ফ্যাসিবাদের ‘বাংলাদেশি’ মডেল নিয়ে জরুরি ভাবনা

ফ্যাসিবাদের ‘বাংলাদেশি’ মডেল নিয়ে জরুরি ভাবনা

সম্প্রতি জবানে রেজাউল করিম রনির একটি অসাধারণ প্রবন্ধ পড়েছি। লেখাটি পড়ে মনে হল, আসলে এটা নিয়ে অনেক কথা বলা দরকার । রনি’র লেখাটির শিরোনাম, ‘সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধের পথে বাংলাদেশ’। -এই লেখাটি নিয়ে  এখানে আমি কিছু বিষয়ে মনযোগ দিব। আমার মনে হয়েছে রনি এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘ফ্যাসিবাদ’ নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করলেন। এই লেখাটা ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা জারি থাকলে খুশি হব। এই প্রসঙ্গে আপনাদের মন্তব্যও আশা করছি।

বাংলাদেশের বয়স্ক মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই কোনো সিরিয়াস পড়াশোনা করেননি, করেন না, এবং করার কোনো প্রয়োজনও বোধ করেননি, করেন না, এবং ভবিষ্যতেও করবেন বলে মনে হয় না। ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সেরা ব্যাক্তিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, চাকরি-বাকরি , আর শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাকিস্তান হবার ফলে ‘সলিমুদ্দি-কলিমুদ্দি’ আসলে যারা এককালে স্কুল শিক্ষক ছিলেন, তারাই কলেজ/ইউনিভার্সিটি শিক্ষক হয়েছিলেন।

ড. এনামুল হক (বাংলা) ১৯৪৭-এর আগে স্কুল শিক্ষক ছিলেন, পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। আবুল ফজল, একসময় স্কুল শিক্ষক ছিলেন, পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হন। এ আর মল্লিক কলেজ শিক্ষক ছিলেন, ১৯৪৭ এর পরে বিশবিদ্যালয় শিক্ষক এবং পরে মন্ত্রী হন। বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস অফিসাররা ১৯৪৭-এর পরে ডিসি, কমিশনার, এমনকি সেক্রেটারি হয়ে অবসর গ্রহণ করেন, পুলিশ ইন্সপেক্টররা এসপি, ডিআইজি হন। ১৯৪৭ এর পরে শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিদের বিপুল সংখ্যায় দেশত্যাগ করেন। যা মুসলমান বাঙালি ও অবাঙালিদের পোয়াবারো হবার প্রধান কারণ। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ এ কোনো বাঙালি মুসলমান আইসিএস অফিসার ছিলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে ৮৩ জন মুসলমান অবাঙালি আইসিএস জোটে। তাদের অনেকে পূর্ব বাংলায় উচ্চপদে চাকরি নিয়ে আসেন I জি এ মাদানী, ও আখতার হামিদ খানসহ (কুমিল্লা কোটবাড়ি প্রজেক্ট খ্যাত) আরো অনেকে ছিলেন এই দলে।

১৯৭১-এর পরে আবার বাঙালি, ইপিসিএস/সিএসপি/পিএসপি/পিএফএস -অফিসারদের পোয়াবারো হয়। অবাঙালি পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী, দোকানদার, সরকারি কর্মচারী, সিপিএস ও মিলিটারী অফিসারদের জায়গায় এবার বাঙালিরা অধিষ্ঠিত হয়। ছোট ব্যবসায়ী কালক্রমে মাল্টি-মিলিয়নেয়ার (ডলারে) হয়ে সমাজের আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন।

শিক্ষার সর্বস্তরে অপরিকল্পিতভাবে বাংলা চালুর ফলে, ইংরেজি ভাষায় তথা আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞানের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ দূরীভূত শিক্ষক ও ছাত্র বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে মহীরুহ হয়ে প্রতিষ্ঠিত। এর মাঝে হাতে গোনা কয়েকজন আহমদ ছফা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আহমেদ কামাল, আফসান চৌধুরী, শহিদুল আলম, রেহনুমা আহমেদ, সলিমুল্লাহ খান বা রেজাউল করিম রনিরা ব্যাতিক্রম।

