কুরবানী অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটি ইবাদত। প্রতিবছর জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ “কুরবানী বা ঈদুল আযহা” পালন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে কুরবানীর ইতিহাস ততোটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন দ্বীন-ধর্ম অথবা মানবজাতির ইতিহাস। মানবজাতির জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানী করার বিধান ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতে এটা ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এক রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করেছি, যেন তারা ঐসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে। যে সব তিনি তাদেরকে দান করেছেন।” (সূরা হজ্ব: ৩৪) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাফাসী ও যামাকশারী বলেন, “আদম (আঃ) থেকে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তা’য়ালা তার নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন। (তাফসীরে নাফাসী ৩/৭৯ , কাশশাফ ২/৩৩)
এখন, দেখা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক যুগেই কুরবানী ছিল, তবে পদ্ধতিটা ভিন্ন ছিল। তবে, কুরবানী নিয়ে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল এর ঘটনা-ই হলো মহান স্মরণীয় ইতিহাস।
এই লেখায় বিভিন্ন যুগে কুরবানীর ধরণ ও ইতিহাসের বিবরণ তুলে ধরা হলো।
হযরত আদম (আঃ) যুগে কুরবানী :
হযরত আদম (আঃ) এর দুই পুত্র হাবিল (Abel) আর কাবিল (Cain) এর মর্মান্তিক ঘটনা এই কুরবানী নিয়েই হয়েছিল। কাবিল ছিল সঙ্কীর্ণ মনের মানুষ। কোনো একটি কারণে হাবিল আর কাবিল দুজনেই কুরবানী দিলেন। কিন্তু দূরে সরে আসতেই হাবিলের কুরবানী আকাশ থেকে আগুন এসে পুড়িয়ে দিল অর্থাৎ তার কুরবানী কবুল হলো। কিন্তু কাবিলের কুরবানির কিছুই হল না। কাবিল ক্রোধোন্মত্ত হয়ে খুন করল তার ভাই হাবিলকে। মানবজাতির প্রথম খুনি কাবিল আর প্রথম নিহত হন হাবিল। পবিত্র কুরআনে এ ঘটনা বর্ণিত রয়েছে।
ইলিয়াস (আঃ) যুগে কুরবানী :
ইলিয়াস (আঃ) এর সময় ইসরায়েলের রানী ছিলেন ইসাবেল, সে ছিল পৌত্তলিক। তার উপাস্য ছিল দেবতা বা’আল (Ba’al/); কুরআনে তাদের এ দেবতার নাম উল্লেখ আছে। সূরা আস-সাফফাতের ১২৫ নং আয়াতে আছে যে, “তোমরা কি বা’আলকে ডাকবে এবং সর্বোত্তম স্রষ্টাকে পরিত্যাগ করবে, ইলিয়াস (আঃ) অনেক চেষ্টা করেন এ রানীর কুচক্রের হাত থেকে ইসরায়েলকে পবিত্র করতে, পারলেন না। আল্লাহ ইসরায়েলে দুর্ভিক্ষ দিলেন। শেষ পর্যন্ত হযরত ইলিয়াস (আঃ) প্রকাশ্য ‘চ্যালেঞ্জ’ প্রস্তাব করেন। সে হিসেবে কারমেল পাহাড়ে দুটো বেদী বানানো হল। একটাতে রাখা হল ইলিয়াসের (আঃ) এর কুরবানী। আরেকটাতে দেবতা বা’আলের ৪৫০ ভণ্ড নবীর কুরবানী। এরপর শুরু হল প্রার্থনা। যার কুরবানি কবুল হবে তার প্রভু সত্য। ভণ্ড নবীরা যতই চেষ্টা করল, বা’আলের কাছে প্রার্থনা করল, পারল না। কিন্তু হযরত ইলিয়াস (আঃ) প্রার্থনা করতেই আকাশ থেকে আগুন এসে পুড়িয়ে দিল তার কুরবানী। এরপর হত্যা করা হল ভণ্ড নবীদের। আর ইলিয়াস (আঃ) দোয়া করতেই বৃষ্টি নামলো। দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয়ে গেল।
হযরত নুহ (আঃ) যুগে কুরবানী :
হযরত নূহ (আঃ) মহাপ্লাবনের পর জাহাজ থেকে মহান রবের উদ্দেশ্য শুকরানা কুরাবানী করেন।
হযরত মুসা (আঃ) যুগে কুরবানী :
হযরত মুসা (আঃ) এর লোহিত সাগর পাড়ি দেবার ঘটনার পর থেকে, ঈদুল ফিসাখ পালন করত ইহুদীরা এবং এখনও করে। আল্লাহ তাদেরকে কুরবানী করতে বলেছিলেন মিসর থেকে মুক্তির কথা স্মরণ করে। তবে এখন ইহুদীরা মুসলিমদের মতো করে পালন করে না কুরবানী।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) হযরত ইব্রাহিম (আ) এর কুরবানির ইতিহাস সবারই জানা। স্বপ্নে নিজের প্রিয়তমের কুরবানির নির্দেশ পেয়ে তিনি একে একে অনেক কিছুই কুরবানী করলেন। কিন্তু পরে বুঝলেন আসলে কুরবানী করতে হবে নিজের একমাত্র ছেলেকে। কুরআনের ভাষায় পুরো ঘটনা তুলে দেয়া হচ্ছে- হে আমার পরওয়ার দেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কী দেখ। সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম (আঃ) তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু। আমি তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে, ইব্রাহিমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে ছিল আমার বিশ্বাসী বান্দাদের একজন।” (সুরা সাফফাত, ১০০-১১১)
বর্তমান প্রচলিত কুরবানিটা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান দিনটির কথা স্বরণ করতেই পালন করা হয়। মহান আল্লাহর নিকট এই কুরবানীটা ছিল অধিক পছন্দনীয় , তাই সমগ্র মুসলিম জাতির সামর্থ্যবানদের জন্য কুরবানীকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন।