কখনো কখনো মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার কাজ। এই কাজই মানুষকে মহান করে তোলে। তেমনি একজন মহান ব্যক্তিত্ব আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। বাংলাদেশের আলোকচিত্র শিল্পকে বিশ্ব দরবারেই শুধু নেননি তাকে আসনও করে দিয়েছেন নিজ প্রচেষ্টায়। এর বাইরেও মানুষের জীবন থাকে। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ হয়ে ওঠে সাহসী, হয়ে ওঠে সত্যনিষ্ঠ, হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। শহিদুল আলমও সেই মহান পথে হাটলেন । সময়ের প্রয়োজনে হয়ে উঠলে দুর্বার এক সংগ্রামী। ফলাফল হিসেবে গ্রহণ করতে হলো কারাগার। তাতে কি এতটুকু কমলো শহিদুল আলমের মাহাত্ম্য! না, বরং বাড়ল, বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের হৃদয়ে নিজস্ব আসন গড়ে নিলেন এই মানুষটি।
গত ৬ আগস্ট, খ্যাতিমান এই আলোকচিত্রী বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে গ্রেফতার হন।তার গ্রেপ্তারে বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও ক্ষোভের ঝড় বইছে। আদালত থেকে তাকে চিকিৎসা করানোর আদেশ দেয়া হলেও একবার শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ঘুরে এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), পেন ইন্টারন্যাশনাল, দক্ষিণ এশিয়া মিডিয়া ডিফেন্ডার্স নেটওয়ার্ক (সামডেন) সহ গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতো সংবাদমাধ্যম নিন্দা জানিয়েছে। কিন্ত কে এই শহিদুল আলম? কেন তাকে নিয়ে ঝড় উঠেছে সংবাদ মাধ্যমে? তা আমরা জানবো এই লেখায়।
ড. শহিদুল আলম পদকজয়ী ফটো এজেন্সি দৃক এবং এশিয়ার সবচেয়ে প্রখ্যাত ফটোগ্রাফি স্কুল ‘পাঠশালা’র প্রতিষ্ঠাতা । এই স্কুলে পড়তে বিদেশ থেকে শিক্ষার্থী এবং অসংখ্য অতিথি শিক্ষক আসেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক ইন্সটিটিউট ও সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব ফটোগ্রাফি প্রতিষ্ঠা করেছেন। দৃক ও পাঠশালা – দুই প্রতিষ্ঠানই তিনি গড়েছেন নিজের পৈতৃক সম্পত্তিতে। তবে তার সবচেয়ে সফল সৃষ্টি হলো ছবি মেলা। এই আন্তর্জাতিক চিত্রপ্রদর্শনীতে বিশ্বের সব জায়গা থেকে কাজ জমা পড়ে। অংশ নিতে ঢাকায় আসেন বিশ্বের সেরা সব ফটোগ্রাফাররা। কিন্ত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি ছিলেন একজন প্রাণ রসায়নবিদ। এসবের মধ্যে আলোকচিত্র এল কী করে?
