ কাঁপাচ্ছেন সিটি লিভারপুলের হয়ে। বয়স বিবেচনায় পগবা, মার্শিয়ালরাও তরুণ। মোরিনহো প্রতিভার কদর করতে জানেন না, নাকি তরুণদের সাথে মিশতে পারেন না সেটিও আলোচনায় উঠে এসেছে ইতোমধ্যে।
অথচ অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, অর্জন; সব দিক বিবেচনায় ইউনাইটেডে স্যার ফার্গুসনের যোগ্য উত্তরসুরী হতে পারতেন মোরিনহো। নিজের একগুয়েমি, জেদ, এবং একরোখা ব্যাক্তিত্ব সে সম্ভাবনা শুধু নষ্টই করছে না, পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে স্টুপিড ওয়ান তকমা সাটানোর। কেবলই মৌসুম শুরু হওয়ায় ইউনাইটেড ম্যানেজমেন্ট হয়তো আরো কিছুটা সময় তাকে দিবে। কিন্তু এই মোরিনহো সেই সময় কাজে লাগিয়ে ম্যাজিক দেখাতে পারবেন এমনটি বিশ্বাস করার মত কেউই বোধহয় নেই এখন আর।