দল বদলের নেপথ্য নায়ক হোর্হে মেন্ডেজের উত্থান কাহিনী

দল বদলের নেপথ্য নায়ক হোর্হে মেন্ডেজের উত্থান কাহিনী

ফুটবলে দল বদল অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতি মৌসুমে দুইবার দলবদল হয়। আর এই দলবদলের সময় অধীর আগ্রহে বসে থাকেন ফুটবল ভক্তরা। প্রতি মৌসুমেই খেলোয়াড়দের ঠিকানা বদলাচ্ছে। আমরা দেখছি, শুনছি, বুঝছি। এ নিয়ে আমরা কিছুটা ভাবনাচিন্তা করি, ছেড়ে দিই। তবে সাদা চোখে যা দেখা যায়, বিষয়গুলো সব সময় আসলে সেভাবে ঘটে না। চোখের সামনে দেখা এ ঘটনাতেও থাকে অনেক অদেখা কিছু। আর এই দলবদলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকে খেলোয়াড়দের এজেন্ট। কিন্ত কারা এই এজেন্ট? কী করেন তারা? জেনে নেয়া যাক তাহলে।

একজন খেলোয়াড়কে খুঁজে বের করার দায়িত্ব থাকে মূলত স্কাউটদের। কোনো খেলোয়াড় সম্পর্কে প্রাথমিক মূল্যায়ন থেকে শুর করে ক্লাবের কাছে নিয়ে আসেন তারা। তারপর খেলোয়াড়কে দেখে তাকে কেনার ব্যাপারে কথা বলেন এজেন্টের সাথে। আর এজেন্টের মূল লক্ষ্য থাকে দল এবং খেলোয়াড়ের মাঝে সংযোগ করা এবং খেলোয়াড়কে আর্থিকভাবে লাভবান করা। বেশির ভাগ সময় এজেন্টের গুরুদায়িত্বটি পালন করে থাকেন তাদের বাবা-ভাই-কাজিন কিংবা পরিবারের সদস্য। পাঁচবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী লিওনেল মেসি, আরিয়েন রোবেন, নেইমার, হুয়ান মাতারা বাবাকেই রেখেছেন নিজেদের এজেন্ট হিসেবে। আবার অনেকে কোন এজেন্টের ধার ধারেন না। যেমন চেলসি তারকা এডেন হ্যাজার্ডের কোনো এজেন্ট নেই, সরাসরি নিজেই যোগাযোগ করেন।

কিন্ত এজেন্ট নিয়ে এত কথা বলার কি আছে? তারা তো আর তারকা না। তারা তো আদতে দালালি করে, তাই না? তবে এজেন্ট হয়েও কেউ কেউ নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যেই একজন এবং সম্ভবত ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী পর্তুগিজ সুপার এজেন্ট হোর্হে মেন্ডেজ। আসুন জেনে নেয়া যাক কে এই মেন্ডেজ।

হোর্হে মেন্ডেজের জন্ম হয়েছিল ১৯৬৬ সালে লিসবনে। তখন ফুটবলের পর্তুগিজ মহানায়ক ইউসেবিও তার জাদু দেখাচ্ছেন। মেন্ডেজও প্রথম জীবনে ফুটবলারই হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারেননি। বয়স কুড়ির কোটা ছোঁয়ার আগেই পর্তুগালের বেশ কিছু ক্লাবে ট্রায়াল দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। কিন্ত বসে থেকে দিন পার করলে তো চলে না। পেটের দায়ে ভিডিওর দোকান চালানো থেকে শুরু করে কিছু দিন ডিজের কাজও করেছেন। সেখান থেকে কিছু পয়সা জমিয়ে একটি নৈশক্লাবের মালিক হন। কিন্তু তিনি যেন তাতে তুষ্ট হতে পারলেন না। মেন্ডেজ তাই এমন কিছুর সন্ধান করছিলেন, যেখান থেকে প্রচুর টাকা-কড়ি কামানোর পাশাপাশি ক্ষমতার ভোগ-দখলও করা যাবে। তাই আবারো নজর দিলেন ফুটবলেই। কিন্তু এবার আর খেলোয়াড় হিসেবে নয়, ফুটবলারদের এজেন্ট হিসেবে তিনি নেমে পড়েন ট্রান্সফার মার্কেটে। আর ২২ বছর পর এ মানুষটিই এখন ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে ক্ষমতাবানদের একজন!

