“All were happy — plants, birds, insects and children. But grown-up people — adult men and women — never left off cheating and tormenting themselves and one another. It was not this spring morning which they considered sacred and important, not the beauty of God’s world, given to all creatures to enjoy — a beauty which inclines the heart to peace, to harmony and to love.”
—Leo Tolstoy on Resurrection
সমাজ একটি বৃহত্তর বিষয়। রাজনীতি সমাজের অন্য সব কার্যক্রমের একটি অংশমাত্র। সমাজ আমাদের সামগ্রিক জীবনযাপনের পরিধি। সমাজের লালিত স্নেহে-আদরে আমাদের বেড়ে ওঠা। সমাজের যত্নে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ। সমাজ সংস্কৃতিতে আমাদের কর্মজীবন অতিবাহিত। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত আমরা সমাজের নিগড়ে বাধা। রাজনীতি একটি সামাজিক দায়িত্ব। সমাজের সবাইকে মানবিক ও কল্যাণকামী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই নাগরিক দায়িত্ব। সরকারের ভিত্তি হচ্ছে জনগণের সম্মতি।
মার্কসীয় তাত্ত্বিক লুইস আল থুসার সামাজিক সম্পর্ককে তিন ভাগে ভাগ করেছেন- অর্থনৈতিক, আদর্শিক ও রাজনৈতিক। এ তিনটি মাত্রার কারণে সমাজে একজনের সাথে অপরজনের সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। অপরদিকে সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্থনি গিডেন্স সমাজকে দেখতে চান এক ও অভিন্নভাবে। তিনি জাতীয় রাষ্ট্রের পরিচয়কে বড় করে দেখতে চান। তার সমাজের পরিধি রাষ্ট্রের সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত। আজকের বৈশ্বিক ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী’। তাই বলা হয় ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। তথ্য বিপ্লবের কারণে আমাদের সমাজ গ্রাম থেকে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত। আল্লামা ইকবালের ভাষায়, ‘সামাজিক জীবন ব্যক্তির কাছে এক আশীর্বাদ। এর পূর্ণতা লাভ করে সমাজ বন্ধনে।’
মানব ইতিহাসে এমন একটি সময় ছিলো যখন মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ছিলো না। তখন রাষ্ট্র ও সরকারের কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। তখন মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো ও নিজ খেয়ালখুশি মতো পরিচালিত হতো। দুর্বলের ওপর সবল অত্যাচার করলে, দুর্বলকে রক্ষা করার জন্যে কোনো আইনসম্মত ব্যবস্থা ছিল না। এভাবে প্রকৃতির রাজ্যে অসুবিধা সৃষ্টি হওয়ায় পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে ‘ সামাজিক চুক্তি’ মতবাদ নামে পরিচিত।অর্থাৎ এ মতবাদের আসল কথা হচ্ছে একটা চুক্তির মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যকার এক চুক্তি।
এসব তাত্ত্বিক ধারণাসত্ত্বেও বাস্তবতা এই যে, আমরা বায়বীয় ঠিকানায় বসবাস করিনা। আমরাপাড়া, মহল্লা, গ্রাম, উপজেলা ও জেলায় বসবাস করি। আমরা যখন সমাজের কথা বলি, তখন আমার ঠিকানার পরিপার্শ্বের কথাই বলি। আমি যেখানেই থাকি, সেটা হতে পারে অস্থায়ী কিংবা স্থায়ী- সেটিই আমার সমাজ। গ্রাম কিংবা শহরে- এই সমাজের একটি অলিখিত বিধিবিধান রয়েছে। আমরা যারা সমাজে বাস করি, তারা ইচ্ছায় হোক অথবা অনিচ্ছায়- এই সমাজের নিয়ম কানুনের ব্যতিক্রম করতে পারিনা। প্রতিপালিত এই নিয়ম কানুনের মাধ্যমে একটি সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনাত্মীয় হয়ে ওঠে পরমাত্মীয়। পাশের বাড়ির অচেনা মানুষটিকে আত্মীয়তার আদলে আপন করে নিই।
মানব ইতিহাসে এমন একটি সময় ছিলো যখন মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ছিলো না। তখন রাষ্ট্র ও সরকারের কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। তখন মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো ও নিজ খেয়ালখুশি মতো পরিচালিত হতো। দুর্বলের ওপর সবল অত্যাচার করলে, দুর্বলকে রক্ষা করার জন্যে কোনো আইনসম্মত ব্যবস্থা ছিল না। এভাবে প্রকৃতির রাজ্যে অসুবিধা সৃষ্টি হওয়ায় পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে ‘ সামাজিক চুক্তি’ মতবাদ নামে পরিচিত।অর্থাৎ এ মতবাদের আসল কথা হচ্ছে একটা চুক্তির মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যকার এক চুক্তি।
সমাজের বিবর্তনে মানুষের সচেতন ইচ্ছার উপর গুরুত্বারোপ ও ব্যক্তিকে তার স্বাভাবিক অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকন করায় এ মতবাদ অনেক চিন্তাবিদের মধ্যেই আবেদন সৃষ্টি করে। জন লক, টমাস হবস, জঁ-জাক রুশো প্রমুখ এ চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন। তবে এ চুক্তির কারণ বিশ্লেষণে তাদের মাঝে মতভিন্নতা রয়েছে। ১৭শ ও ১৮শ শতকে এ ধারণা পাশ্চাত্য দর্শন ও রাষ্ট্র চিন্তায় জনপ্রিয়তা লাভ করলেও প্রাচীন গ্রিসের সফিস্ট এবং চীনের মোজুর দর্শনেও এর আভাস পাওয়া যায়।
রাজতন্ত্র ও সামন্তবাদের বিপরীতে রেনেসাঁ-উত্তর সময়কালে ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণী সামাজিক চুক্তির তত্ত্বকে একটি আদর্শগত ব্যাখ্যা হিসাবে দাঁড় করায়। কারণ একদিকে এটা ছিল ধর্মতাত্ত্বিক স্বর্গীয় অধিকারের যুক্তিসংগত বিকল্প এবং মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শাসন বাবস্থাকে আলোচনা সমালোচনা করার একটা যুৎসইহাতিয়ার।অপরদিকে গণতন্ত্রের বাতাবরণে রাজার সার্বভৌম কতৃত্ব খর্ব করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্ষমতায়নের তাত্ত্বিক ভিত্তি। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স সহ ইউরোপীয় দেশগুলিতে এ চিন্তাধারার প্রভাব গণবিদ্রোহের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে এবং আধুনিক গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার উন্মেষ ঘটায়।
২.
সামাজিক চুক্তিকেও একটা অকাট্য দলিল ও রাষ্ট্রীয় বিধি হিসেবে কিন্তু সকলে মেনে নেন নি। এই মতবাদের জন্ম থেকেই এই তত্ত্বে সমালোচনা হয়েছে প্রচুর। সমালোচকগন সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিরুদ্ধে প্রথমত: যে অভিযোগ উত্থাপন করেন তা হল, এ মতবাদের পক্ষে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়ত: কোন একটি বিশেষ সময়ে কিছু মানুষ চুক্তি করে সমাজ গঠন করলেও পরবর্তি প্রজন্ম যে সেটা অনুসরণ করছে সেটারও কোন যুক্তি নেই।ডেভিড হিউম সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিপরীতে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, পরিবারের ধারনার মধ্য দিয়েই সমাজ গড়ে উঠে ছিল। স্বাভাবিক জৈবপ্রবৃত্তি বশত নারী-পুরূষ একত্রিত হয়েছে, আর সেটাই সমাজ উৎপত্তির আদি কারণ।পরিবার সমাজের ক্ষুদ্রতম একক। পারিবারিক একত্রে থাকার সুবিধা মানুষকে বৃহত্তর পরিসরে সমাজের চিন্তা বিকাশে সাহায্য করেছে। এমনি করে অনুভূত প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক সমাজ, সামাজিক চুক্তি প্রভৃতি কল্পনা মাত্র, যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। সমাজের মত সরকার ব্যবস্থার ভিত্তিও প্রয়োজনের অনুভুতি। ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার প্রয়োজনেই সরকারের উদ্ভব।
এমনকি সামাজিক চুক্তির পক্ষের তাত্ত্বিকদের নিজেদের মতবাদ এতো দুরগামী যে সেগুলকেও আমরা সমালচনার কাতেরেই রাখতে পারি। টমাস হবস তার Leviathan গ্রন্থে সামাজিক চুক্তির পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। তার মতে: আদিম সমাজ ছিল বর্বরোচিত, যেখানে অধিকার বা ন্যায়ের ধারণা ছিল অনুপস্থিত, এবং আইনের ভিত্তি ছিল শক্তিপ্রয়োগ ও প্রতারণা। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে মানুষের মাঝে যুক্তিশীলতার উন্মেষ ঘটায় পরস্পরের সাথে এ মর্মে সমঝোতায় উপনীত হয় যে, একজন ঠিক যতটুকু স্বাধিনতা বা অধিকার ভোগ করবে যতটুকু স্বাধিনতা বা অধিকার সে অন্যকেও দিতে প্রস্তুত আছে। এর ভিত্তিতে একত্র হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের যে চুক্তি সম্পাদিত হল তা একটি সার্বভৌম ক্ষমতার সুচনা করে;— সে ক্ষমতা একজন ব্যক্তির বা গোষ্টির হতে পারে। এভাবে শান্তির নিশ্চয়তা প্রয়াসী মানুষ তাদের প্রাকৃতিক অধিকারকে একটি ক্ষমতার কাছে হস্তান্তর করে যা ব্যক্তিমানূষকে নিরাপত্তা প্রদান করে ও সমাজকে সাধারণ কল্যাণের দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি বা দল এ ক্ষমতা লাভ করে সে এই চুক্তির কোন পক্ষ নয়, বরং চুক্তির ফল। উল্লেখ্য যে, হবস কোন বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনায় সামাজিক চুক্তির দ্বারা রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে তার ওপর গুরুত্ব দেননি; বরং প্রাকৃতিক রাষ্ট্রকে তিনি দেখতে চেয়েছেন সমাজ রাষ্ট্রের যুক্তিপূর্ণ পূর্বাবস্থা হিসাবে।
রাষ্ট্র ও জনগণের সামাজিক চুক্তি দ্বিপাক্ষিক। জনগণ যেমন সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রগঠন করে আর সরকারকে পোষে, তেমনি সরকার বা রাষ্ট্র যদি চুক্তি ভঙ্গ করে অত্যাচারী হয় আর শোষণ করে জনগণ সেই চুক্তি যেকোন সময় ভেঙে ফেলতে পারে। রাষ্ট্র সেটাকে নৈরাজ্য নাম দিলেও তা হবে নতুন রাষ্ট্র গঠনের এক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে রাষ্ট্রের সাথে জনগণের চুক্তি কি অবস্থায় আছে সেটা স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরের মাথায় আবার নতুন করে বিবেচনার সময় এসেই গেছে।
জন লক সামাজিক চুক্তির বিকাশের প্রশ্নে হবসের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন, যদিও তিনি মনে করতেন রাজনৈতিক সমাজ গঠনের পূর্বে মানুষ বাস করত প্রকৃতির রাজ্যে। তবে তার মতে প্রাকৃতিক রাষ্ট্রে শান্তি ও যুক্তির সহাবস্থান ছিল, এবং মানুষেরা নিরন্তর বিবাদে লিপ্ত ছিল না বরং স্বাভাবিক বুদ্ধি দ্বারাই পরিচালিত হত। এটা প্রাক-সামাজিক নয় বরং প্রাক-রাজনৈতিক। এটা আইনশূন্যও ছিলনা কারণ মানুষ প্রাকৃতিক আইনের অধীনে বাস করত, যেখানে সকলে স্বাধীন ও সমান, স্বাধীন হলেও তারা স্বেচ্ছাচারী ছিল না।[২]কিন্তু নানা কারনে প্রকৃতির রাজ্যে স্বাভাবিক আদর্শ থেকে মানুষের বিচ্যুতি ঘটলে সমান অধিকার ভোগ করতে বঞ্চিত হয়। ফলে ব্যক্তিগত স্বাধিনতা ও অধিকার রক্ষার জন্য তারা সুসংহত সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। যদিও প্রত্যেকে স্বাধীন স্বনির্ভর ও সামান, তবু ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থেই সেচ্ছায় সর্বসম্মতভাবে একটি চুক্তিতে আসে।লক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবেই চুক্তিকে দেখতে প্রয়াসী ছিলেন। তাঁর মতে: যদিও নথিপত্রে এমন চুক্তির হদিস পাওয়া যায় না তবু নথিতে নেই এমন অনেক ঘটনাই বাস্তব। এ চুক্তিকে এরূপ একটা ঘটনা বলে মনে করা যেতে পারে।
৩.
সামাজিক চুক্তির উপরে সবচেয়ে বিখ্যাত বই লিখেছেন রুশো। দ্যু কোঁত্রা সোসিয়াল (Du Contrat social) ( সামাজিক চুক্তি) অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক জঁ-জাক রুশোর রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ। আধুনিক সভ্যতার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থের এর বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান। রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন ও নীতি ইত্যাদি এই গ্রন্থের প্রধান প্রধান উপজীব্য। রুশোর নানা যুগান্তকারী গ্রন্থের মধ্যে এটি সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী। আধুনিক গণতন্ত্রের প্রায়োগিক বিষয়গুলির ওপর তিনি মৌলিক আলোকসম্পাত করেছেন।
১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থে রুসো এমন কতগুলি সামাজিক সত্যকে উদ্ঘাটিত করার চেষ্টা করেছেন যে সত্যগুলি বর্তমানে সাধারণ স্বীকৃত সত্য বলে মনে হলেও সেকালে এই সত্যগুলির উদ্ঘাটন ছিল যথার্থই বিপ্লবী। এই বইটিকে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শসমূহের অন্যতম উজ্জীবক গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি প্রকাশের পর ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদগণ রুশোর প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন।
জীবনের এক পর্যায়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্যারিস ত্যাগ করতে বাধ্য হন রুশো। এসময় মঁমরাঁসির বনভূমির উপকণ্ঠে লুক্সেমবুর্গের ড্যুকের (Duke of Luxemburg ) একটি বাসগৃহে অবস্থানকালে তিনি অন্য কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে এ গ্রন্থটিও রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটি প্রকাশ করেন ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দ। রাষ্ট্রতন্ত্র সম্পর্কে বইটির বিপ্লবাত্মক ধারণার কারণে ফরাসী রাজ রুষ্ট হতে পারে এই আশঙ্কায় রুসো এটি প্যারিসের পরিবর্তে অ্যামস্টারডাম থেকে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন যদিো তাতে শেষ রক্ষা হয় নি। বস্তুত: রুসোর কঁত্রা সোসিয়াল তৎকালীনফ্রান্সেরমানুষেরচিন্তা-চেতনাকেগভীরভাবেনাড়াদিতেসক্ষমহয়েছিলযারফলে ফরাসী বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। বইটি পৃথিবীর ৩৬টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
দ্যু কোঁত্রা সোসিয়াল চারটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে ৯ অধ্যায়ে রুশো যে বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন সেগুলির মধ্যে আছে আদিম সমাজের শাসন ব্যবস্থা, দাসপ্রথা, সার্বভৌম কে, সুশীল রাষ্ট্র, প্রকৃত সম্পত্তি ইত্যাদি। দ্বিতীয় পর্বে ১২টি বিষয়ের আলোচনা করেছেন যেগুলির মধ্যে আছে সার্বভৌমত্বের অবিচ্ছেদ্যতা, সার্বভৌমত্বের অখণ্ডতা, জনসাধারণের অভিপ্রায় কি অপরাজেয়, সার্বভৌম ক্ষমতার সীমানা, জীবন ও মৃত্যুর অধিকার, আইনের উৎসওচৌহদ্দি, আইনপ্রণেতার দায়-দায়িত্ব, জনসাধারণের অধিকার, আইন প্রণয়নের বিবিধ পদ্ধতি ইত্যাদি।
গ্রন্থের তৃতীয় পর্বে রুশো ১৮টি বিষয় নিয়ে সুচিন্তিত মত তুলে ধরেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে সরকারের রূপরেখা, বিভিন্ন রকম সরকার ব্যবস্থার গাঠনিক নীতিমালা, গণতন্ত্র, স্বৈরচারী সরকার ব্যবস্থা, রাজতন্ত্র, মিশ্র সরকার ব্যবস্থা, সব সমাজের (দেশের) জন্য সব রকম সরকার ব্যবস্থার অনুপযোগিতা, সুসরকারের চারিত্র্য লক্ষণ, সরকারের বখে যাওয়া, রাজনীতিবিদদের মহামারী, সার্বভৌম কর্তৃত্বের স্বরূপ, জনসাধারণের প্রতিনিধি, প্রতিষ্ঠান হিসাবে সরকার কি একটি চুক্তি, কীভাবে সরকারের উৎখাতঠেকানোসম্ভবইত্যাদি।
এই গ্রন্থের চতুর্থ তথা অন্তিম পর্বে রুসো ৮টি বিষয়ের ওপর আলোসম্পাত করেছেন, নবম অধ্যায় উপসংহার। যে সকল বিষয়ের ওপর শেষ পর্বে আলোচনা করা হয়েছে তার মধ্যে আছে জনগণের অভিপ্রায়ের অবিনশ্বরতা, নাগরিকের ভোটাধিকার, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন, একনায়কতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, সরকারের সেন্সরশিপের খড়গ,ইত্যাদি।
রুশোর মতে মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের যথাযথ নীতিসূত্র বর্ণনার পর এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের ভিত্তি কী হবে তা বলার পর যা প্রয়োজন তা হলো এই দুইয়ের অনুক্রমে আন্তর্জাতিক আইন, বাণিজ্য, যুদ্ধের অধিকার, জাতিসংঘ, আলোচনা চুক্তি ইত্যাদি বিষয়ক নীতিনির্ধারণী কাঠামো প্রণয়ন। এইসব সম্পূর্ণ নতুন একটি জগৎ বিধায়তিনিতিনিএইগ্রন্থেআলোচনারজন্যঅন্তর্ভুক্তকরেননি।
কঁত্রা সোসিয়াল গ্রন্থটিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন রুসো। এছাড়া রাষ্ট্রতন্ত্রের মৌলিক নীতি হিসাবে মানুষের স্বাধীনতা, সমতা ও ভাতৃত্ব এই তিনটি সূত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এই নীতিসূত্রগুলি পরবর্তীকালে সংঘটিত ফরাসী বিপ্লবের বীজমন্ত্র হিসাবে কাজ করেছিল। সামাজিক চুক্তি দ্বারা জনগণের অর্থাৎ নাগরিকেরসঙ্গেরাষ্ট্রেরচুক্তিরকথাবুঝিয়েছেনরুসো। এমন একটি রাষ্ট্রতন্ত্রের দাবী করেছিলেন যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা জনগণের স্বাধীনতা হরণ করবে না। এগুলিই আধুনিককালের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। রুসো রাষ্ট্রক্ষমতার ভারসাম্য আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন যাতে সমাজ দুর্নীতি ও অবিচার থেকে সুরক্ষিত থাকে এবং মানুষ একই সঙ্গে সুখী ও সৎ হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
রুসোর মতবাদ প্রাকৃতিক সাম্য ধারনার উপর নির্ভরশীল, যেখানে মানুষ মাত্রই সমান, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তৃপ্ত। মানবিক জ্ঞানের উন্নতি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে শ্রমের শ্রেণীবিভক্তি সুচিত হয় এবং মানব জাতির প্রাকৃতিক সুখকর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ধনী-দরিদ্র বিভাজন সৃষ্টিকরে, পরিণতিতে রাষ্ট্রী সমাজ অত্যাবশ্যক হয়ে যায়।
রাষ্ট্রগঠন সম্পর্কে মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী রুশো বলেন:
“সমাজ গঠনের এমন একটা আদর্শ থাকতে হবে যাতে সমাজভুক্ত সকল ব্যক্তির জীবন ও সম্পদ সমাবেত শক্তির সাহায্যে নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে এবং প্রত্যেকে পরস্পরের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় আপন আদেশই পালন করবে ও আগের মতই স্বাধীন থাকবে”
