আগমনের শুরুতেই অনন্য কীর্তি গড়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার ‘আশার ফুল’। অভিষেকেই বাজিমাত করা বাংলার এই লিটল মাস্টারের ব্যাট এরপর যতবারই হেসেছে, হেসেছে বাংলাদেশের মানুষ। হোক সেটা সুদূরের কার্ডিফ কিংবা পাশের শহর চট্টলা; আশরাফুলীয় ইনিংস মানেই মুগ্ধতা। সে আশরাফুলই এতদিন ছিলেন ‘নিষিদ্ধ’ ক্রিকেটার। যন্ত্রণাদায়ক এই বিশেষণ থেকে অবশেষে মুক্তি মিলল বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টারের।
অভিষেকের সেঞ্চুরি থেকে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ সিরিজ হয়ে থাকা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ পর্যন্ত ব্যাটসম্যান আশরাফুল ছিলেন এক আক্ষেপের নাম। অতুলনীয় ক্রিকেটিয় প্রতিভার নিদারুণ অপচয় তার ক্যারিয়ারেরই ক্ষতি করেছে এমন নয়, বরং ক্রিকেটকেই বঞ্চিত করেছে অসংখ্য বর্ণিল ইনিংস প্রাপ্তি থেকে। তবু, সান্ত্বনা ছিল; তাকে মাঠে দেখবার। আরো একটা আশরাফুলীয় ইংনিসের জন্য প্রতিক্ষা করবার। আরো একবার জয়ের উল্লাসে মাতবার। কিন্তু ২০১৩ সালের শেষ প্রহরটা যেন হাজির হলো প্রলয়ঙ্কারীরূপে। ম্যাচ পাতানো এবং স্পট ফিক্সিং’র দায় কবুল করে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টারবয়!
আশরাফুল নিজেই কবুল করে নেয়ার পরেও ফিক্সিং বিষয়টিতে তার একক শাস্তি, শাস্তির প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্কটি এখনো অমিমাংসিত। হয়তো, জাতীয় দলের জার্সি ফের গায়ে চাপানোর স্বপ্ন চোখে থাকায় আশরাফুলও চাইবেন বিষয়টি এড়িয়ে যেতে। কিন্তু তার নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে মিরপুরে সেদিন জড়ো হওয়া মুখগুলো থেকে কিন্তু আজও প্রশ্নবোধক চিহ্ন সরে নি। কি অপরাধে নিজের প্রিয় খেলোয়াড়কে সমর্থন জানাতে গিয়ে লাঠি পেটার শিকার হলেন তারা? কেন বা আশরাফুলকেই দোষী সাব্যস্ত করে তড়িঘড়ি করে ঘোষণা করে দেয়া হলো রায়? হয়তো, সন্দেহবাদী মনগুলোর সন্দেহ অমূলক। হয়তো, সত্যিই তিনি অপরাধী। সময়ই হয়তো নিজের মতন করে তার জওয়াব দেবে । এই পালে বরং সে আশরাফুলকেই মনে করা যাক যে আশরাফুল মনে দাগ কেটেছিলেন অজস্র ক্রিকেটপ্রেমীর।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয়টি নিঃসন্দেহে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাওয়া। সে সময় দু’দলের মধ্যকার পার্থক্য বিবেচনায় সম্মানজনক পরাজয়ও জয়ের চেয়ে ঢের বেশি বলেই মনে হত। আশরাফুলের উদ্ধত ব্যাট সেদিন জমিনে নামিয়ে এনেছিল স্বর্গজয় করা অস্ট্রেলীয় দলকে। বাংলাদেশ প্রথমবারের মত স্বাদ পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর। তারপরের ম্যাচেই ইংল্যান্ড টের পেয়েছিল আশরাফুলের ব্যাট কতটা নির্দয় হতে পারে সেটি। ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার পেস আক্রমণকে অবজ্ঞা করে খেলা ইনিংসটির স্মৃতিও তো এখনো তরতাজা। চট্টগ্রাম টেস্টে ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১৫৮ রানের ইনিংসটি, কিংবা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯০; যখনই আশরাফুল হেসেছেন, হেসেছেন এই বাংলাদেশ। তখন যে বাংলাদেশের জয়-পরাজয়ের অনেকটাই নির্ভর করতো আশরাফুলের একার ওপর। আইসিএল ধাক্কায় যখন দেশের ক্রিকেট টালমাটাল তখন অধিনায়কত্বের চ্যালেঞ্জ নিয়ে লড়েছিলেন কিউইদের বিপক্ষে। হ্যা, এখনো অবসরে না যাওয়া আশরাফুল ইতোমধ্যেই নিশ্চিত করেছেন তার অমরত্ব। ম্যাচ পাতানোর বিষয়টি সামনে এনে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাতে ইতিহাস মিথ্যে হয়ে যাবে না। মিথ্যে হয়ে যাবে না কোটি জোড়া মুগ্ধ চোখ। না, কোনো অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাইছি না। যেহেতু প্রক্রিয়াটি নিয়ে এখনো সংশয় বিদ্যমান তাই ঢালাওভাবে দোষী ভেবে ঘৃণাও করতে পারছি না।
বয়স এবং বাস্তবতা বিবেচনায় আশরাফুল ফের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামতে পারবেন কি না সেটি সময়ই বলে দেবে। দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে থাকাটা তার জন্য নেতিবাচক। ঘরোয়া ক্রিকেটে দু’মৌসুম ধরে খেলছেন বটে, তবে এ লিগের মানের ওপর খোদ আশরাফুল কতটা ভরসা রাখেন প্রশ্ন হতে পারে সেটি নিয়েই। সামনে বিশ্বকাপ বিবেচনায় যেহেতু তরুণরাই প্রাধান্য পাবেন তাই আশরাফুলের জন্য কাজটি বেশ কঠিন।
আঁধার যত গাঢ়ই হোক পথের শেষে আলো থাকেই। আশরাফুলের আলো তিনি নিজেই। বাংলাদেশের ঘরোয়া লীগের মান দিয়ে নিজেকে যাচাই করার কোনো প্রয়োজন তার নেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতাই আশরাফুলকে সাহায্য করবে নিজেকে প্রস্তুত করতে। একই সাথে নিষিদ্ধ নামক যন্ত্রণাদায়ক শব্দটির যে মানসিক চাপ, সেটি থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত মনে খেলতে পারাটাও হবে ইতিবাচক। জাতীয় দলই স্বপ্ন, তবে সেটিকেই পাখির চোখ করা আশরাফুলের অন্তত প্রয়োজন নেই। তিনি বরং নিজের প্রতি যে অবিচারটা করেছেন সে পথ থেকে সরে সহজাত প্রতিভার মূল্যায়নটুকু করুন। সেটিই যথেষ্ট হবে আশরাফুলের স্বপ্ন পূরণের জন্য। স্বপ্নতো তারই দেখা সাজে যে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা জানে। সুতরাং, স্বপ্নচারী হতে দোষ কোথায়?