কে শহিদুল আলমকে ভয় পায়?

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক’র লেখা

কে শহিদুল আলমকে ভয় পায়?

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনিস্টিটিউট ফর কম্পারেটিভ লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যাপক। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই সমালোচক সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিতর্কিত আইনে গ্রেফতার হওয়া বিশ্বখ্যাত ফটোগ্রাফার শাহিদুল আলমের মুক্তির দাবিতে কলম ধরেন। গত ২০ আগস্ট ২০১৮ নিউইয়র্ক টাইমস’র মতামত পাতায় প্রকাশিত তার কলামে উঠে আসে বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান ক্ষত। যেখানে বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে সরকারের নানান স্বৈরাচারী লক্ষণ। লেখাটি জবানের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন তুহিন মোহাম্মদ।


গত ৫ আগস্ট, ৩০ জন সাদাপোশাকের পুলিশ বাংলাদেশের নামকরা ফটোসাংবাদিক শহিদুল আলমকে তুলে নিয়ে যায় এবং পুলিশি হেফাজতে রাখে। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ তারা শহিদুল আলমের অ্যাপার্টমেন্টে জোরপূর্বক প্রবেশ করে, তারা নিরাপত্তাকর্মীর মোবাইল ছিনিয়ে নেয় এবং সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট করে ফেলে।

তারপরেও কেউ একজন মোবাইলের মাধ্যমে ওই মুহুর্তের ভিডিও করতে সক্ষম হয়েছিলো। ভিডিওতে দেখো যাচ্ছে জনাব আলম চিৎকার করে বলছেন, “আমি নিষ্পাপ’। তিনি বারবার বলছেন। এবং বলছেন “আমি একজন আইনজীবী চাই”।

আমি যাকে একজন বন্ধুসুলভ, আত্মভোলা এবং মেধাবী মানুষ হিসেবে চিনি সেই শহিদুল আলমকে এইভাবে আর্তনাদ করতে দেখাটা সত্যিই আতঙ্কের বিষয়।

জনাব আলম গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ এবং এর আশেপাশের অঞ্চলের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত প্রশ্নগুলো নিয়ে কাজ করছে। আমার একজন বন্ধু নিউইয়র্কে শহিদুল আলমের একটি প্রদর্শনী দেখে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগণের ট্রাজেডি জন্য জেগে ওঠার তাগিদ পান। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের একটি ঘূর্নিঝড়ের পর আমি প্রথম তার কাজের সাথে পরিচিত হই। ঝড়ের পর আমি নিজেও ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং ঝড়-কবলিত অঞ্চল পরিদর্শন করেছিলাম। তখন দেখেছিলাম, জনাব আলমের আলোকচিত্র আমার অভিজ্ঞতার বাস্তব চিত্রগুলোই ধারণ করেছিলো।

একইরকম ভাবে, ২০১৪ সালে শহিদুল আলম দেশটির সর্বোচ্চ শিল্পীর সম্মান ‘শিল্পকলা পদক’ অর্জন করেন যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে দেয়া হয়।

শহিদুল আলমকে গ্রেফতারের কারণ হল, আল জাজিরা’র একটি সাক্ষাৎকার। যেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক ঢাকায় ছাত্র বিক্ষোভে নিষ্ঠুর নিপীড়নের সমালোচনামূলক বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও তিনি শেখ হাসিনার অধিনে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, কুশাসনের দিনগুলো, ভিন্নমতালম্বীদের দমন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম নিয়ে কথা বলেন। মূলত, জনাব আলমের কারাদণ্ড তার এই পয়েন্টগুলো সত্যতারই প্রমান বহন করে।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শত শত বাংলাদেশিকে তুলে নিয়ে গেছে এবং কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরে তারা নিখোঁজ হয়ে গেছে। তাদের অনেকে এখন কোথায় আছে তা জানা নেই। মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।

 

জুলাইয়ের শেষের দিকে ঢাকায় দ্রুতগতির একটি বাস দু’জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করলে- স্কুলের বাচ্চারাসহ হাজারো শিক্ষার্থী প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সাধারণ হৈচৈয়ের মধ্যে তীব্রতর বিক্ষোভটি সরকার বিরোধী হয়ে ওঠে, সরকার আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত উচ্ছৃঙ্খলদের দ্বারা বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের হামলার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’র গবেষকরা কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলেছে যারা বর্ণনা করেছে যে কিভাবে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ এবং যুব সংগঠন ‘বাংলাদেশ যুবলীগ বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা করেছে।

জনাব আলম সেই সব সাংবাদিকদের একজন যিনি বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের উপর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলার সাক্ষী। তিনি বিক্ষোভ এবং তা দমনের ছবি তুলছিলেন।

জনপ্রিয় এই ফটোসাংবাদিকই একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি আটক হয়েছেন। অসংখ্য বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীও আটক হয়েছে এবং পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে হতে পারে। শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব তাদের নিজ দেশের গঠনমূলক সমালোচনা করা। মিসেস হাসিনা’র সরকার অবশ্যই শহিদুল আলমের মতো বিশ্বাসযোগ্য এবং সম্মানিতদের ব্যাপারে গভীরভাবে আতঙ্কিত। যাদের সমালোচনা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সিরিয়াসলি নেয়া হয়। তাকে আটক এবং কারারুদ্ধ করা অবশ্যই সমালোচনামূলক কণ্ঠ বন্ধ করার পদক্ষেপ।