অর্থাৎ এই চুক্তির ফলে এর ফলে সামাজিক চুক্তি বিকশিত হয়। এ চুক্তি কেনো নিরঙ্কুশ শাসক তৈরি করে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার সমস্ত অধিকারকে সামাজিক চুক্তির দ্বারা সমষ্টির নিকট সমুদয়ভাবে সমর্পণ করে। মানুষ বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তির জন্য চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। আবার সকল নাগরিক একটা সার্বভৌম কাঠামোর সমান অধিকারী হিসাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অধীনে তা পুনরায় লাভ করে। প্রত্যেকে নিজেদেরকে সমর্পন করবে অথচ ব্যক্তিগত ভাবে কারো কাছে নত হবে না। ক্ষমতা এখানে ব্যক্তিবিশেষের নয় পরস্পরের।
ব্যক্তি অর্থাৎ নাগরিক রাষ্ট্র গঠনের স্বার্থে নিজ স্বাধীনতা কিছুটা বিসর্জন দেয়—কিন্তু তাই বলে সে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিগ্রহের শিকার হতে পারে না। রুশোর সাধারণতন্ত্র রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা এমন হবে যাতে রাষ্ট্রক্ষমতা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির শোষণ, অন্যায়, জবরদস্তি, নির্যাতন ও নির্বিচার দুর্নীতির হাতিয়ারে পরিণত না হয়।
রুশোর মতে, প্রকৃতি মানুষকে যেভাবে ও যে উদ্দেশ্যে গড়ে, সমাজের দোষে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। ললিতকলা ও বিজ্ঞানের বেদীমূলে সৃষ্ট সভ্যতার উপর তাঁর কোন আস্থা ছিল না। মানব উৎকর্ষের সাথে শিল্পকলাও বিজ্ঞানের বিকাশ সম্পর্কিত রেনেসাঁস ও আলোকময়তা মতবাদের সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করে রুশো বলেন:
সমাজ ও সমাজের বিলাসিতা থেকেই জন্ম নেয় মানববিদ্যা, প্রযুক্তি, ব্যবসাবাণিজ্য, পাণ্ডিত্য এবং সেই সব বাহুল্য যা শিল্পের বিকাশ ঘটায় কিন্তু একই সাথে সমাজকে সমৃদ্ধ ও ধ্বংস করে…বিখ্যাত জাতিসমূহের প্রাচুর্য তাদেরকে যে ক্লেদাক্ত দুঃখ-দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয় এই হচ্ছে তার কারণ। একদিকে শিল্প ও মানববিদ্যা যতই উন্নতি লাভ করে, অন্যদিকে করের বোঝায় জর্জরিত শ্রমে-ক্ষুধায় কাতর অনাদৃত কৃষক ততই রুজির সন্ধানে শহরমুখী হয়। আমাদের নগরগুলি যতই দৃষ্টিনন্দন হয় ততই গ্রামাঞ্চল বিরান হতে থাকে। অনাবাদী জমির পরিমাণ বাড়ে। নাগরিক হয় ভিখারি বা ডাকাত, আর ওদের জীবনের ইতি হয় ফাঁসির মঞ্চে বা আবর্জনাস্তুপে। এভাবে রাষ্ট্র একদিকে ফুলেফেঁপে ধনী হয়, অন্যদিকে হয় জনশূন্য বিরান। প্রবল প্রতাপ, সাম্রাজ্য এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলে সমৃদ্ধির সৌধ আর ডেকে আনে জনজীবনে অবলুপ্তি।
রুশো “আদি পাপে” (Original sin) বিশ্বাস করতেন না। তাঁর মতে মানুষের দুর্দশা ও দুর্বলতার কারণ আদি পাপ নয়, বরং এটা হয়েছে তার আপন প্রকৃতির সাথে পরিবেশের দ্বন্দ্ব্ব এবং অসঙ্গতির ফলে। মানুষ জন্মসূত্রে যে সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তা অর্জনের প্রয়াস থেকেই তার মাঝে দেখা দেয় চাহিদা ও উচ্চাকাঙ্খা। অন্তহীন সে চাহিদা পূরণে অন্যের সাথে সে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত হয়। সমকালীন সমাজ কাঠামো ব্যাক্তির বিকাশের পথে অন্তরায়, যা মানুষকে মানুষের মুখোমুখি করে দেয়, তাকে দ্বন্দ্ব্বে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। আদিম মানুষ ছিল স্বচ্ছন্দ, সুখী ও আত্মসমাহিত। সঞ্চিত রাখার মতো সম্পদ ছিল না বলেই আদিম মানুষের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব্ব ছিল না।
৪.
