সম্প্রতি লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এর একটা পর্যালোচনা হাজির করেছিলাম। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ঠিক এই সময় এই পর্যালোচনা কেন?
সত্য কথা বলতে কি, আমার মনে হচ্ছে কাজটি সঠিক সময়েই প্রকাশ পেল। রাষ্ট্র ও তার ‘মেরামত প্রক্রিয়া’ নিয়ে বাংলা ভাষায় রাষ্ট্রনৈতিক আলোচনার জন্য এর চেয়ে আর ভালো কোন সময় কল্পনা করতে পারছি না। খোদ তরুণ সমাজ এখন এদেশে রাষ্ট্রের রূপান্তর নিয়ে ভাবতে চাইছে। নিঃসন্দেহে এইরূপ আলোচনার জন্য এটাই বহুল প্রতীক্ষার পর পাওয়া দরকারি এক লগ্ন।
১৯১৮ সালে লেনিন ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ লিখেছিলেন। সেই হিসাবে লেনিনের গ্রন্থটির এক শ’ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর। ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটি প্রলুব্ধ করেছিল; তাই গ্রন্থটি পর্যালোচনায় হাত দিয়েছিলাম কয়েক মাস পূর্বে। অতঃপর কাজটি ছাপা হয়ে বের হলো প্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ থেকে। কিন্তু এই অনুশীলনটিকে শুধু অনুরূপ আরেকটা একাডেমিক কাজের মতো দেখতে চাই না। বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা ও চর্চার যে প্রসব বেদনা চলছে তাতে রাষ্ট্রচিন্তার পর্যালোচনাকে জরুরি ব্যবহারিক কাজ হিসেবেই মনে করেছি। সেভাবেই পাঠকের কাছে তা নিবেদন করতে চাই।
দুই.
এই গ্রন্থ মূলত লেনিনের রাষ্ট্র-ভাবনার পর্যালোচনা। যে গ্রন্থটি বিশ্বের প্রায় সকল প্রধান ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এবং যা দুনিয়াজুড়ে রূপান্তরবাদী একটিভিস্টদের গত দশ দশক ধরে পথ দেখিয়ে চলেছে। আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে বোঝা ও তার সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য লেনিনের চেয়ে আর তীক্ষ্ণ এবং যথার্থ কিছু এখনও বিরল। ফলে চলতি ব্যবহারিক ও একাডেমিক রাষ্ট্রবিদ্যায় লেনিন আরও বহুকাল আলোচিত হতে থাকবেন। বাংলাদেশের তরফ থেকে আমাদের সেই আলোচনায় হাজির থাকা জরুরি বৈকি।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থান-পতন-নীরবতা-আশাবাদ-সক্রিয়তাও আসলে আমাদের সেই একই কথা বলছে যে, নতুন এক রাষ্ট্রচিন্তা হাজির না করে এবং তাকে সামনে রেখে একটিভিজমের পুনর্বিন্যাস ছাড়া প্রকৃত মুক্তি সুদূরপরাহত।
বর্তমান আলোচনাটি সহজবোধ্য করার লক্ষ্যে উপস্থাপিত হয়েছে- প্রশ্ন-উত্তর আকারে। লেনিন রাষ্ট্রের চরিত্র, তার রূপান্তর ও বিনাশ প্রক্রিয়া নিয়ে কী বলেছেন তা ৩০-৪০টি প্রশ্নোত্তর আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে। প্রতিটি প্রশ্নোত্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত এক শত বছরের পরিবর্তনবাদী চিন্তা ও সংগ্রামের বৈশ্বিক অগ্রগতি ও অভিজ্ঞতার কিছু নির্যাসও। ফলে এই গ্রন্থ কেবলি লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থের একটি সাধারণ পর্যালোচনা আকারে নেই আর। গত এক শতাব্দিতে বৈপ্লবিক রাষ্ট্রচিন্তায় বিশ্বজুড়ে কী কী প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে তারও একটি সরেজমিন তদন্ত আছে এতে। বিশেষ করে মার্কসীয় চিন্তার বিভিন্ন ধারা এবং অ্যানার্কিস্ট রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে তার বিতর্কের মৌলিক দিকগুলোর চুম্বকচিত্রও এতে সংযোজিত হয়েছে।
আপাতত সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিতর্কগুলো হাজির করা হচ্ছে। তরুণদের কাছ থেকে এই পরিশ্রম কিছু মত ও ভিন্নমত প্রত্যাশা করছে। যা ভবিষ্যতে রূপান্তরবাদী রাষ্ট্রচিন্তার আরও বৃহত্তর পর্যালোচনার অনুপ্রেরণা হিসেবে ভূমিকা রাখবে।
তিন.
জ্ঞানের সকল শাখাতেই এমন এক মুখ্য আলোচ্য বিষয় থাকে যাকে বাদ দিয়ে ঐ শাস্ত্রের আলোচনা-পর্যালোচনা এগোয় না। রাজনীতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্র’ সেরকম এক প্রসঙ্গ। আগেই বলেছি, বিশ্বব্যাপী, অতীতে এবং এখনো রাজনৈতিক কর্মী ও ভাবুকদের কাছে লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ একটি মৌলিক প্রয়োজনীয় গ্রন্থ হিসেবে বিবেচ্য। এটা অনেকটা মার্কসের রচনাবলীর মাঝে ‘ক্যাপিটাল’-এর গুরুত্বের মতোই। যাকে রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে লেনিনের প্রধানতম তাত্ত্বিক অবদান হিসেবে গণ্য করা যায়। যা আজও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। তবে বিশ্বকে প্রতিনিয়তই আদর্শিক উত্তরাধিকার পর্যালোচনা করতে হবে ভবিষ্যতের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের লক্ষ্যে। প্রতিরোধী দর্শন হিসেবে লেনিন পাঠ তাই active resistence-এর মতোই জরুরি, এবং active resistence-এর অংশ হিসেবেও জরুরি।
‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এর এই পর্যালোচনা তাই ১৯১৭-এর লেনিনের কাছে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে নয় এবং এটা প্রমাণ করার জন্যেও নয় যে, ‘লেনিন মৃত’। বরং এর লক্ষ্য মার্কসীয় চিন্তা ঐতিহ্যে লেনিনের গ্রন্থের মৌলিকত্ব খতিয়ে দেখা এবং বলশেভিক বিপ্লবোত্তর সমাজে এর প্রয়োগের ফলাফল পর্যালোচনা করা- কোন বিশেষ চিন্তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো নয়। লেনিন নিজেও তাঁর গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভ‚মিকার একেবারে শেষবাক্যে বলছেন, ‘রাষ্ট্রের প্রশ্নটা কেবল ব্যবহারিক রাজনীতি’র জন্যই তাৎপর্যবহ নয়- ‘আত্মমুক্তির জন্য জনগণের কী করা উচিত’ তার বোঝাপড়ার ক্ষেত্রেও ‘এটা অতিশয় জরুরি’ প্রশ্ন- লেনিনের ভাষায়, মোস্ট আর্জেন্ট প্রবলেম অব দ্য ডে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থান-পতন-নীরবতা-আশাবাদ-সক্রিয়তাও আসলে আমাদের সেই একই কথা বলছে যে, নতুন এক রাষ্ট্রচিন্তা হাজির না করে এবং তাকে সামনে রেখে একটিভিজমের পুনর্বিন্যাস ছাড়া প্রকৃত মুক্তি সুদূরপরাহত।