দৌড়া, বোল্ট আইলো …

দৌড়া, বোল্ট আইলো …

তারকাদের তারকা তিনি। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে রাজত্ব করেছেন যতদিন ছিলেন। উসাইন বোল্ট। আগামীকাল  ২১ আগস্ট  মহাতারকার বত্রিশতম জন্মদিন। পবিত্র ইদের বিশেষ আয়োজনে জবান পাঠকদের জন্য বোল্টকে নিয়ে লিখেছেন জহিরুল কাইউম ফিরোজ।


উসাইন বোল্টের স্বর্ণ মাত্র আটটি। নেই কোন ব্রোঞ্জ, রোপ্য। মাইকেল ফেলপসের ২৩ স্বর্ণসহ পদক সংখ্যা ২৮টি, বোল্টের চারগুণ! তারপরেও এই দুজনের নাম ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ এর ইতিহাসে খোদাই হয়ে গেছে একসাথে, অমরত্ব নামক বিশেষ রঙতুলির আঁচড়ে। তবে এক্ষেত্রে একদিক দিয়ে প্রায় চারগুণ বেশি পদকজয়ী ফেলপসকে পেছনে ফেলেছেন বোল্ট। ‘দর্শকপ্রিয়তা’। তাকে যেমন দর্শকরা কাছে টেনে নিয়েছে তিনিও তেমনি তাদের আলিঙ্গন করতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি। যেন দর্শকরা তার দ্বিতীয় ট্র্যাক যেখানে যেতেই হবে। ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’র মোস্ট গ্রেটেস্ট পার্সনের অবশ্য এমনটাই হওয়া উচিত।

দর্শকরা দ্বিতীয় ট্র্যাক। আসলটি ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড, বোল্টের স্থায়ী মালিকানা। অনেকটা ব্যবসায় শিক্ষার সাবজেক্ট ম্যানেজমেন্ট এর একমালিকানা ব্যবসায়ের ন্যায়। লাভ-ক্ষতির পুরো ভোগ নিজের। নিজেই নিজের অধিপতি। বোল্টের বেলায় ক্ষতি বলতে কিছু নেই। না! আছে। একবার আছে। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিক। প্রথমবার অলিম্পিকের ট্র্যাকে অাঠারো বছরের স্বপ্নচারী তরুণ। স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে ২১ সেকেন্ড পরই! পায়ের ইঞ্জুরি নিয়ে দৌঁড়েছেন ঠিকই, ফিনিশিং লাইন টাচ করেছেন হিটে সবার শেষে। ২০০ মিটারে ২১.০৫ সেকেন্ড টাইমিংয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরেছিলেন তবে সে পথ নিভৃতে পাড়ি দেননি। কুড়িয়েছেন স্বপ্ন, জমিয়েছেন অভিজ্ঞতা।

২০০৮ সাল, বেইজিং অলিম্পিক। শুরু হল যাত্রা, মহাযাত্রা। যে যাত্রার অাদি আছে অন্ত নেই। ১০০ মিটার, ২০০ মিটার কিংবা ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিল; এগুলো স্টপেজ মাত্র! প্রতি স্টপেজে বোল্ট ঝুলিতে পুরেছেন অনেক অনেক অনেক কিছু। জানেন, এসবের জন্য সময়ও নেন না তিনি! ১০ সেকেন্ড বড়জোড় ২০ সেকেন্ড। সংশোধনী প্রয়োজন। পার স্টপেজে বোল্ট সব লুট করতে সময় নেন ১০/২০ সেকেন্ডেরও কম! ১০ সেকেন্ড? ২০ সেকেন্ড? আমার আপনার কাছে মূল্যহীন। নেট সার্ভারে প্রব্লেম হলে ফেসবুক লগইন দিতেই তো আরো সময় লাগে। অথচ এই ১০/২০ সেকেন্ডেই জ্যামাইকার এক কালোসম্রাট কতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। অমরত্বের দ্বারে নিজের পদচিহ্ন এঁকে এসেছেন। ২০১২, লন্ডন.. ২০১৬, রিও.. অভিন্ন পথরেখা ধরে এগিয়েছে বোল্ট এক্সপ্রেস।