বয়স দিয়ে জ্ঞানের বা বুদ্ধির পরিধির মাত্রা নির্ণয় করা প্রাক-আধুনিক, সামন্তবাদী, ও কৃষিনির্ভর সমাজের এক দুরারোগ্য ব্যধি বৈকি! এক কথায়, প্রতিযোগিতা বিমুখ সুযোগ সন্ধানীদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ফলে তা-ও একবার নয় দুবার, প্রথমে ১৯৪৭ সালে ও পরে ১৯৭১ -এ বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা ও সর্বক্ষেত্রে মূর্খতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এর গভীর প্রভাব পড়েছে সমজের বিভিন্ন স্তরে। আমি এ দুর্দশা থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাই না! যারা পান, তাদের কথা শোনার ইচ্ছা পোষণ করি।

রেজাউল করিম রনির এই লেখা এক নতুন আলোচনার সূত্রপাত করলে খুশি হব। আমি তার সাথে সম্পূর্ণ একমত যে ঢালাওভাবে বাংলাদেশের স্বৈরশাসকদের ফ্যাসিবাদি বলাটা হয়তো সমীচীন নয়। আমি মনে করি, সব ফ্যাসিবাদি শাসক, যেমন হিটলার ও মুসোলিনি, অথবা গামাল নাসের, মুয়াম্মার গাদ্দাফি, রবার্ট মুগাবে আর যাই হোক চোর-ডাকাত ছিলেন না। এদের সাথে বাংলাদেশি নির্বাচিত বা অনির্বাচিত একনায়ক/নায়িকাদের তুলনা করা যায় না। ফ্যাসিবাদ– জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম বর্জিত নয়। বাংলাদেশে শেখ মুজিব একদলীয় একনায়কতন্ত্রের সূচনা করেন  আর তার কন্যা এ ব্যবস্থার চরম উৎকর্ষ সাধন করে এক ধরনের একদলীয় অপশাসনের জন্ম দিয়েছেন। যেহেতু এই শাসকচক্র দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদ, সততা ও জনকল্যাণমুখী কর্মসূচিবর্জিত এক শাসন ব্যবস্থা, এর সাথে মাফিয়া চক্রের কার্যকলাপের একাধিক মিল রয়েছে, তাই এ ব্যবস্থাকে আমরা মাফিয়া-ফ্যাসিবাদ বলে অভিহিত করতে পারি।

আরও একটি পয়েন্ট আছে এই লেখায়। রনি রবিঠাকুরের ফ্যাসিবাদ প্রেমের কথা বিস্তারিত ভাবে তার আলোচনায় এনেছেন। আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফ্যাসিবাদ ও সমাজতন্ত্রকে একগোত্রীয় বলে মনে করার অনেক কারণ থাকতে পারে! তিনি প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ (কলকাতা ১৯২৭) -এর মুখবন্ধে এ নিয়ে লিখেছিলেন। তিনি লিখেন, “ফ্যাসিবাদ ও সমাজতন্ত্র -একই দানবের পাশ ফেরা মাত্র”। তিনি স্ট্যালিনের সমাজতন্ত্রের নামে চরম একনায়কতন্ত্র ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থা স্বচক্ষে দেখে এসেছিলেন। এটা নিয়ে লিখেছেন। তাই তাকে আমি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখছি।

আমি মনে করি ২০১৪ থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে এক মাফিয়া-ফ্যাসিবাদ বিরাজমান। বাংলাদেশ এখন এক চরম অসৎ, চরম নীতিহীন, নির্দয়, একদলীয় স্বৈরশাসনের খপ্পরে পড়েছে। অবস্থা এতই খারাপ যে, ফেইসবুক বা ইন্টারনেটেও -নৈর্ব্যক্তিক সমালোচনা করার সমূহ বিপদ রয়েছে। বাংলাদেশে বসে যারা এই মাফিয়া-ফ্যাসিবাদ বিরোধী কথা বলছেন, তারা আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রশংসার দাবিদার। আমি রনির লেখাটা খুব উপভোগ করেছি। বাংলাদেশে এখনো যে কিছু মানুষ লেখাপড়া করেন, এটা খুবই আশাব্যাঞ্জক!

