ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য মুক্ত আফ্রিকা

কফি আনান’র লেখা

ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য মুক্ত আফ্রিকা

গত ১৮ আগস্ট ২০১৮ জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব নোবেলবিজয়ী কফি আনান মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিলো ৮০ বছর। ঘানার এই কূটনীতিবিদ ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এবং দুই মেয়াদে সার্থকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। কফি আনান ‘কফি আনান ফাউন্ডেশন’র চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আফ্রিকার উন্নয়ন ও দারিদ্রমুক্তির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা কফি আনান ‘অ্যালায়েন্স ফর এ গ্রিন রেভ্যুলেশন ইন আফ্রিকা’র সম্মানিত সভাপতি হিসেবে আফ্রিকার ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্তির জন্য নেয়া পদক্ষেপগুলোর উপর ভিত্তি করে ‘বিল্ডিং অ্যান আফ্রিকা ফ্রি ফ্রম হাঙ্গার অ্যান্ড প্রোভার্টি’ শিরোনামে নিবন্ধ রচনা করেন। যা ২০১৭ সালের ০৭ অক্টোবর কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা’র মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়। এখানে জবানের পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন তুহিন মোহাম্মদ।


আফ্রিকা একটি নিরব বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। এই বিপ্লব দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সচল রাখার প্রকৃত প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই বৈপ্লবিক রূপান্তর তেল এবং গ্যাস, খনিজ কিংবা পর্যটন খাতে নয়। এই খাতগুলোর উন্নয়ন বিশ্বব্যাপী আলোচনার শিরোনামে রয়েছে। কিন্তু এখনকার নিরব বিপ্লব ঘটছে কৃষিতে। যা কিনা এই মহাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি।

সেবাখাতে দ্রুত উন্নতি সত্ত্বেও এখনো আফ্রিকার জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ আসে কৃষি থেকেই। আফ্রিকায় দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, তারপরও এর দুই তৃতীয়াংশ লোকের পেশা কৃষি। এটা স্পষ্ট যে কৃষিক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অন্য খাতে প্রবৃদ্ধির চেয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণে ১১ গুণ বেশি কার্যকরী। যদি আমরা ২০৩০ সাল নাগাদ দারিদ্র্য দূর করতে চাই, তাহলে কৃষিকে আমাদের কৌশল হিসেবে নিয়ে এটাকে হৃদয়ের ডানপাশে রাখা প্রয়োজন।

আফ্রিকান কৃষি এবং ক্ষুদ্র জোতদারদের প্রায় ভুলতে বসেছি আমরা। যার ফলে আফ্রিকার কৃষকরা কঠোর পরিশ্রমের পরেও নিজেদের খাওয়ার মতো যথেষ্ঠ খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না। মহাদেশটির চার ভাগের একভাগ মানুষই অপুষ্টিতে আক্রান্ত, যা সুস্বাস্থ্য এবং মানবিক বিকাশের অন্যতম বাধা। এখানে একটি সরাসরি অর্থনৈতিক ব্যয়ও রয়েছে, বছরে ৩৫ বিলিয়ন মূল্যের খাবার আমদানি করতে হয়। যদি আফ্রিকা কৃষি উৎপাদন বাড়াতে না পারে তবে এ খরচ ২০২৫ সাল নাগাদ তিনগুণ হবে।

রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং সহিংস সংঘর্ষ লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এই বছরে শুরুতে (২০১৭), উত্তরপূর্ব নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ইয়েমেনের ২০ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছে। এটি একটি অমানবিক সংকট যার পুরোটাই মনুষ্য-সৃষ্ট। সৌভাগ্যবশত, এই বীভৎস দৃশ্য দেখার সম্ভবনা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

আফ্রিকার ক্ষুদ্র কৃষকদের সহযোগিতা করে আমরা ক্ষুধামুক্ত একটি আফ্রিকা গড়তে পারবো। আমরা দারিদ্র্যমুক্ত একটি আফ্রিকা গড়তে পারবো। আমরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং নিজেদের খাওয়ানোয় সক্ষম গর্বিত আফ্রিকা গড়তে পারবো।

 

প্রথমত, গত দশকজুড়ে কৃষি-খাত সরকার এবং বিনিয়োগকারীদের বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, গত বছরের আফ্রিকান গ্রিন রেভ্যুলেশন ফোরাম (এজিআরএফ) এর পক্ষ থেকে (যা আমি এক দশক আগে শুরু করতে সাহায্য করেছিলাম) ৩০ বিলিয়ন সম্পত্তির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নীতিগত প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। যা কিনা মহাদেশের কৃষিখাতের উন্নয়নের বৃহত্তম অঙ্গীকার আকারে হাজির হচ্ছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ছিল। এখন আমরা এই প্রতিশ্রুতিগুলো কাজে রূপান্তর করার পদক্ষেপ নিচ্ছি। এই বছরে ‘এজিআরএফ’এ কৃষি-ব্যবসার ৬ বিলিয়ন মূল্যের চুক্তি স্বাক্ষরের সাক্ষী হয়েছি।

দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্র জোতদারেরা তাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। ফার্ম টু মার্কেট অ্যালায়েন্স’র মতো উদ্যোগগুলি প্রান্তিক কৃষকদের তাদের উৎপাদিত পণ্যের দীর্ঘমেয়াদী ক্রেতার সুরক্ষা দিয়েছে, যা গতি পেয়েছে। এটি তাদের বিনিয়োগ এবং তাদের ব্যবসা বৃদ্ধি করতে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। কেননা, তারা জানে ফসল ফলালে তার বাজার আছে।

তৃতীয়ত, আমরা একসাথে কাজ করার ধরণেও পরিবর্তন এনেছি। নতুন অংশীদারিত্বের উদ্ভব হয়েছে, কোটি কোটি ডলারে ইনক্লুসিভ এগরিকালচারাল ট্রান্সফরমেশন ইন আফ্রিকার (পিআইএটিএ) মতো অংশীদারিত্ব থাকছে। এর উদ্দেশ্য ২০২১ সালের মধ্যে আফ্রিকাব্যাপী ৩০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র জোতদার এবং তাদের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তার উন্নয়ন এবং আয় বৃদ্ধি করা। এটা আমরা প্রথমবার দেখেছি যে, কৃষিখাতের বড় বড় বিনিয়োগকারীরা তাদের সম্পদ একত্রিত করছেন একই গন্তব্যে অগ্রসর হওয়ার উদ্দেশ্যে। এটি ব্যবসার নতুন পদ্ধতির প্রতিনিধিত্ব করছে।

আমরা পরিমানের চেয়ে খাদ্যের গুণগত মানের দিকে বেশি জোর দিয়েছি। সাব-সাহারান আফ্রিকায় লাখ লাখ লোক সুসাস্থ্য এবং বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব অনুভব করে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে- আমরা ফসলকে আরও পুষ্টিকর করে অপুষ্টি সমস্যারও মোকাবেলা করছি।

 

চতুর্থত, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে খাদ্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে যা ইতোপূর্বে ঘটেনি। আমরা কৃষকদের -এর সাথে এটা মানিয়ে নেয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়েছি। যেমন আমরা খরা এবং তাপ-সহিষ্ণু ফসল, আধুনিক আবহাওয়া তথ্য ব্যবস্থা ও যথেষ্ঠ সেচ ব্যবস্থা দিয়েছি, যাতে করে কৃষকরা পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে।

পঞ্চমত, আমরা পরিমানের চেয়ে খাদ্যের গুণগত মানের দিকে বেশি জোর দিয়েছি। সাব-সাহারান আফ্রিকায় লাখ লাখ লোক সুস্বাস্থ্য এবং বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব অনুভব করে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে- আমরা ফসলকে আরও পুষ্টিকর করে অপুষ্টি সমস্যারও মোকাবেলা করছি।

উচ্চ ভিটামিন-এ সম্বলিত কমলা-আঁশের মিষ্টি আলু আমাদের সফলতার একটি উদাহরণ। যখন শিশুরা পর্যাপ্ত ভিটামিন-এ পায় না। তখন তাদের বিকাশ ধীরগতিতে হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে পড়ে, তারা অন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। নতুন জাতের এই মিষ্টি আলুর আধাকাপ করে খাওয়ালে শিশুদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ভিটামিনের চাহিদা পূরণ হয়। যার ফল, শুধু ভালো সুস্বাস্থ্য নয়, ভালো অর্থনীতিও। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বছর দেশটির জিডিপির ১১ শতাংশ পুষ্টিখাতে ব্যয় হয়।

অগ্রগতির এই লক্ষণগুলো খুব কমই আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়, কিন্তু এই বিষয়গুলোই ধীরে এবং নিশ্চিতভাবে অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং মহাদেশটির লাখ লাখ মানুষের জীবনমানের উন্নতি করছে। আফ্রিকা তাদের নিজেদের কৃষি রূপান্তরের উপর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। এই মহাদেশের জন্য এখন আফ্রিকান কৃষক এবং কোম্পানিগুলোকে তাদের খাদ্য-বাজার বৃদ্ধির সুফল ভোগ করার বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। যা ২০৩০ সালের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন সম্পদের হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পরিশেষে, এই উন্নতি চলমান থাকবে যদি আমরা কৃষিকে আমাদের সমৃদ্ধির পাথেয় হিসেবে গুরুত্ব দেই, আমাদের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করি এবং নিজেদের এই ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখি। ভাগ্যক্রমে, আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুরোধে চলমান অগ্রগতির একটি পর্যবেক্ষণ তৈরি করা হয়েছে যা সামনে বছর (২০১৮) জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় আফ্রিকান সামিটে উপস্থাপন করা হবে। আমি বিশ্বাস করি, গত কয়েক বছর ধরে চলমান অগ্রগতির চিত্র এতে স্থান পাবে; যদিও আমরা সবেমাত্র শুরু করেছি।

আমরা সে ফসল কাটবো যা আমরা বপন করবো। আফ্রিকার ক্ষুদ্র কৃষকদের সহযোগিতা করে আমরা ক্ষুধামুক্ত একটি আফ্রিকা গড়তে পারবো। আমরা দারিদ্র্যমুক্ত একটি আফ্রিকা গড়তে পারবো। আমরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং নিজেদের খাওয়ানোয় সক্ষম গর্বিত আফ্রিকা গড়তে পারবো। এমন প্রচুর ফসল যা আমরা একসাথে অর্জন করতে পারবো এবং করবো।