একজন কফি আনান; একজন শান্তিযোদ্ধা

একজন কফি আনান; একজন শান্তিযোদ্ধা

কোন কোন মানুষের জীবন তার বাস্তব আয়ুর চেয়ে দীর্ঘ হয়। কফি আনান তেমই একজন মানুষ। পুরো নাম, কফি আততা আনান।  জন্ম এপ্রিল ৮, ১৯৩৮ । মৃত্যু আগস্ট ১৮, ২০১৮। কফি আনানের পেশাগত পরিচয় হল, তিনি ঘানার একজন কূটনীতিবিদ এবং জাতিসংঘের সপ্তম মহাসচিব। যুদ্ধের বিরোধিতা করায় ২০০১ সালে কফি আনান এবং জাতিসংঘ যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।  এছাড়া তিনি কফি আনান ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। এবং নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘দা এল্ডারস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

ঘানার কোমাসি শহরে জন্মগ্রহণ করা কফি আনান ম্যাকালেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অর্থনীতি’, গ্র্যাজুয়েট এবং ইউনিভার্সিটি জেনেভায় ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ এবং এমআইটিতে  ‘ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬২ সালে বিশ্ব স্বাস্হ্যসংস্থার জেনেভা কার্যালয়ে কাজ শুরু করার মধ্য দিয়ে তিনি জাতিসংঘে যোগদান করেন। তিনি মার্চ ১৯৯২ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯৬ পর্যন্ত শান্তিরক্ষা  বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্বপালন। এবং ১৯৯৬ সালের ১৩ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ  তাকে মহাসচিব নিযুক্ত করে, পরে সাধারণ পরিষদেরও তা সমর্থিত হয় এবং তিনিই প্রথম জাতিসংঘের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে মহাসচিব হন। প্রথম মেয়াদ শেষ হলে ২০০১ সালে তিনি মহাসচিব পদে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন, এবং ২০০৭ সালের ১লা জানুয়ারি বান-কি-মুনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।

কফি আনান তার জীবনে এমন কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন যা কারণে তিনি মানুষের হৃদয়ে করে নিয়েছেন স্থায়ী আসন। কফি আনানের গ্রহণ করা উদ্যোগগুলো:

  • জাতিসংঘ সংস্কারের সুপারিশ
  • মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল
  • জাতিসংঘ তথ্যপ্রযুক্তি সেবা (UNITeS)
  • ইউনাইটেড নেশনস গ্লোবাল কমপ্যাক্ট
  • গ্লোবাল ফান্ড প্রতিষ্ঠা
  • বিশ্বরচ্ষার দায়িত্ব
  • ইরাকে মার্কিন আক্রমণের সময় যুদ্ধবিরোধী ভূমিকা
  • অন্যান্য কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড
  • লুবারস যৌন-হয়রানী তদন্ত
  • তেলের-বিনিময়ে-খাদ্য স্ক্যান্ডাল

কফি আনান ফাউন্ডেশন :

কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে কফি আনান

২০০৭ সালে আনান ‘কফি আনান ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই অলাভজনক স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের শাসনব্যবস্থা আরো কল্যাণমূলক করতে এবং সুন্দরতর ও শান্তিপূর্ণ একটি পৃথিবী গড়তে মানুষ ও দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে চলেছে।

প্রতিষ্ঠানটির মূলনীতিতে আছে, অন্যায়হীন এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ তিনটি স্তম্ভের ওপর নির্ভর করে: শান্তি ও নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, মানবাধিকার ও আইনের শাসন। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হচ্ছে কার্যকরী নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে এই তিনটি স্তম্ভের বিপরীতে যেসব প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে, যুদ্ধ-সহিংসতা থেকে শুরু করে পাতানো নির্বাচন কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন – এ সবকিছুকে প্রতিহত করে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে এগিয়ে যাওয়া।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তদন্তের সময়। ছবি: আনান কমিশন

রোহিঙ্গা সংকটে কফি আনান :

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আনানকে বলা হয় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য সম্পর্কিত উপদেষ্টা কমিশনের নেতৃত্ব দিতে। সে ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন তিনি। মিয়ানমারের এ অঞ্চলটি দরিদ্র ও অনুন্নত, এবং জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে পীড়িত, যেখানে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধের বিপরীতে রয়েছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। এবং সরকার ও সেনাবাহিনীও রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে।

‘আনান কমিশন’ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত এই কমিশনকে মায়ানমারের অনেক বৌদ্ধ রোহিঙ্গাদের সাথে তাদের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ মনে করে এবং বিরোধিতা করে।

২০১৭-র ২৪শে আগস্ট যখন আনান কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে, রিপোর্টের সুপারিশগুলোতে উভয় পক্ষই নারাজ হয় এবং ভয়ানকভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে – ঐ অঞ্চলে এ দশকের সবচেয়ে বড় আকারের এবং রক্তাক্ত মানবিক বিপর্যয়ে মিয়ানমার থেকে অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়। আনান এর সমাধান করতে জাতিসংঘকে উদ্যোগী করার চেষ্টা করেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন সফলতা দেখা যায়নি।

কফি আনানকে নিয়ে কিছু সমালোচনা :

নিরাপত্তা পরিষদ সম্প্রসারণ না করায় তিনি সমালোচিত হন এবং জাতিসংঘের তেলের-বিনিময়ে-খাদ্য কর্মসূচি নিয়ে তদন্তের পর তার পদত্যাগের দাবিও ওঠে। জাতিসংঘে কর্মজীবন সমাপ্তির পর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে তিনি আনান কমিশন গঠন করেন। ২০১২ সালে তিনি চলমান সিরিয়া সংকট সমাধানে জাতিসংঘ- আরব লীগের যৌথ বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু সংকট সমাধানে জাতিসংঘের কাজে কোনো অগ্রগতি না দেখে তিনি অব্যাহতি নেন। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে তাকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তদন্তের জন্য গঠিত একটি জাতিসংঘ কমিশনের প্রধান নিযুক্ত করা হয়, যা ‘আনান কমিশন’ নামে পরিচিত। এখানেও তিনি সফল হতে পারেনি। কমিশনের কোন সুপারিশ আজও বাস্তবায়িত হয় নি।

২০১৮ সালের আগস্টে সুইজারল্যান্ডে সামান্য অসুস্থতার পর আনান মৃত্যুবরণ করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মনে করেন, কফি আনান ছিলেন শান্তির যোদ্ধা এবং কল্যাণের পথপ্রদর্শক।