মিসেস হাসিনা তাকে শুধু গ্রেফতার করে ক্ষান্ত হননি। তার মানহানি ও খ্যাতিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টাও চালিয়েছেন। শহিদুল আলমের স্ত্রী নৃতাত্ত্বিক রেহনুমা আহমেদ যখন কারাগারে তাকে দেখতে যান, তিনি হঠাৎ চমকে ওঠেন, যখন বুঝতে পারেন যে তাদের সাক্ষাৎ কারাকর্তৃপক্ষের দ্বারা গোপনে ভিডিও করা হচ্ছে।

এটা বিস্ময়কর কিছু নয় যে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ স্বৈরশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

 

একটি ইমেইলে মিসেস আহমেদ জানিয়েছেন, “ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বন্ধুরা আমাকে বলেছে যে, সরকারের সংস্থাগুলো শহিদুলের উপর ‘নোংরা প্রতিবেদন’ তৈরি করতে বলছে তাদেরকে, যেখানে তাকে ‘শিশু যৌন নির্যাতনকারী’ হিসেবেও উপস্থাপন করার কথা উঠেছে- কেন না, প্রত্যেকের কাছে তার শিশুদের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটা পরিচিত।”

এটা বিস্ময়কর কিছু নয় যে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ স্বৈরশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অসংখ্য সাংবাদিকদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শত শত বাংলাদেশিকে তুলে নিয়ে গেছে এবং কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরে তারা নিখোঁজ হয়ে গেছে। তাদের অনেকে এখন কোথায় আছে তা জানা নেই। মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।

গ্রেফতারের দু’দিন পর জনাব আলমকে আদালতে হাজির করা হয় এবং বাংলাদেশের কুখ্যাত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে (৫৭ ধারায়) অভিযুক্ত করা হয় এই মর্মে যে অনলাইনে দেয়া তার বক্তব্য ‘ জাতির ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে’। যখন তাকে আদালতে টেনে আনা হচ্ছিল তিনি খালি পায়ে ছিলেন এবং খোড়াচ্ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আলম পরিস্কারভাবে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন দেখাচ্ছিলেন। তিনি চিৎকার করছিলেন যে “আমি বেআইনিভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছি, আমার রক্তমাখা পাঞ্জাবি ধুয়ে আবার পরানো হয়েছে। আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছে যে যদি আমি তাদের কথামতো সাক্ষী না দেই, আমি পুনরায় …” আর পর তার মুখ চেপে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাকিটুকু পরিস্কারভাবে শোনা যায় নি।

আদালত আলমকে এক সপ্তাহের জন্য পুলিশ হেফাজতে রাখার পরে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেয়ার নির্দেশ দেয়। ১২ আগস্ট, আলমকে পুনরায় আদালতে হাজির করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হয়।

একাডেমিক কোন স্বাধীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাংবিধানিক সংস্কার ও পুনর্গঠনে কোন ভূমিকা পালন করতে পারছে না। যৌন সহিংসতা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া দমনমূলক সহিংসতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আতঙ্কের এক সংষ্কৃতিতে দেশটি ছেয়ে গেছে।

 

এই মুহূর্তে বাংলাদেশিদের ধারণা- বিচার বিভাগ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে এবং পুলিশ আইন রক্ষায় কিছুই করছে না। একাডেমিক কোন স্বাধীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাংবিধানিক সংস্কার ও পুনর্গঠনে কোন ভূমিকা পালন করতে পারছে না। যৌন সহিংসতা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া দমনমূলক সহিংসতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আতঙ্কের এক সংষ্কৃতিতে দেশটি ছেয়ে গেছে।

বাংলাদেশে জনাব আলমের সুষ্ঠু বিচার পাওয়া অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে শহিদুল আলমকে সহিংসতার জন্য দায়ি করেছেন।

শেখ হাসিনার ছেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “তার মিথ্যা পোস্ট এবং অভিযোগের কারণে ছাত্ররা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং পুলিশ এবং আমাদের পার্টি অফিসে হামলা করে”। তিনি আরও লিখেছেন, “অনেক পুলিশ এবং আমাদের অসংখ্য কর্মী আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন, আরাফাতুল ইসলাম বাপ্পি, তার দৃষ্টি হারিয়েছে এবং এখন স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে”।

এই বিষয়টি সরকারি প্রচারণার অন্তর্গত। তবে এটা শহিদুল আলমকে পুলিশ এবং আদালত কি ভাবে বিবেচনা করবে তার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আলমের মানবাধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘনের পাশাপাশি, বাংলাদেশ জুড়ে সামাজিক ন্যায় বিচারের মানদণ্ড ভেঙে পড়েছে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীরা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, শেখ হাসিনার সরকার ন্যায়বিচারকে শুধু একটি প্রতিশোধের উপায় হিসেবে বিবেচনা করে।

আলমের আটক, নির্যাতন এবং কারারুদ্ধ করার ঘটনা তার ব্যক্তি স্বাধীনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে এবং এই ঘটনা মুক্ত সাংবাদিকতার অধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রতিশ্রুতির উপর আক্রমন করেছে। বাংলাদেশকে অবিলম্বে তাকে এবং কারাগার থেকে অন্যান্য আটককৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তুলে নিতে হবে।