বিশ্বের অস্থিতিশীল দেশগুলোতে জাতিসংঘ পরিচালিত শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছেন। মিশনে কাজের মাধ্যমে দেশে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে (২০১৪ সালে ১.১৬ বিলিয়ন ডলার) এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের আর্থিক স্বচ্ছলতা অন্য বেসামরিক অফিসারদের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। আমলাদের আর্থিক উন্নতিতে ঘুষ, তদবির, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক জালিয়াতির ব্যাপারগুলো থাকলেও শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সেনারা ঝুঁকিপুর্ণ কাজে নিবেদিত থেকেই সৎভাবে নিজেদের ও দেশের আর্থিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। এটা সত্যি গর্ব করার মতো বিষয়।
কিন্তু কথা হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে বিশেষ করে এই ‘রাজনৈতিক অরাজকতার’ দিনে সেনাবাহিনী কি ভূমিকা রাখছেন? তাঁদের কাজে কি সৈনিকের মর্যাদা রক্ষা হচ্ছে? অতি দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে এর উত্তর মূলত এমন হতে পারে যে— ব্যবসা, ব্যবসা, ব্যবসা এবং বেসামরিক ব্যবস্থাপনাতে ঝুকে পড়ছে আমাদের গর্বিত সেনাদের একাংশ।
‘মিলিটারি ইন করপোরেশন’ -বলে একটা কথা চালু আছে। এটা যে দেশে শুরু হয়েছে সেই দেশই দিন দিন সমস্যায় পড়েছে। ব্যাংক ব্যবসা, ফ্লাওয়ার মিলস, বিস্কুট তৈরি, মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, ঔষধ কোম্পানি, পাঁচতারা হোটেল, ট্রাভেল, শপিং, গলফ ক্লাব, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, রিয়েল এস্টেট, চকোলেইট, আইসক্রিম, ট্রেডিং, টেক্সটাইল, লেইক ব্যবস্থাপনা, মেশিন টুলস, পাসপোর্ট ব্যবস্থাপনা থেকে সেতু ব্যবস্থাপনা, একটি দেশে যত রকমের ব্যবসা সম্ভব সব কিছুতেই জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সেনাসহ অন্যান্য বাহিনীগুলো। শুধু তাই নয়, তারা করছে ঠিকাদারি, উন্নয়ন কাজে কন্সাল্টেন্সি, নিচ্ছে ভবন ও ব্রিজ নির্মাণ ও মেইন্টেনেন্স এর কমার্শিয়াল টেন্ডার, করছে বহু বেসামরিক প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা।
এখন দেশের প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে সেনাদের কাজ ভাল বা সেনাদের মাধ্যমে কাজে লুটপাট কম হয় -এই আশায় এইধরণের কাজে সেনাকে টেনে আনা জাতির জন্য হতাশার কারণ। আমাদের সেনাবাহিনী এর চেয়ে জরুরী, ‘জাতীয় সার্ভভৌমত্বের’ রক্ষক। কাজেই এই দিকটি বিবেচনা করলে এই ধরণের ব্যবসায়ী কাজে সেনার গৌরব কোন ভাবেই বৃদ্ধি পায় না। বরং দেশ প্রেমিক সেনাদের বিষয়ে জনমনে বিরুপ মনোভাব তৈরি হয়। নৈতিকতার ‘আদর্শ’ উদাহরণ হিসেবে নিজের অবস্থান সমুন্নত রাখার জন্য এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের অহংকার। এই অহং এর মূল্য অর্থ দিয়ে বিবেচনা করলে চলবে না। কাজেই আমার কথটা আশা করি দেশপ্রেমিক সেনা ও জনগন আত্মসমালোচনা হিসেবেই নিবেন।
লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী পত্রিকা ফাইনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন বলছে ,“বর্তমান সরকার সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে যা অতীতে কোন সরকারই দেয়নি, ভবিষ্যতেও এতটা কেউ দিতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। এসব সুবিধার মধ্যে রয়েছে চীন এবং রাশিয়ার কাছ থেকে সমরাস্ত্র, বিমান, সাবমেরিন কেনার নামে বিপুল বাজেট বরাদ্দ। গত ছয় বছরে প্রতিরক্ষা খাতে বাৎসরিক বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণের বেশি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীকে ব্যবসা করার অবাধ সুযোগ দেয়া হচ্ছে, নতুন সেনানিবাস নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেওয়া অতিরিক্ত অর্থ তারা নিরাপত্তা বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার না করে তাদের অন্যান্য ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে বিনিয়োগ করছে।”
