বাইশ গজ : লেট’স লিভ দ্য ড্রিম

বাইশ গজ : লেট’স লিভ দ্য ড্রিম

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে বড়। ভরপুর তারুণ্যের হাওয়া গায়ে মেখে ছুটে চলা কোন তরুণকে স্বপ্ন নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসবে- ‘হ্যাঁ। আমি স্বপ্নবাজ’’। সবার স্বপ্ন পূরণ হয় না। সবাই স্বপ্নের পেছনে ছোটেনওনা। কেউ কেউ আছেন, নির্দিষ্ট স্বপ্ন দেখেন না। ওয়ারেন বাফেটের ‘কখনো একসাথে দুই পা ডুবিয়ে নদীর গভীরতা মাপতে যাবেন না’ উক্তির মতো স্বপ্নেরও শাখা খুলেন। দোষ কিসে? পয়সা লাগে নাকি? একটি না হলে অন্যটি আছে বাস্তবায়নের জন্য। তবে যা নিয়ে বলব তা কোন মানুষের কথা নয়, একদল তরুণের গড়া ব্রত নিয়ে; যারা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্নের পেছনে ছোটেন, বলা ভাল- ছুটছেন।

‘প্রতিটি রাস্তায় প্রতিটি জানালায়

হাসিমুখ, হাসিমুখে আনন্দধারায়’…

সুপরিচিত গানের প্রথম দুই চরণের সঙ্গে বেশ যায় বাইশ গজ! পবিত্র ইদের বিশেষ আয়োজনে জবান পাঠকদের জন্য থাকছে ব্যতিক্রমী ক্রিকেটগ্রুপ ‘বাইশ গজ’ এরই গল্প।

• পথচলার প্রথম প্রহর…

টিএসসির বারান্দায় বসে সন্ধ্যার জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে গিটার হাতে কত ইচ্ছেই না উঁকি দেয়। ইচ্ছেকে ইচ্ছেতেই দমিয়ে রাখেননি ওরা দুইজন। প্রত্যয়, আশিক। ক্রিকেট নিয়ে যাদের নিত্য স্বপ্নচাষ। ভাবনা থেকে কাজের সূত্রপাত। ফেসবুকে ভুঁড়ি ভুঁড়ি গ্রুপ আছে। সময় কাটাতে সেসবের জুড়ি নেই। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম ক’টা আছে? সেই প্ল্যাটফর্মের খোঁজেই তারা নেমে পড়লেন। অক্টোবর ৬, ২০১৬। খুলে ফেললেন ক্রিকেটভিত্তিক ফেসবুক গ্রুপ। নাম ‘বাইশ গজ’।

• খুলেই খালাস? নাকি?

শখের বসে একটা গ্রুপ খুলে কয়েকদিন ঘাঁটাঘাঁটি, তারপর যে যার পথে হাটাহাটি! এরকম কিছু হয়নি। কেননা পেছনের মানুষগুলো একেকজন ক্রিকেটে খান, ক্রিকেটেই ঘুমান। সাভারের এক মাঝবয়সী ক্রিকেটপ্রেমী ছায়ামূর্তি ওয়াহিদুর রহমান, নামকরা ক্রিকেট পেজের এডমিন চট্টলার নকিব, মাশরাফির বাড়ির পাশের ক্রিকেট উন্মাদ তরুণী মিতুরা পেছন থেকে চমৎকার বোঝাপড়া তৈরি করে ফেলেছেন। এমন স্ট্রং প্যানেল থাকতে এটি আর দশটা গ্রুপের মতো সাধারণ হবার কথা নয়। সঙ্গে ময়মনসিংহের আনোয়ার, নরসিংদীর নাজমুল রনি; প্রত্যয় আশিকরা তো ছিলই। প্রথম দিকে কেবল অনলাইনে ক্রিকেটনির্ভর শুদ্ধ আলোচনা নিয়েই এগোতে থাকেন তারা। সময়ের পালাবদলে ডালপালা মেলতে শুরু করে মাঠের প্রতি ভালবাসা।

প্রমিলা ক্রিকেটার শারমিন আক্তার সুপ্তা ও অনুর্ধ্ব ১৯ দলের ব্যাটসম্যান শফিউল হায়াত হৃদয়ের সঙ্গে বাইশ গজের সদস্যরা

• মাঠের ভালবাসা…

দিনশেষে ক্রিকেট মাঠের খেলাই। শক্ত পিচে বোলাররা হুল ফোটান, ব্যাটসম্যান ফোটান ফুল। স্নিগ্ধতা-বিষাক্ততার ভয়ংকর সুন্দর যুগলবন্দী দেখতে গ্যালারিতে ছুটে যাই আমরা। ভক্তদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে এগুতে থাকে বাইশ গজও। ধীর লয়ে বল গড়িয়ে পৌঁছে যায় সবুজ ঘাসে। বাংলাদেশে অসংখ্য ক্রিকেট গ্রুপ আছে, আছে তারকাদের ফ্যান জোন। অনলাইনের গন্ডিতেই যাদের অধিকাংশ সীমাবদ্ধ। কিন্তু ওই যে, কেউ কেউ আছেন নির্দিষ্ট স্বপ্ন না দেখে স্বপ্নের শাখা খোলেন। বাইশ গজ ঠিক সেই দলের অগ্রসেনা।  বেশ সাহসী এক পদক্ষেপ নিয়ে পদার্পণ করেছে পেশাদার ক্রিকেট জগতে। দেশের ক্রিকেট কাঠামোর আওতায় ক্রিকেট বলের সব টুর্নামেন্ট এ অংশ নিয়ে এসেছে আলোচনায়, পেয়েছে সাফল্য। টিম বাইশ গজ এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকা লীগ এ টিম সাবমিশনের মধ্য দিয়ে দেশের আনাচে কানাচে পড়ে থাকা ক্রিকেটারদের জন্য একটা সুযোগ করে দেবার দিকে!

