সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন দেশটির বিশ্বকাপজয়ী সাবেক কাপ্তান ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভবনে গত শনিবার সকাল ১০টায় তাকে শপথ বাক্য পাঠ করান প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসাইন। এর আগে গত শুক্রবার পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৭৬ জন সদস্যের ভোট পেয়ে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ম্যাজিক ফিগার ছিল ১৭২।
ক.
বাইশ গজের আঙ্গিনা থেকে বেরিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়েন পাকিস্তানের জটিল রাজনীতির আঙিনায়। সালটা ১৯৯৬-র ২৫ এপ্রিল, তৈরি করলেন নিজের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহেরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। ক্রিকেটের মাঠে তার আক্রমণাত্মক ভূমিকা কারও অজানা নয়। তবে সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন আঙিনায় ঢুকেও তার স্বাভাবসিদ্ধ ভঙ্গিটা কিন্তু উধাও হয়ে যায়নি। গত ২২ বছর ধরে তিল তিল করে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছেন। ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। যতটা বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে ছুটেছেন খাইবার থেকে গিলগিট, গোয়াদর থেকে করাচি, পেশোয়ার থেকে মুলতান তক। টানা বাইশ বছর ধরে নিরলস ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল অবশ্য শেষমেষ নিজের ঘরেই তুলে এনেছেন। বলাই বাহুল্য ইমরানের এই জয় পাকিস্তানের ভেতরকার রাজনীতির হিসেব তো বটেই, একই সাথে দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণে নতুন অভিমুখ তৈরি করতে যাচ্ছে। আগের অনেক হিসেব এখন পাল্টাতে শুরু করেছে।
খ.
দেশকে সুনির্দিষ্ট পথে চালিত করা, দেশের ক্ষমতায় আসীন হয়ে যারা লুটপাট করেছে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করা- ভঙ্গুর অর্থনীতি খাড়া করাসহ এমন বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন ‘কাপ্তান’। পাকিস্তানের নয়া উজিরে আজমের সামনে সবচেয়ে যে বড় চ্যালেঞ্জ হবে তা হলো: অর্থনীতি, পানি, দূর্নীতি দমন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল, ছোট প্রদেশগুলোতে সুষমবন্টন এবং কাশ্মির ও আফগান ইস্যু।
ইমরানের অর্থমন্ত্রী আসাদ ওমরের প্রথম কাজ হবে ডলারের পর্যাপ্ততা বাড়ানো, এর জন্য যেতে হতে পারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কাছে। উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা দ্রুত চালু করা হবে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
১. অর্থনীতি :
পাকিস্তানের অর্থনীতি খুবই করুণ ও রুগ্ন অবস্থায় পতিত হয়েছে। বিগত ৫ বছরে বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়েছে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক ঋণে করা অনুৎপাদনশীল অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে দেশটি। আর্থিকভাবে খুব কঠিন সময় পার করছে পাকিস্তান। আমদানি -রপ্তানির বিপুল ঘাটতি মোকাবেলায় ও অভ্যন্তরীণ ব্যয় নির্বাহের জন্য দেশটির ঘুরে দাঁড়াতে অতিদ্রুত প্রয়োজন প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। ফরেন রিজার্ভ কমতে থাকায় গত ৫ বছরে রূপির অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। মুদ্রার অবমূল্যায়ণের কারণে দেশটি বেড়েছে মূল্যস্ফীতি ফলে প্রাত্যহিক জীবননির্বাহ দুস্কর হয়ে পড়েছে। ইমরানের অর্থমন্ত্রী আসাদ ওমরের প্রথম কাজ হবে ডলারের পর্যাপ্ততা বাড়ানো, এর জন্য যেতে হতে পারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কাছে। উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা দ্রুত চালু করা হবে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
২. পানি :
বিজ্ঞ রাষ্ট্র চিন্তকরা বলে থাকেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে শুধুমাত্র পানির জন্য। উনাদের ভবিষ্যৎবাণী যে কতটা বাস্তবতার নিরিখে করা হয়েছিল তা বোঝা যায় পাকিস্তানের পানির অপর্যাপ্ততা ও সংকট দেখে। পাকিস্তানের পানির মজুদ সর্বসাকুল্যে ২২ দিনের মতো আছে। কোন খরা হলেই দেশটিতে ভয়াবহ মহামারি লেগে যেতে পারে। পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে কৃষি উৎপাদন। ফলে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায়না। হিন্দুকুশ এর অববাহিকায় ড্যাম বানানো দেশটির জন্য অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুন সরকারের কাছে পানির পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
৩. দুর্নীতি দমন :
পাকিস্তানের অগ্রগতির পিছনে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন ও পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা ছিলো ইমরানের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। বড় বড় ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সেক্টরের রাঘব বোয়ালদের হাত থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ উদ্ধার করা দেশটির নতুন সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি রোধে সিভিল সার্ভিস রিফর্ম ও রাষ্ট্রীয় ফেডারেল রেভিনিউ রেগুলেটরি (FBR) পুরোদমে সংস্কার করার পরিকল্পনা নতুন সরকারের রয়েছে। এসব রিফর্ম করতে পারলে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
নতুন সরকারের সামনে সন্ত্রাস ও জঙ্গি নির্মূল যে কত বড় চ্যালেঞ্জ তা বোঝা যায় দেশটির নয়া প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ের দায়িত্ব নিজ কাধেঁ তুলে নেয়ার মাধ্যমে। সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য ধ্বংস করা, বেলুচ বিদ্রোহীদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা ও জঙ্গিবাদের সমূলে বিনাশ করা ইমরান খানের নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
৪. সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল :
পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো। অব্যাহত সন্ত্রাস ও উগ্রপন্হী জঙ্গিদের হামলায় দেশটির সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট ও নাগরিকদের জানমালের হেফাজত করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। নতুন সরকারের কাছে জঙ্গিদের মূলোৎপাটন করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে জঙ্গিদের সমূলে ধ্বংস করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। নতুন সরকারের সামনে সন্ত্রাস ও জঙ্গি নির্মূল যে কত বড় চ্যালেঞ্জ তা বোঝা যায় দেশটির নয়া প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ের দায়িত্ব নিজ কাধেঁ তুলে নেয়ার মাধ্যমে। সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য ধ্বংস করা, বেলুচ বিদ্রোহীদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা ও জঙ্গিবাদের সমূলে বিনাশ করা ইমরান খানের নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই পদক্ষেপ বিশ্ব রাজনীতির অনেক জটিল হিসেব নিকেশের মধ্যে আটকে থাকার কথা। আফগান ইস্যুটিও এখানে জরুরি ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যদিকে পশ্চিমা মিডিয়াতে যাদের ‘জঙ্গি’ বলে প্রচার করা হয় তাদের অনেকেই ইসলামী রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ফিগার। তাদের রয়েছে ব্যাপক জনভিত্তি। ফলে জঙ্গিদমনের নামে যে ধরণের সন্ত্রাস আগের সরকারগুলো পরিচালনা করেছে তা ব্যর্থ হয়েছে। সহিংসতা কমার বদলে বেড়েছে। কাজেই কাপ্তান খানকে সেই পুরনো পশ্চিমা পথে হাটলে হবে না। পাকিস্তানের মিলিট্যান্ট ইসলামি শক্তিগুলোর সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে বিশ্ব মিডিয়াতে অনেক ধরনের বিশ্লেষণ হয়ে আসছে অনেক দিন থেকেই। অন্য সরকারগুলো যে ভাবে ইউরোপ-আমেরিকার এজেন্ট হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তার ফল হয়েছে ভয়াবহ। পাকিস্তান তালেবানের বা এই ধরনের সংগঠনগুলো হয়েছে শক্তিশালী কাজেই ইমরানকে এই কৌশলে আগালে হবে না। ইমরান খান এই বিষয়ে কি নীতি গ্রহণ করেন তা দেখার জন্য বিশ্ববাসী অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
৫. ছোট প্রদেশগুলোতে সুষমবন্টন :
পাকিস্তানের ৪ টি প্রদেশের মধ্যে পাঞ্জাব প্রদেশ ছাড়া অন্যান্য ছোট তিনটি প্রদেশ তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে এতদিন বঞ্চিত হয়ে আসছিল। ইমরানের সামনে ছোট প্রদেশগুলোর চাহিদা ও তাদের ন্যায্য হিস্যার সঠিক বন্টন করা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের বেশিরভাগই উপরোক্ত তিনটি প্রদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছোট প্রদেশের ন্যায্য অধিকার সমভাবে বন্টন করে দিতে পারলে দেশটির আঞ্চলিক অস্থিরতা ও ক্ষোভ অনেকাংশেই লাঘব হয়ে যাবে। জাতীয় ঐক্য অনেক দৃঢ় হবে। অন্যদিকে প্রতিবেশি দেশের উস্কানির রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে।
আফগান তালেবানের সাথে আমেরিকা ও আফগান সরকারের মধ্যকার শান্তি আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসূ হয় তা নির্ভর করছে পাকিস্তান সরকারের ভূমিকার ওপর। পাকিস্তানবিহীন আফগান সমস্যার সমাধান আমেরিকা ও তার মিত্ররা করতে পারবে না।
৬. কাশ্মির ও আফগান ইস্যু :
পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্ত জুড়ে ভারতের সাথে সীমান্ত আর উত্তর সীমান্ত জুড়ে রয়েছে আফগানিস্তান। ‘ওয়ার অন টেররের’ পর থেকে বলতে গেলে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। ৮০ হাজার পাকিস্তানি মারা গেছে গত ১৭ বছরে এই ‘ওয়ার অন টেররে’ আমেরিকা কে সহযোগিতা করার কারণে। আফগান তালেবানের সাথে আমেরিকা ও আফগান সরকারের মধ্যকার শান্তি আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসূ হয় তা নির্ভর করছে পাকিস্তান সরকারের ভূমিকার ওপর। পাকিস্তানবিহীন আফগান সমস্যার সমাধান আমেরিকা ও তার মিত্ররা করতে পারবে না। ইমরান সরকারের পররাষ্ট্র নীতিমালার প্রধান বিষয়টিই হচ্ছে আফগানিস্তানে শান্তি আলোচনার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে নিয়ে আসা। কাশ্মির ইস্যুতে ইমরান নির্বাচন পরবর্তী প্রথম ভাষণে খোলাসা করেছেন যে – ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মূল ইস্যুই হচ্ছে কাশ্মির। কাশ্মিরিদের জাতিসংঘ প্রতিশ্রুত গণভোটের অধিকার নিশ্চিত করাই হবে ইমরান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ইমরান খানের সরকার উপরোক্ত মূল চ্যালেঞ্জ সমূহ সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারলে পাকিস্তান তথা উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিরাজ করবে। পরিবারতন্ত্রের বাইরে নতুন রাজনীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করার এটাই সুযোগ। এখন দেখার পালা খান সাহেব এই সুযোগ কি ভাবে কাজে লাগান।