প্রাণরসায়নে স্নাতক শেষ করে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছিলেন। চলছিল গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ ও খণ্ডকালীন শিক্ষকতা। এ সময় তিনি যুক্ত হলেন ইংল্যান্ডের সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে। সমাজের বৈষম্যগুলো তাঁকে নাড়া দিত। তখনই বাম রাজনীতির সাথে ওঠা বসা শুরু। লন্ডনে বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। পিএইচডির শেষের দিকে মনে করলেন সমাজের বৈষম্যগুলো পরিবর্তনের জন্য আলোকচিত্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তাছাড়া বাংলাদেশে সাক্ষরতার হারও কম। এই মানুষগুলোকে বোঝানোর জন্যে আলোকচিত্রই সহজ মাধ্যম।
কিন্ত আলোকচিত্রের ওপর ছিলনা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তাতে কী! দমে না যেয়ে আলোকচিত্রের ওপর প্রচুর বই পড়লেন। প্রচুর ছবিও তুলতে লাগলেন। ছবি তুলতে তুলতে এবং ডার্ক রুমে কাজ করে ছবি তোলা ও প্রিন্ট করা শিখে ফেললেন। সবই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ তাঁর উপলব্ধি হলো, তিনি যে কারণে আলোকচিত্রী হতে চেয়েছেন, এটা তো সেই কাজ না। এই স্বচ্ছন্দের পরিবেশে থাকলে সেটা সম্ভব না। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন দেশে ফিরবেন। দেশে ফিরে, ঢাকায় শুরু হলো তার আলোকচিত্রীর জীবন।
তখন তিনি কাজ করতে চাইলেন ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে কিন্তু নেই কোন সনদ। যে পোর্টফোলিও তাতে তিনি স্টুডিওর আলোকচিত্রী। সে সময় এলিফ্যান্ট রোডে খান মোহাম্মদ আমির নামের একজনের সঙ্গে মিলে শহিদুল আলম ‘ফটো ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করলেন। কারিগরি দিকে দক্ষতা থাকায় উন্নত মানের ফটোস্টুডিও তৈরি করলেন। শহিদুল আলমের পরিচিতির গণ্ডি কিছুটা বাড়ল। ভালোই চলছিল কিন্ত বাংলাদেশে ফেরার উদ্দেশ্য যে এটা নয়। ফটো ওয়ার্ল্ড ছেড়ে তাই শুরু করলেন ফ্রি-ল্যান্স আলোকচিত্রী হিসেবে। বাংলাদেশে সে সময় কোম্পানির ব্রোশিয়ার হতো না। তিনি বিভিন্ন জনকে বোঝাতে লাগলেন, কেন ব্রোশিয়ার দরকার। এবং সেগুলো করেও দিতেন। কিন্ত মন ভরছিলনা তার। তবে জীবনের মোড় ঘুরে গেল চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি কোম্পানির সাথে কাজ করে। এই কোম্পানি ইলেকট্রনিক সার্কিট বোর্ড নিয়ে কাজ করত। সেসব সার্কিটের ছবি তুললেন। সার্কিট বোর্ডের ছবিগুলো দেখে মনে হলো যেন অ্যামেরিকার উঁচু দালানের মধ্যে থাকা ভাসমান রাস্তা। এ ধরনের কাজ তখন বাংলাদেশে হতো না। তাই খুব প্রশংসা পেয়েছিল। এবং ঘটনাক্রমে সেটিই হয়ে গেল শহিদুল আলমের ভিজিটিং কার্ড।
দৃক গ্যালারী
তিনি অনেক ছবি তুললেও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হচ্ছিলনা। শহিদুল আলম ভাবলেন তিনি যে ধরনের কাজ করতে চান তার জন্য নিজস্ব গ্যালারি থাকতে হবে। এরপরই পৈত্রিক সম্পতিতে ১৯৮৯ সালে, ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠা করলেন দৃক গ্যালারি। দৃক শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে যার অর্থ দৃষ্টি। প্রথম প্রদর্শনী ছিল ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর আলোকচিত্র নিয়ে।
পাঠশালা
শহিদুল আলম একাই কাজ করে চলছিলেন। কিন্ত তিনি চাননি একা এগিয়ে যেতে। একা আর কত লড়াই করবে। লড়াইয়ের জন্য সৈনিক দরকার। ১৯৯৮ সালে তাই প্রতিষ্ঠা করেন পাঠশালা। পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট এশিয়ার মধ্যে সেরা মানসম্পন্ন আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পাঠশালার শিক্ষার্থীরা ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো, জুপ সোয়ার্ট মাস্টার ক্লাস, মাদার জনস অ্যাওয়ার্ড, অ্যালেক্সিয়া ফাউন্ডেশন গ্র্যান্টস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অল রোডস