ক্রিকেটার তাইজুল এবং মোহাম্মদ আজিমের সাথে বাইশ গজ

•এখানে ওখানে বাইশ গজ সবখানে!

শুরুর দিকে কেবল বাইশ গজের ব্যানারেই চলত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। দলের হয়ে খেলেছেন জাতীয় দলের বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম, এবারের প্রিমিয়ার লীগে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মোহামেডানের পেসার মোহাম্মদ আজিমের মত তারকারা। জাতীয় পর্যায়ে খেলা অনেকেই নানান সময় প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাইশ গজের। তাতেই কি না উৎসুক হয়ে গড়ে উঠে আরো অনেকগুলো শাখা দল। এখন অব্দি দলসংখ্যা ৫টি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, কাতলাপুর জুনিয়র। শেষের দলটা স্কুল পর্যায়ের শিশুদের নিয়ে! ভাবা যায়! এতেই শেষ নয়। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় দলও খুলেছে বাইশ গজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জোনের পাশাপাশি প্রক্রিয়া চলছে জাহাঙ্গীরনগরের দলগঠন নিয়ে, যে প্রক্রিয়ার আওতায় আছে সিলেট এবং গাজীপুর জোনও। আর ক’দিন আগে তো হয়ে গেলো বাইশ গজের সবকটা দল নিয়ে ঘরোয়া প্রিমিয়ার লীগই!

বাইশ গজ বিক্রমপুর জোনের পরিচালক রবিন রাজ বলেন- “আমাদের স্বপ্ন ছিলো ঢাকার দেখানো পথ ধরে বিক্রমপুরেও একটা টিম করা।  সৃষ্টিকর্তার কৃপা এবং দলের সহযোগিতায় আমরা সেটা করতে পেরেছি। আমাদের এখন ৪০জন রেজিস্ট্রার্ড প্লেয়ার আছে।  ইচ্ছা আছে আরো বহুদূর যাওয়ার”।

•বহুদূরের পথে…

মাঠ, মাঠের বাইরে দুইবছরে অনেকখানি সফল হয়েছেন তারা। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের যাত্রা, তা এখনো সঠিক কক্ষপথেই আছে। পথশিশুদের নিয়ে কিছু করার প্রচণ্ড তাড়না অনুভূত হয় তাদের। প্রধান পরিচালক ওয়াহিদুর রহমান এ প্রসঙ্গে জানান- “আমাদের আরেকটা বড় স্বপ্ন আছে। সেটা হচ্ছে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা এবং সেটি ক্রিকেটের মাধ্যমে। কয়েক মাসের মধ্যেই এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ শুরু করব আমরা। স্বপ্নকে বাস্তবে  রূপ দিতে এবং আমাদের ফান্ডকে শক্ত করতে পৃষ্ঠপোষক খোঁজা হচ্ছে যারা এই কাজে সহযোগিতা করতে পারেন। খুব শীঘ্রই তাদের নিয়ে বড় কিছুর ঘোষণা আসছে বাইশ গজের পক্ষ থেকে”।

•শুদ্ধতায় মানবতার চর্চা…

‘বাইশ গজ’ ক্রিকেট টিমের একাংশ।

খেলা মানেই আজকাল আর নিছক বিনোদন নয়। দৈনন্দিন জীবনেই জড়িয়ে গেছে তা। খেলাকে কেন্দ্র করে যেমন গড়ে উঠে সম্প্রীতি তেমনি ভক্তকূলের বাচ্চামি জন্ম দেয় বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার। ওয়াহিদুর রহমান আহবান জানান সেইসব ভক্তদের। বলেন, “আপনারা ভক্ত হোন, অন্ধ ভক্ত নয়। খেলোয়াড়রাও মানুষ। তারা ভুল করতেই পারে।  ভাল কিছু করলে যেমন আমরা বাহবা দেই তেমনি খারাপ করলেও সমালোচনার অধিকার রাখি। তবে তা যেন গঠনমূলক হয়”।

•জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে…

বাইশ গজ। “লেট’স লিভ দ্য ড্রিম” স্লোগানে মুখর স্বপ্নবিলাসী এক স্বচ্ছ প্রাঙ্গন। অনলাইনে দুই বছরে যতটা জনপ্রিয় হয়েছে অফলাইনে তারচেয়ে যৌক্তিক কারণেই অনেক বেশি হয়েছে। এই সামান্য সময়েই হয়ে উঠেছে মাঠের ক্রিকেটে অন্যান্য গ্রুপগুলোর দিশারী। বাইশ গজের রয়েছে নিজস্ব থিম সং। গ্রুপের লেখক জহিরুল ফিরোজের লিরিক্সে, নকিবের সম্পাদনায় গানটির আনঅফিসিয়াল কভার করেছেন টিউলিপ সেনগুপ্ত। “বাইশ গজ” শিরোনামের গানটির কথায় ফুটে উঠেছে ক্রিকেট এবং উদ্যমী বাস্তবতা।

পরিশ্রম বিফলে যায় না। আর যদি হয় মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে একদল পবিত্র মানুষের সমন্বয়ে তবে তার লক্ষ্যে পৌঁছানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিসিবির পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে ক্রিকেট নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা বাইশ গজ থেকে কে জানে অদূর ভবিষ্যতে কেউ হয়ত নাম লেখাবেন সেরার খাতায়। প্রত্যয় উদ্যমে এগিয়ে যাবার সুর, লালসবুজের কীর্তি ডানা মেলবে বহুদূর…