অবাক হলেন? তাহলে তার মক্কেলদের নামগুলো একবার দেখুন— হোসে মরিনহো, লুই ফিলিপ স্কলারি, কার্লোস কুইরোজ, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, রাদামেল ফ্যালকাও, জেমস রদ্রিগেজ, ভিক্টর ভালদেজ, পেপে, সিলভা, কোয়েন্ত্রাও, ন্যানি, ডেভিড হিয়া ও উঠতি আরো অনেকে। ইউরোপিয়ান ফুটবলে গত এক যুগে যত রেকর্ড সৃষ্টিকারী ট্রান্সফার হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই নেপথ্য নায়ক হোর্হে মেন্ডেজ। ক্লাবগুলোর কাছে তার আরেক নাম ‘সুপার এজেন্ট’।

নৈশ ক্লাবের মালিক থেকে এই উত্থান কিভাবে হল?

প্রথম দিকে এর পেছনে কাজ করছে ‘থার্ড পার্টি’ ফ্যাক্টর। সে ব্যাপারে পরে আসছি। আগে উত্থানের কাহিনী জেনে নেয়া যাক। বয়স তখন হবে ৩০; নৈশক্লাব চালানোর সময় বেশ কিছু উঠতি ফুটবলারকে বন্ধু বানিয়ে ফেলেন মেন্ডেজ। পর্তুগালের সেরা তিনটি ক্লাব— বেনফিকা, পোর্তো ও স্পোর্টিং লিসবনে ফুটবলার বন্ধুদের নাম লেখানোর মাধ্যমে ট্রান্সফার জগতে মেন্ডেজের পথচলার শুরু। হুগো ভিয়েনাকে নিউক্যাসলে নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন মেন্ডেজ। এর মাঝেই চলছিল স্কুল-কলেজ পর্যায়ের খেলোয়াড়দের নিয়ে দলবদলের চিন্তাভাবনা। তবে ২০০৩ সালেই নিজের সেরা কাজটি করে ফেলেন। রিকার্ডো কারেসমা আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর এজেন্ট হয়ে যান মেন্ডেজ। এটাই মূলত তার সেরা দলবদল। কারেসমাকে নিয়ে যান বার্সেলোনার কাছে। এভাবেই পর্তুগাল থেকে বেশ কিছু উঠতি ফুটবলারকে স্পেন ও ইংল্যান্ডে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে সই করিয়ে ইউরোপে নিজের জায়গাটা পোক্ত করে নেন মেন্ডেজ। বিশেষ করে রোনালদোর দলবদলের পর তার নাম ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। এরপর এজেন্ট হন কোচ হোসে মরিনহো আর লুই ফিলিপ স্কলারির। ২০০৪ সালে পোর্তোকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জেতান তার প্রধান মক্কেল ও বন্ধু হোসে মরিনহো। তারপর পোর্তো থেকে মরিনহোকে নিয়ে আসেন চেলসিতে, আর স্কলারিকে জোগাড় করে দেন পর্তুগালের কোচের পদ। স্যার অ্যালেক্সকেও এনে দেন অ্যান্ডারসন আর নানি। কিন্ত স্যার অ্যালেক্সের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন রোনালদোকে। হ্যাঁ রোনালদোকে রিয়াল মাদ্রিদে নিয়ে আসেন মেন্ডেজই। ২০১৪ সালে ডি মারিয়া, ফ্যালকাও, কস্তার ট্রান্সফার ছাড়াও রিয়াল মাদ্রিদকে তিনি প্রলুব্ধ করেন জেমস রদ্রিগেজকে কেনার জন্য। এবং বিশ্বকাপের পরই হামেস রদ্রিগেজকে ৬৩ মিলিয়ন ইউরোতে রিয়াল মাদ্রিদে, ৬০ মিলিয়ন ইউরোতে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াকে ইউনাইটেডে, কস্তা আর মাঙ্গালাকে চেলসি আর সিটিতে আনেন ৩২ মিলিয়ন ইউরোতে।