জগত বা সত্যের ক্ষেত্রে জ্ঞেয় ও অজ্ঞেয়’র দ্বৈত রূপ হেগেল অস্বীকার করলেও তাঁর নিকট মূল হচ্ছে ভাব; বস্তু নয়। যা কিছু জ্ঞেয় বা দৃশ্যমান সবই হচ্ছে ভাবের প্রকাশ ও বিকাশ। এছাড়া ভাবের চরম বিকাশ জার্মান রাষ্ট্রযন্ত্রে ঘটেছে বলে হেগেলের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের আদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পেরেছে। বস্তুত হেগেল দর্শন থেকে উত্তরকালে দুটি পরস্পরবিরোধী ধারার বিকাশ ঘটেছে; এর একটি হচ্ছে মার্কসবাদ বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আর অন্যটি হচ্ছে নবভাববাদ ও স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতবাদ।
যে পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে তাহচ্ছে একটি “সামাজিক চুক্তি” (Social Contract)। এ চুক্তি কেনো নিরঙ্কুশ শাসক তৈরি করে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার সমস্ত অধিকারকে সামাজিক চুক্তির দ্বারা সমষ্টির নিকট সমুদয়ভাবে সমর্পণ করে। আবার সকল নাগরিক একটা সার্বভৌম কাঠামোর সমান অধিকারী হিসাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অধীনে তা পুনরায় লাভ করে। প্রত্যেকে নিজেদেরকে সমর্পণ করবে অথচ ব্যক্তিগতভাবে কারো কাছে নত হবে না। ক্ষমতা এখানে ব্যক্তিবিশেষের নয়, পরস্পরের। এভাবে একক ব্যক্তির ইচ্ছা সামষ্টিকভাবে একটি “সাধারণ ইচ্ছায়” (General will) পরিনত হয়। এই সাধারণ ইচ্ছাই রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের নিয়ামক। রাষ্ট্র হচ্ছে পূর্ণ রাজনৈতিক সংস্থা, সর্বোচ্চ এবং সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ, আর সরকার হচ্ছে সাধারণ ইচ্ছাকে কার্যকরী করার জন্য সম্প্রদায়ের দ্বারা নির্বাচিত লোকের সমষ্টি।
ব্যক্তি অর্থাৎ নাগরিক রাষ্ট্র গঠনের স্বার্থে নিজ স্বাধীনতা কিছুটা বিসর্জন দেয়—কিন্তু তাই বলে সে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিগ্রহের শিকার হতে পারে না। রুশোর সাধারণতন্ত্র রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা এমন হবে যাতে রাষ্ট্রক্ষমতা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির শোষণ, অন্যায়, জবরদস্তি, নির্যাতন ও নির্বিচার দুর্নীতির হাতিয়ারে পরিণত না হয়। কঁত্রা সোসিয়াল গ্রন্থে রুশো রাষ্ট্রগঠনের ঝুঁকির সূত্রে রাষ্ট্রের সম্ভাব্য নিপীড়নমূলক ভূমিকার হাত থেকে নাগরিক ও সমাজকে উদ্ধারের পথপ্রদর্শন করেছেন।
জ্যা জ্যাক রুশো বইয়ের উপসংহারে এ কথা মনে করিয়ে দেন যে, রাষ্ট্র ও জনগণের সামাজিক চুক্তি দ্বিপাক্ষিক। জনগণ যেমন সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রগঠন করে আর সরকারকে পোষে, তেমনি সরকার বা রাষ্ট্র যদি চুক্তি ভঙ্গ করে অত্যাচারী হয় আর শোষণ করে জনগণ সেই চুক্তি যেকোন সময় ভেঙে ফেলতে পারে। রাষ্ট্র সেটাকে নৈরাজ্য নাম দিলেও তা হবে নতুন রাষ্ট্র গঠনের এক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে রাষ্ট্রের সাথে জনগণের চুক্তি কি অবস্থায় আছে সেটা স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরের মাথায় আবার নতুন করে বিবেচনার সময় এসেই গেছে।
দোহাইঃ
- মো. আবদুল ওদুদ (২nd Edition, ২০১৪)। রাষ্ট্রদর্শন। ঢাকা: মনন পাবলিকেশন।
- A. Leigh, Unsolved Problems in the Bibliography of J.-J. Rousseau, Cambridge, 1990, 3. Rousseau, Jean Jacques (১৭৬২)। Du contrat social: Book One Chapter Six the social compact