স্বরূপে সড়ক

স্বরূপে সড়ক

ইটিং সিটিং-মিটিংয়ের পরে আবার সবকিছু আগের মতোই। নিরাপদ সড়ক নিয়ে গঠিত আপাত দৃষ্টিতে সক্রিয় তিনটি কমিটির প্রধান সেতু ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এই সব কমিটি নিয়মিত বৈঠকে বসছে। অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ। অনেক কথাও হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্যই থেকে যাচ্ছে। হতাশা ছাড়া আর কিছুই যোগ হচ্ছে না জনমনে।

নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলনে নেমেছিল, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। সেই আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। অনেকে এখনও কারাগারে। রিমান্ডে নিয়ে তাদের নির্যাতন হচ্ছে। ফেসুবকে যারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সমর্থনে সক্রিয় ছিলেন কথিত গুজবের অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এই গ্রেফতারের তালিকায় আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান লেখক-সাংবাদিক থেকে চিত্রতারকা এমনকি সাধারণ গৃহবধুও রয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে হুট করে এই আন্দোলন দমনের জন্য পুরনো আইনের প্রায় সব কিছুই বহাল রেখে একটু এদিক-সেদিক করে প্রণয়ন করা হয়েছে নতুন সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া; যা সংসদে পাশের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এই আইনের ফলে সড়ক পরিস্থিতির কোন উন্নতি যে হবে না তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। আন্দোলন চলাকালে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকায়। রাস্তা থেকে শিক্ষার্থীরা উঠে যাওয়ার পরপরই আবার সড়ক ফিরতে শুরু করেছে তার চিরাচরিতরূপে। অনিয়মের সবই রয়েছে বহাল তবিয়তে। এতো গেল রাজধানী ঢাকার চিত্র। অন্যদিকে মহাসড়কের করুন দশা যেন দিনকে দিন প্রকট হচ্ছে।

এবারের ঈদে বাড়ি ফেরার দৃশ্য দেখে এটা পরিস্কার সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকা থেকে বের হওয়ার প্রতিটি মহাসড়কে অসহনীয় যানজট তৈরি হচ্ছে। অসহ্য গরমে সাধারণ যাত্রীরা ভয়ানক যন্ত্রণা সহ্য করে বাড়ির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ছেন। অথচ সড়কের বহুবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য বিষেশজ্ঞ, মন্ত্রী, পরিবহন নেতাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক কমিটি। কমিটির নানান পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচারও হয়। কিন্তু সড়কের কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যায় না।

সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ৭ জন মানুষ সড়কে প্রাণ হারান। বলা ভালো সড়ক হত্যার শিকার হন।  বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসেব বলছে এই পরিসংখ্যান বাস্তবতার চেয়ে অনেক কম। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি।  তাদের ভাষ্যমতে, সড়কে অনেক হত্যার খবর মিডিয়াতে ঠিক মতো প্রচারিত না হওয়ায় সব সময় সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না। এমনকি কোন এক ভৌতিক কারণে সড়কে নিহতের গ্রহণযোগ্য কোন সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানও পাওয়া যায় না।  ডাব্লিউএইচও’র ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৩ সালে সড়কে নিহতের সংখ্যা  ১৭,৩৪৯ থেকে ২৫, ২৩৮ এর মধ্যে। এইসব প্রতিবেদন পরিসংখ্যান দেখে অনেক বড় বড় কমিটি হয়, অনেক কথা উচ্চারিত হয় কিন্তু কোন ফলাফল দেখা যায় না। ১৯৮৩ সালে প্রথম সড়ক পরিবহন আইন করা হয়। এবং ১৯৮৫ সালে গঠিত হয় রোড ট্রান্সপোর্ট এডভাইজারি কাউন্সিল। এই কমিটি এই পর্যন্ত ৪১টি মিটিং করেছে।  বর্তমানে এর প্রধান সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এরকম আরও কয়েকটি সক্রিয় জাতীয় কমিটি আছে। সেই সব কমিটির সুপারিশের মধ্যে, আছে বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধ করা, অবৈধ গাড়ি বন্ধ করা। ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা। অবৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স বন্ধ করাসহ নানান সুপারিশনামা। কিন্তু এইসব সুপারিশ চলছে একদিকে, অন্যদিকে সড়কের অবস্থা দিন দিন খারাপই হচ্ছে। এবং এইসব কমিটি ও সংগঠনের মূল হিসেবে আছেন সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরাই।

সরকারি ভাষ্যের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, সব কিছুতেই মৌখিক সমাধান এমনকি প্রতিশ্রুতিও দেয়া হচ্ছে জনগণের সাথে। কিন্তু কার্যত পরিস্থিতি যা তাই থাকছে বা তার চেয়ে অবনতি হচ্ছে। সড়ক আন্দোলন থামাতে সরকার সব দাবি মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরেও ঢাকাসহ সরার দেশের সড়ক ব্যবস্থার চিত্র একই আছে। অবৈধ গাড়ি, ফিটনেস ছাড়া গাড়ি, ভুয়া লাইসেন্সধারী ড্রাইভার সবই আবার ময়দানে। আবার আগের রূপে ফিরে গেছে ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা। এই অবস্থায় জনগণ অসহায় হয়ে কেবল দিন গুনছেন আর কোন অলৌকিক শক্তির অপেক্ষায় আছেন, এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য।