মাঝ রাতে হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায়। অস্থির-এলোমেলো সব ভাবনা ততক্ষণে ঝড় তুলেছে মাথায়। আস্তে করে খাট থেকে নেমে স্লিপারটা পায়ে ঢুকিয়ে নেয় কৈশোর-তারুণ্য পার করে আসা যুবকটি। নিঃশব্দে এগিয়ে যায় বদ্ধ কামরার দিকে। আলো জেলে দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে কতক্ষণ। চারিদিকে ঝকঝক করছে নিজের অর্জন করা গর্বের সব ট্রফি। দেয়ালের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলো কত কথাই না বলে যাচ্ছে নিঃশব্দে। এগিয়ে গিয়ে এক কোণে পড়ে থাকা প্রিয় ব্যাটটি হাতে তুলে নেয় সে যুবক। চোখ বেয়ে নামতে থাকে অবাধ্য অশ্রু।
কৈশোর-তারুণ্য পেরিয়ে চৌত্রিশের এ যুবকটির নাম মোহাম্মদ আশরাফুল। যার নামের পাশে এখনো রয়েছে সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানের খেতাব। সেটিও যেন তেন কারোর বিপক্ষে না। লঙ্কার মাটিতে লঙ্কান সিংহ ভাস-মুরালিদের শাষণ করেই গড়েছিলেন সেই কীর্তি, যা আজো অক্ষয়। ঝাপসা চোখের সামনে ভেসে ওঠে কার্ডিফ। ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি, লি-দের চমকে দিয়ে তুলে নিয়েছেন শতরান। আফতাবের সে ছয়, আফতাব-রফিকের ক্ষ্যাপাটে দৌঁড়ের পড় স্থানুর মত চেয়ে থাকা পন্টিংয়ে মুখাবয়ব; কতকিছু ভেসে ওঠে চোখের সামনে। অসহ্য এক যন্ত্রণা হয় বুকের মাঝে। হঠাৎ অনুভব করেন আলতো স্পর্শ। প্রিয়তমা স্ত্রী পাশে এসে বসেছেন কখন টেরই পাননি।
জীবনটাই এক অদ্ভুৎ খেলা। চেনা সবাই যখন দূরে সরে যায় তখন ঠিক কেউ না কেউ এসে হাজির হয় দেবীর রুপ নিয়ে। আশরাফুলের সে দেবী কষ্টটা বোঝেন। বুঝে চুপ করে আলতো করে হাত রাখেন তার হাতের ওপর। দেয়ালে টাঙানো একটি ছবির দিকে ইশারা করেন তিনি। ভক্তদের ভীড়ে ছোট্ট আশরাফুল যেন হারিয়েই গিয়েছেন। অশ্রুর দাগ তখনো শুকায়নি, এ অবস্থাতেই হাঁসি ফুটে ওঠে আশরাফুলের ঠোঁটে। এ পাগল মানুষগুলোর ভালোবাসার জন্যই তো বেঁচে থাকা। না, হার মানা যাবে না। ফিরতেই হবে। নিজের জন্য না হোক, সেই মানুষগুলোর জন্য যারা একবার আশরাফুলকে কাছ থেকে না দেখেও কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন তার জন্য।
আবারো গিয়ে শুয়ে পড়েন আশরাফুল, কিন্তু ঘুম আর আসেন না। এক এক করে পাঁচটি বছর যে কাটাতে হয়েছে ‘নিষিদ্ধ’ শব্দটার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে। আচ্ছা, তিনি তো তবু কবুল করেছেন। কেউ কি নেই, যে একটাবার এইটা ভেবে দেখবে যে; আইসিএলে গেলেই যখন বৈধভাবেই কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতেন সেটি বাদ দিয়ে তিনি সামান্য কয়টা টাকা কেনই বা নিবেন? তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে সমবেত সমর্থকদের ছবি। যাদের মনে এ প্রশ্নটি উঁকি দিয়েছিল বলেই নির্বিচারে সহ্য করেছে লাঠিপেটা। না, দুনিয়ার সবাই বধির হয়ে যায়নি, সবাই অন্ধ না; আঁধারের মাঝেই এক চিলতে আশার আলো যেন বড় অস্পষ্ট ভাবেই দেখা দেয়।
পরিসংখ্যানটা খচখচ করে নিজের মনেই। অনেকে তো উপহাসই করে যে, বড় দলের অনেক বোলারের গড়ও তারচেয়ে ভাল। আচ্ছা, পরিসংখ্যানে কি এইটা লেখা আছে তিনি যখন শুরু করেছিলেন তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটটা কেমন ছিল? এখন তো তামিম, সাকিব, রিয়াদ, মিতু কেউ না কেউ দাঁড়িয়েই যায়। তখন দলের জয় পরাজয় পুরোটাই যে নির্ভর করত তার ছোট্ট কাঁধের ওপর। কবে একবার চাপমুক্ত হয়ে খেলেছেন কেউ বলতে পারবে? তখন দলগুলোও কী ছিল? প্রত্যেকটা দলেই কমপক্ষে তিনজন কোয়ালিটি বোলার। সে সব কথা তো পরিসংখ্যানে লেখা থাকে না। তাহলে? না, এত সহজেই সবাই ভুলতে পারবে না নামটা। লোক মুখেই যে বেঁচে থাকবে অমর কীর্তিগুলো।
এলোমেলো এসব চিন্তার মাঝেই কানে আসে মুয়াজ্জিনের সুমধুর আজান। চোখ বন্ধ করে পুরো আজানটা শোনে আশরাফুল। উঠে প্রস্তুতি নেয় সালাত আদায়ের। সালাত শেষে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে আলোর আভা জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। জীবনটাও যে এমনই, রাত যত দীর্ঘই হোক, ভোর আসবেই। আশরাফুলকেও পারতেই হবে। নিজের জন্য না হোক, তার ওপর বিশ্বাস রেখে যারা সেদিন লাঠিপেটার শিকার হয়েছিল তাদের জন্য হলেও পারতে হবে। কান্নায় ভেঙে পড়া আশরাফুল না, ক্রিকেট ভক্তরা যে কার্ডিফে সেঞ্চুরির পর উন্মত্ত উদযাপনরত আশরাফুলের ছবিটিকেই বুকে ঠাঁই দিয়েছেন। সে ছবিটির সম্মানে হলেও ফিরতেই হবে…