ডিওএইচএস হিসেবে গড়ে উঠছে নতুন নতুন আবাসন যা সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকের জীবন ও আবাসন মানের ব্যবধানকে পর্বতসম বৈষম্যপূর্ণ করে তুলেছে। সামরিক বাহিনীগুলোকে বর্তমান সরকার অনৈতিক সব বড় বড় কাজ ও আর্থিক সুবিধা দিয়ে ব্যস্ত রেখে নিজেরা রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতা ও নির্বাচনী ব্যবস্থা হরিলুটের সুবিধা ভোগ করছে। সমাজে এমন কথা চালু আছে যে, ক্ষমতার বলয়কে সর্বদা একচেটিয়া রাজনৈতিক সুবিধা দেয়া ও অনৈতিক ভাবে উইন উইন সিচুয়েশনে রাখার জন্য সর্বাত্মক ভুমিকা রাখছে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টগুলো। এমনকি দেখা গেছে, বেসামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ দুর্নীতিসহ সামাজিক এমনকি রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অপরাধে বেপরোয়া ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। এই ধরনের অভিযোগ দীর্ঘ মেয়াদে পেশাদার ও সম্মানিত বাহিনী এমনকি দেশের ভবিষ্যতের জন্য বেশ বিপদজনক। এইসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। সেনাবাহিনী দেশের বিচ্ছিন্ন কোন অংশ নয়। জনগনের মনোভাবের দিকে খেয়াল না রেখে নষ্ট রাজনৈতিক ক্ষমতার অধীনতা সেনার গৌরব বৃদ্ধি করবে না। আশা করি দ্রুতই এই অভিযোগগুলোর সম্মানজনক সমাধান হবে।
বাহিনীগুলোই যদি সব ব্যবসা করে তাহলে বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই বা কিভাবে দেশে কাজ করবে করবে? দেশের সাধারণ সরকারি অবকাঠামো খাতে সেনা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হলে দেশের বেসরকারি খাতে পেশাদারিত্ব কিভাবে আসবে? নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মৌলিক কাজ ও ‘নাগরিক সেবা’ ফেলে বাহিনীগুলো যদি বেশুমার ব্যবসাতেই মনোযোগ দেয় তাহলে দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৯৭ শতাংশ যোগান দেয়া বেসরকারি খাতের বিকাশ কিভাবে হবে? যেখানে ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স ২০১৮ তে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম
অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী ব্যবসা করলে অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা বা প্রতিষ্ঠানও কি করে ব্যবসা করবে? আমরা দেখছি জনসেবা ভুলে এই সরকারি ব্যবসায় ভাগ নিতে নানারকম তৎপরতা শুরু হয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিতেও, সেখানেও অনুমোদন দেয়া হয়েছে সীমান্ত ব্যাংকের। তাহলেও পুলিশসহ বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বসে থাকবে কেন? সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে জোরেশোরেই। ইতিমধ্যেই পুলিশ ওয়েলফেয়ারের (পলওয়েল) নামে বেশ কিছু বড় বড় কর্মাশিয়াল ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। দেশের সাধারণ সরকারি অবকাঠামো খাতে সেনা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হলে দেশের বেসরকারি খাতে পেশাদারিত্ব কিভাবে আসবে? কিভাবে বেসামরিক মানব সম্পদ উন্নয়ন বেগবান হবে? এটাও ভাবনার বিষয়। সেনাকে বেসামরিক কাজে না জড়িয়ে বিশ্বমানের সেনাবাহিনী গড়ে তোলার দিকে আমাদের মনযোগ দিতে হবে। এইসব কর্মকান্ড কৌশলে সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার জন্যই যে করা হচ্ছে তা বুঝতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হয় না।
নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মৌলিক কাজ ও ‘নাগরিক সেবা’ ফেলে বাহিনীগুলো যদি এইসব ব্যবসাতেই মনোযোগ দেয় তাহলে দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৯৭ শতাংশ যোগান দেয়া বেসরকারি খাতের বিকাশ কিভাবে হবে? যেখানে ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স ২০১৮ তে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম (দক্ষিণ এশিয়ায় তলানিতে) সেখানে বাংলার সেনাদের ব্যবসায় এত আধিক্য বড়ই দৃষ্টিকটু। উল্টো করে বললে বলতে হয়, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে বলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির স্বাভাবিক প্রতিযোগিতার পথ ও ইলাস্টিসিটি ভেঙে পড়েছে, কেননা বাহিনীগুলো এখানে বহু উপায়ে নানা ভাবে প্রভাব খাটানোর