উদযাপনের নিজস্ব ভঙ্গিতে উসাইন বোল্ট

অমরত্ব কি এত সহজলভ্য? আমাদের জন্য হয়ত নয়। কিন্তু বোল্টকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করুন। তিনি হাসবেন। কত সহজেই না অমরত্বকে বাগিয়ে নিয়েছেন! অমরত্ব তাঁর কাছে সম্মোহিত, তার কীর্তে বিমোহিত। কি এমন করে ফেলেছেন? রূপকথা বারবার শুনতে ইচ্ছে হয়। ‘উসাইন সেইন্ট লিও বোল্টও’ রূপকথাই বটে। প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে তিনবার স্বর্ণজয়। প্রাচীন গ্রিসে লিওনিদাস নামক এক লোক ছিল যিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪ থেকে ১৫২ পর্যন্ত চারটি অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত ইভেন্টে সবচেয়ে বেশি ১২ বার সেরা হওয়ার কীর্তি ছিল তার। তার ইভেন্টগুলিও বোল্টের মত। ১০০ ও ২০০। সর্বশেষ রিও অলিম্পিকে ডাবল জিতে ব্যক্তিগত ইভেন্টে সেরার পোডিয়ামে বোল্ট দাঁড়িয়েছেন ১৪ বার। মানে লিওনিদাসের রেকর্ড ভেঙ্গে গেছে, প্রায় ২১৬৮ বছরের পুরনো রেকর্ড। রূপকথার আরো অধ্যায় আছে। এক অধ্যায়ে আবার দুটো পার্ট!

ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, অলিম্পিক রেকর্ড। নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটোবছর ২০০৮ এবং ২০০৯। শ্রেষ্ঠ দুটো আসর বেইজিংয়ের অলিম্পিক আর বার্লিনের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। বেইজিং মহাযজ্ঞে বিশ্বকে জানান দিয়েছেন ০৪’র সেই কিশোর এখন পরিণত। ১৯.৩০ সেকেন্ডে ২০০ মিটারের মিশন শেষ করে অলক্ষ্যে কি বলেছিলেন, বহুদূর যেতে চাই…? পরেরবার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপে ৯.৫৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট শেষ করেছেন। একই অাসরে ২০০ মিটার শেষ করতে সময় নিয়েছেন ১৯.১৯ সেকেন্ড। রেকর্ডগুলো যদি কেউ ভাঙ্গতে পারে তা হলো বোল্ট। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারণ বয়সটা বুঝবে না কিছু। বুঝবে না বলেই এবছরের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ শেষে অবসর নিয়ে নিয়েছেন। তাই অন্য কেউ অন্য কখনো যদি পারে সেই আশাতেই আমাদের থাকতে হবে, প্রতীক্ষার প্রহর গুণে যেতে হবে।

আরো অসংখ্য সাফল্যের পালক যোগ হয়েছে ট্র্যাকের রাজার রাজমুকুটে। যতদিন ছিলেন সংখ্যা বাড়িয়ে গেছেন। যাবার অাগে নিভৃতে হয়ত বা বলে গেছেন- ‘আমিই স্প্রিন্টের মহারাজ, শেষকথা। মানবে না? তীর ছোঁড়া উদযাপন দেখনি? ওই যে বেইজিংয়ে প্রথমবার রেকর্ড করে করেছিলাম। সেটা লন্ডনেও ছিল। ৯.৬৩ সংখ্যাতত্ত্বের পর, রিওতে’ও অব্যাহত। জানি তোমরা মানবে। ভালোবাসো যে আমায়’। ভালোবাসা থেকেই একটি অনুরোধ, অন্যায় অনুরোধ। বৈশ্বিক ক্রীড়া অভিধানের পাতায় একটি সংশোধনীর দাবি! ‘দৌড় ইজ ইক্যুয়াল টু উসাইন সেইন্ট লিও বোল্ট’! এটিকে সমার্থক শব্দ করে বোল্টকে জানিয়ে দেওয়া হোক। রোড টু অমরত্বে নিজের প্রাপ্তির হিসেব কষতে গিয়ে নিশ্চয়ই অাপ্লুত হবেন তিনি! অামরাও দেখব ভিন্ন এক বোল্টকে। তার অমরত্বের পথে কত কি’ই তো অদেখা অামাদের।