প্রজেক্ট, সামদানি আর্ট অ্যাওয়ার্ড, পিডিএন ফটো কনটেস্টসহ আলোকচিত্রের প্রায় সব আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউ ইয়র্কার, টাইম ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাঠশালার শিক্ষার্থীদের কাজ প্রকাশিত হয়েছে। সারা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাঠশালার যৌথ কর্মসূচি চালু আছে। ২০১৮ সালে পাঠশালা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়েছে। ১০০ জনের বেশি তিন বছরের কোর্স শেষ করে বের হয়েছেন। বেসিক ফটোগ্রাফি কোর্স শেষ করেছেন ছয় হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। প্রায় ৪০ জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও ফটো সম্পাদক পাঠশালায় এসে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। বর্তমানে পাঠশালার ২৬ শিক্ষকের মধ্যে ২৪ জনই প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
ছবিমেলা
তার সবচেয়ে সফল সৃষ্টি হলো ছবি মেলা। এই আন্তর্জাতিক চিত্রপ্রদর্শনীতে বিশ্বের সব জায়গা থেকে কাজ জমা পড়ে। অংশ নিতে ঢাকায় আসেন বিশ্বের সেরা সব ফটোগ্রাফাররা। ২০০০ সালে শুরু হওয়া এই চিত্রপ্রদর্শনীর প্রথম থিম ছিল ‘যেই যুদ্ধ আমরা ভুলে গেছি।’ এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে সবচেয়ে সফল চিত্রপ্রদর্শনীর একটি। এটি এশিয়ার সর্ববৃহৎ আলোকচিত্র উৎসব। দুই বছর অন্তর ছবিমেলার আয়োজন হয় ঢাকায়। বিভিন্ন দেশ থেকে সেরা আলোকচিত্রীরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনীতে অংশ নেন। গত বছর নবম ছবি মেলায় ‘অবস্থান্তর’ বিষয়কে কেন্দ্র করে ১৬টি দেশের ২৭ শিল্পীর ৩১টি প্রদর্শনী ছিল। ২০১৯ সালে দশম ছবি মেলা অনুষ্ঠিত হবে। কিউরেটর, ফটো সমালোচক ও এর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ সময় ছবি মেলার আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেন। এটি আলোকচিত্রে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় অর্জন।
এছাড়া আন্তর্জাতিক ফটো এজেন্সি মেজোরিটি ওয়ার্ল্ডের সহপ্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম। এই এজেন্সি এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মেধাবী আলোকচিত্রীদের নিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতি, পরিবেশ ও উন্নয়ন ইস্যুতে কাজ করে।
চিত্রগ্রাহক হওয়ার পাশাপাশি তিনি লেখক, কিউরেটর ও অ্যাক্টিভিস্ট। ২০০৭ সালে তিনি কাশ্মিরের ভূমিকম্প নিয়ে ‘নেচার’স ফিউরি’ ও দক্ষিণ এশিয়ায় এইচআইভি/এইডস নিয়ে ‘পোর্ট্রেইট অব কমিটমেন্ট’ শীর্ষক দুটি বই লিখেন। তার লেখা বই ‘মাই জার্নি অ্যাজ অ্যা উইটনেস’ সম্পর্কে লাইফ ম্যাগাজিনের সাবেক পিকচার এডিটর জন মরিস লিখেছেন, কোনো চিত্রগ্রাহকের লেখা সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই এটি। জীবদ্দশায় কত পুরষ্কার পেয়েছেন তার কোন কোনো হিসাব করেননি বরেণ্য এই আলোকচিত্রী। কত প্রদর্শনী করেছেন সে হিসাবও নেই। বই লেখা হয়েছে কয়টা তা-ও মনে নেই। ১৯৮৩ সালে তিনি হার্ভে হ্যারিস ট্রফি জেতেন। ১৯৯৩ সালে তথ্যচিত্রের জন্য জিতে নেন মাদার জোন্স পদক। ‘৯৮-এ তিনি আন্দ্রে ফ্রাঙ্ক ফাউন্ডেশন ও হাওয়ার্ড চ্যাপনিক অ্যাওয়ার্ডস লাভ করেন। ২০১৪ সালে শিল্পকলা পদক ও ২০১৭ সালে চীনের ডালি ইন্টারন্যাশনাল চিত্রপ্রদর্শনীতে আজীবন সম্মাননা লাভ করেন। এই বছর তিনি পান লুসি ফাউন্ডেশন হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড। লুসি ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এই ফাউন্ডেশন সারা বিশ্বের অগ্রগণ্য আলোকচিত্রীদের নিয়ে এবং একইসঙ্গে সম্ভাবনাময় আলোকচিত্রীদের জন্য কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটি আলোকচিত্র–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সম্মাননা পুরস্কার দিয়ে থাকে।