সুযোগ থাকে এবং স্বাভাবিক ভাবেই ‘রাষ্ট্রীয়’ নানান অনৈতিক সুবিধাও পাওয়া যায়, উপরন্তু স্পেশাল ফোর্সের রয়েছে নিজস্ব জমি, রয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ পাবার সুবিধা, আরো রয়েছে বহু নিম্ন ক্যাপেক্স ও ওপেক্স কস্টের সুবিধাদি। ফলে একজন বেসরকারি উৎপাদক কোন ভাবেই সেনা নিয়ন্ত্রিত ব্যবসার সাথে পেরে উঠবে না। যেখানে বেসরকারি ব্যবসার অন্যতম বাঁধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে জমি প্রাপ্তি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ, পরিবেশগত ছাড়পত্র না পাওয়া, সেখানে বাজার প্রতিযোগিতার কৌশলগত অসমতাই উদ্যোক্তা সৃষ্টির অন্যতম বাঁধা হয়ে উঠছে ।
বিস্কুট কিংবা আইসক্রিম তৈরি কোন সশস্ত্র বাহিনীর কাজ হতে পারে না। ব্যবসাকে বেসরকারি খাতে প্রতিযোগিতামূলক রাখার বন্দোবস্ত করা হোক, সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সুবিধা প্রাপ্তির অন্যয্যাতার অবসান হোক
অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীগুলোর ‘নিরপেক্ষ রেফারি’র ভুমিকা পালনের একটা মতৈক্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এরশাদ পতনের কালে। তথাপিও দেখা গেছে সরকারদল, বিরোধীদল ও সেনাবাহিনীর তিনটির দুটি যেদিকে হেলেছে সরকার গঠনের পালা সেদিকেই গিয়েছে। বর্তমানে সেই কৌশলগত অবস্থানও ভারতীয় প্রভাবের কাছে হারিয়েছে আমাদের সামরিক বাহিনীগুলো। এমতাবস্থায় আর্থিক যোগে বুঁদ হয়ে নিজেদের পেশাগত কাজের মান ও দায়িত্ব ভুলে শুধু বিদেশি মিশন এবং দেশি ব্যবসা নিয়েই মহা ব্যস্ত হয়ে উঠলে, দেশের নিরাপত্তা, ব্যবসা, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, রাজনীতি ও প্রশাসনের মান, প্রতিষ্ঠানিক শাসন ও প্রতিষ্ঠান সবকিছু গোল্লায় গেলেও বাংলাদেশের ‘নিরপেক্ষ রেফারি’ বলে কথিত সেনা প্রশাসনের কোন মাথা ব্যথার কারণ থাকবে না। ফলে রাজনৈতিক হরিলুট সহজ হবে।
শান্তি মিশন, ব্যবসা ও বেসামরিক ব্যবস্থাপনার বাইরে বাংলা সেনাদের দায়িত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা ভেবে দেখতে হবে। এই সেনাদের যারা ব্যবসায়ী হিসেসে রেখে দিয়ে হরিলুটের রাজনীতি পোক্ত করতে চায় তাদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। এইসব বিষয় নিয়ে ভাবনার বিস্তর অবকাশ তৈরি হয়ে গেছে ইতমধ্যে। আমরা চাই সেনাবাহিনী এই বিপথগামী ব্যবসা ও বেসামরিক প্রশাসনের ববস্থাপনার বদলে ভুলে বহুবিধ কৌশলগত নিরাপত্তা ও পেশাদারিত্ব তৈরিতে মনোযোগী হোক। বর্তমানের দুনিয়াতে নিরাপত্তা, দেশের ভেতরের রাজনৈতিক সহিংসতা, সীমান্ত ও কূটনীতির সীমা ইত্যাদি বহু জরুরী দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে পালন করতে হয়।
নিজেদের ব্যবসায়ী হয়ে উঠার বদলে বহু জরুরী কাজ হল, দেশের আর্থিক নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাদু পানি ও সমুদ্র সীমা নিশ্চয়তা, বর্ডার সংলগ্ন ব্লকে গ্যাস এক্সপ্লোরেশন, মৎস্য আহরণ, সাগরে ভিন দেশের জলদস্যুতা নিয়ন্ত্রণ, নিজের অনুকূলে আর্থিক সুবিধাহীন ভারতকে একতরফাভাবে দেয়া স্থল নৌ আকাশ বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ট্রানজিট নিরাপত্তা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান প্রতিরোধ, সমুদ্র বন্দর, গ্যাস পাইপলাইন ও অফশোর অবকাঠামো নিরাপত্তাসহ যাবতীয় পেশাদার দায়িত্বে ফেরা আরও জরুরী। আমাদের প্রিয় বাহিনীগুলো এটা সহজেই বুঝতে পারবেন -এই কামনা করি। এই বোধ ফিরুক আমাদের বাহিনীগুলোর মাঝে যে, বিস্কুট কিংবা আইসক্রিম তৈরি কোন সশস্ত্র বাহিনীর কাজ হতে পারে না। ব্যবসাকে বেসরকারি খাতে প্রতিযোগিতামূলক রাখার বন্দোবস্ত করা হোক, সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সুবিধা প্রাপ্তির অন্যয্যাতার অবসান করা হোক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিজেদের যাবতীয় মনোযোগ নাগরিক সেবায় নিবিষ্ট করুক। দেশের চরম বিপদে যেন আমাদের গর্বিত সেনাবাহিনী দেশের জনগনের ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পারে সেই পথ শক্ত হোক। শুভবোধ জাগ্রত হোক দিকে দিকে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।