টেস্ট সিরিজের সমাপ্তিটা হয়েছিল রীতিমত দুঃস্বপ্নের। দু’ ম্যাচ মিলিয়েও পাঁচ দিন মাঠে থাকতে ব্যর্থ দলটি কোন বেশে হাজির হয় এক দিনের ম্যাচে, মানুষের মনে ছিল এমন ভাবনাই। শুরুতেও সিরিজের শেষটা এমন আনন্দঘন হবে এমনটা বোধয় চরম আশাবাদী মানুষটিও ভাবেননি। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো আবতারে আবির্ভূত বাংলাদেশ এর মূল কারিগর এক এবং অদ্বিতীয় মাশরাফি বিন মুর্তজা।
টেস্ট এবং ওয়ান ডের মধ্যে পার্থক্যটি যে মাশরাফিই গড়ে দিয়েছেন এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করবার মত আদমি বোধ করি কেউ নেই। ইয়ান বিশপের ‘ওয়ারিয়র’ মাশরাফি মাঠেই শুধু না মাঠের বাইরেও এক আশ্চর্য অনুপ্রেরণার নাম। নিকট অতীত বিবেচনায়, বিশেষ করে মাশরাফির অধিনায়কত্বের সময়টুকুতে সিরিজ জয় কোন নতুন অনুভূতি নয়। তবু, আলাদাভাবে কেন মাশরাফি বন্দনায় ব্যস্ত হলাম সেটিই বরং ব্যাখ্যা করা যাক।
শুরুতেই যেমনটা বলেছি, টেস্টে বাংলাদেশ বিপর্যস্ত হয়েছিল চূড়ান্তভাবে। সে দলটিরই সাতজন ছিলেন ওয়ান ডে দলেও। এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের স্মৃতি যখন তরতাজা তখন তিন ম্যাচের ওয়ানে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই জয় দিবাস্বপ্নসমই। অথচ সেটিই ঘটেছে। টস জেতা থেকে শুরু করে ম্যাচের শেষ পর্যন্ত মাশরাফির প্রত্যেকটা সিদ্ধান্তই ছিল পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী যথার্থ।
প্রথম ওয়ান ডেতে বল হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলের জয়ে। নিঃসন্দেহে প্রথম ম্যাচের ফলটি ছিল টনিকের মত। যার প্রভাব দেখা গিয়েছে পরের দুই ম্যাচেও। দ্বিতীয় ম্যাচে অবিশ্বাস্য সে হারের পর বাংলাদেশ কিভাবে ঘুরে দাড়ায় সেটি দেখারও কৌতুহল ছিল অনেকেরই। বিশেষ করে দ্বিতীয় ম্যাচের পরাজয়ের প্রসঙ্গে অনেক বিশ্লেষকই যেখানে সামনে নিয়ে এসেছেন মানসিক সমস্যার বিষয়টি। এমন একটি হারের পর ঘুরে দাঁড়াতে শুধু খেলার স্কিলই না মানসিক অবস্থাও বেশ ভূমিকা রাখে। এখানেও মাশরাফি পালন করলেন যোগ্য নেতার ভূমিকা। তরুণদের ক্রমাগত ব্যর্থতায় নিজেই ওপরে উঠে এসে খেললেন কার্যকর একটি ইনিংস। এ ইনিংসটিই যা বার্তা দেবার দিয়ে দিয়েছে দলকে।
প্রয়োজনের সময় বল-ব্যাট যেকোনো কিছু হাতেই অধিনায়ক যখন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তখন বাকিদের মধ্যে পজিটিভ একটি ভাইব ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় ম্যাচে ডেথ ওভারে ২২ রান দেয়া রুবেল তাই শেষ ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ একটি ওভারে অসাধারণ বল করে ম্যাচটা এনে দিলেন বাংলাদেশের হাতের মুঠোয়। ঠিক আগের ম্যাচেই যিনি এমন পরিস্থিতিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তিনি যখন দেখবেন পরের ম্যাচেও অধিনায়ক তার ওপর আস্থা হারায়নি তখন অবধারিত ভাবেই একটি তাড়না কাজ করবে সবটুকু নিংড়ে দেয়ার। রুবেলের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটেছে।
শুধু শেষ ম্যাচেই না, পুরো সিরিজেই মাশরাফির বোলিং চেঞ্জ, ফিল্ড প্লেসিং ছিল চোখে লাগার মত। যার প্রশংসা করেছেন ধারাভাষ্যে থাকা সকলেই। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে খেলোয়াড়দের সমর্থন ছাড়া অধিনায়ক যতই ভাল হোক তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব না। পক্ষান্তরে এটাও সত্য যে, খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ভালো টুকু আদায় করে নেয়াটাও একজন ভালো অধিনায়কের যোগ্যতা। আর মাশরাফি সেটা পেরেছেন বলেই পুরো সিরিজেই অসাধারণ খেলেছেন তামিম-সাকিবরা।
এর আগেও মাশরাফি অসাধারণ কিছু সিরিজ জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যা ইতিহাসই সাক্ষ্য দেবে। তারপরেও এ সিরিজটি আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখবে সব সময়। একজন নেতা কি করে বদলে দিতে পারেন পুরো একটি দলকে তার একটি অনন্য চিত্রায়ণ ছিল এ সিরিজটি। যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর আগে ছিল মাশরাফির বিষাদের গল্পের প্লট, সে উইন্ডিজেই নিজেকে আরো নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন তিনি।