আমি তার সাথে সম্পূর্ণ একমত যে ঢালাওভাবে বাংলাদেশের স্বৈরশাসকদের ফ্যাসিবাদি বলাটা হয়তো সমীচীন নয়। আমি মনে করি, সব ফ্যাসিবাদি শাসক, যেমন হিটলার ও মুসোলিনি, অথবা গামাল নাসের, মুয়াম্মার গাদ্দাফি, রবার্ট মুগাবে আর যাই হোক চোর-ডাকাত ছিলেন না। এদের সাথে বাংলাদেশি নির্বাচিত বা অনির্বাচিত একনায়ক/নায়িকাদের তুলনা করা যায় না। ফ্যাসিবাদ– জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম বর্জিত নয়। বাংলাদেশে শেখ মুজিব একদলীয় একনায়কতন্ত্রের সূচনা করেন আর তার কন্যা এ ব্যবস্থার চরম উৎকর্ষ সাধন করে একধরনের একদলীয় অপশাসনের জন্ম দিয়েছেন

 

রেজাউল করিম রনির ফ্যাসিবাদ নিয়ে রচনার জন্য তাকে কংগ্রাচুলেট করেছি, এখন একটু সমালোচনা করছি! রনিকে উদ্ধৃত করছি আমার দ্বিমতের ব্যাপারটা খোলাসা করার জন্য:

“টেকনোলজি আর কর্পোরেট গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড অর্ডার এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে হিটলার বা মুসোলিনি টাইপের ফ্যাসিজমের দিন শেষ। স্টেট মেশিনারির ভূমিকাটা অতি ফাংশনাল। এর ইডিওলজিক্যাল স্ট্রেংথ বা বল আর বাস্তব কারণেই এত জোরালো হবে না। সে যত মহান জাতীয়তাবাদই হোক। কনজ্যুমার কালচারাল সোসাইটির সাথে আধুনিকতার যোগের সাথে বিজ্ঞাপনী দেশপ্রেম মিলে বড়জোর একটা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম তৈরি হতে পারে। যেটা বাংলাদেশে হয়েছে। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ অতি করুণ পরিণতিতেই শেষ হবে। কারণ নতুন রাজনৈতিক চৈতন্য দাঁড়ানোর সাথে সাথে এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য ধসে যাবে। সেটা যদি বুর্জোয়াও হয় তাও এই সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম দাঁড়াতে পারবে না। কোন কারণ নাই। এখন মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তথাকথিত প্রজন্ম দেখে আমরা যদি ভড়কে যাই তাইলে খুব হাস্যকর হবে ব্যাপারটা। শাহবাগ গোটা বাংলাদেশ না। এই ধরনের ফ্যাসিজম লিবারিলজমকে উৎসাহিত করে। গণতন্ত্রের কথা বলে, উন্নয়নের কথা বলে। এর আসল গোমরটা হল, “Fascism steals from the proletariat its secret: organisation… Liberalism is all ideology with no organisation; fascism is all organisation with no ideology.” (Bordiga)

শ্রমিকরা দ্রুতই লিবারাল জাতীয়তাবাদী আদর্শের দিকে ফিরে আসে, তাদের সাংগঠনিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে অবস্থা গড়ে ওঠে তাকে লিবারাল বলা হলেও, এই লিবারাল শক্তি যখন ক্ষমতার ধারক-বাহক হয়ে ওঠে তখন আর তার কোনো আদর্শ থাকে না।” (রেজাউল করিম রনি, সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধের পথে বাংলাদেশ’ জবান, ৭ আগস্ট ২০১৮)

আমি এতবড় উদ্ধৃতি দিচ্ছি কেননা, রনি এখানে অনেক দামি কথা বলেছে। এখানে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, টেকনোলজি ও গ্লোবালাইজড করপোরেটিজম হিটলার ও মুসোলিনি মার্কা ফ্যাসিবাদের মৃত্যু ঘটিয়েছে। দ্বিতীয়ত, “Liberalism is all ideology with no organisation; fascism is all organisation with no ideology.” (Bordiga)” একথা খুবই সত্য I

কিন্তু তার চাইতে বড় সত্য হল শ্রমিক শ্রেণী কখনো “দ্রুতই লিবারাল জাতীয়তাবাদি আদর্শের দিকে ফিরে আসে না।” ধর্মীয় বা ধর্মহীন ফ্যাসিস্ট বা illiberal democracy শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে সবচাইতে বেশি আকৃষ্ট করে -এখানেই রনির সাথে আমার দ্বিমত। আর কিছু নয়।

ফ্যাসিবাদ নিয়ে চিন্তা ভাবনা যে অতি জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আশা করি এই বিষয়ে ভাবানার নুতন নতুন দিগন্ত প্রসারিত হতে শুরু করবে।