এখন আসা যাক থার্ড পার্টি কি সেই বিষয়ে। ট্রান্সফার বাজারে ‘থার্ড পার্টি’ নামে একটি টার্ম চালু আছে। থার্ড পার্টিদের কাজ হল কোন উঠতি ফুটবলারের ‘অর্থনৈতিক স্বত্ব’ -এর মালিক হওয়া। ফুটবল এজেন্ট, স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি থেকে শুরু করে যে কোন বিনিয়োগকারীই এ থার্ড পার্টির ভূমিকা নিতে পারেন। এরা আর্থিকভাবে অসমর্থ কোন ক্লাবের তারকা ফুটবলারদের অনুশীলন থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়াসহ প্রায় সব ধরনের ব্যয় নির্বাহ করে। বিনিময়ে ওই তারকা ফুটবলারের ভবিষ্যৎ ট্রান্সফার ফির একটা মোটা অংশ তারা পেয়ে থাকেন। মেন্ডেজ পর্তুগিজ লিগে তার আধিপত্য বিস্তার করে থার্ড পার্টি মালিকানার মাধ্যমেই। তার প্রতিষ্ঠান, ‘গেসটিফুট’ পর্তুগিজ লিগের উঠতি খেলোয়াড়দের অর্থনৈতিক স্বত্ব কিনে নেয়। পেপে, এন্ডারসনদের মত খেলোয়াড়ের মালিকানা ছিল তার এই প্রতিষ্ঠানের হাতে। কিন্ত বর্তমান সময়ে থার্ড পার্টির ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, থার্ড পার্টির ভাগের অর্থ পরিশোধ করতে যেয়ে অনেক ক্লাবই দেউলিয়া হওয়ার পথে কিংবা আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে। স্বয়ং ফিফাও এদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ব্যর্থ! ইউরোপিয়ান ফুটবলের কর্ণধার প্রতিষ্ঠান উয়েফা তাই এগিয়ে এসেছে। খুব দ্রুতই তারা এমন একটি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, যেখানে কোনো থার্ড পার্টিকে ট্রান্সফার আইন (ফিন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে) ভঙ্গ করলে তাদের নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট ওই ফুটবলারকেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বহিষ্কার করা হবে। ২০১৫-১৬ মৌসুম থেকে পরবর্তী পরীক্ষামূলকভাবে আইনটি প্রয়োগ করেছে উয়েফা। মজার ব্যাপার, উয়েফার এ পদক্ষেপ নেয়ার নেপথ্য প্রভাবকও হোর্হে মেন্ডেজ !

সর্বশেষ তিনি বিশ্ব ফুটবলকে চমকে দিয়েছেন রোনালদোকে মাদ্রিদ থেকে য়্যুভেন্তাসে নিয়ে এসে। লিসবন থেকে স্পোর্টিং, ম্যানচেস্টার থেকে চেলসি, বার্সেলোনা থেকে মাদ্রিদ কিংবা মিলান থেকে মোনাকো বা পিএসজি সব জায়গায় তার বিচরণ। বলা হয়ে থাকে, ইউরোপের কোনো তারকা ফুটবলার যদি তার কাঙ্ক্ষিত ক্লাবটিতে যোগ দিতে চান এবং সে ক্লাবটি যদি তাকে কিনতে নাও চায়, তবে সেক্ষেত্রে শেষ ওষুধটি হলেন হোর্হে মেন্ডেজ! তাহলে ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত মেন্ডেজ যতগুলো ট্রান্সফারের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন, সেখান থেকে তার মোট আয় কত হতে পারে? ফুটবলমোদীদের কাছে এর একটাই জবাব হতে পারে— অকল্পনীয়!

হোর্হে মেন্ডেজ স্কোয়াড : ডেভিড হিয়া (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), পেপে (বেসিকতাস), থিয়াগো সিলভা (পিএসজি), ফ্যাবিও কোয়েন্ত্রাও (স্পোর্টিং সিপি), ফ্যাবিনহো (চেলসি), আন্দ্রে গোমেজ (বার্সেলোনা), হামেস রদ্রিগেজ (বায়ার্ন মিউনিখ), অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া (পিএসজি), ফ্যালকাও (মোনাকো), ডিয়েগো কস্তা (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ), ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (রিয়াল মাদ্রিদ)।