গায়ানাতে অবিশ্বাস্য হারের পর আলোচনায় উঠে এসেছে একাধিক বিষয়। বারবার জয়ের কাছে গিয়েও হারের কারণ হিসাবে অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন মানসিক সমস্যার কথা। স্কিল, অভিজ্ঞতা নিয়েও আলোচনা চলছে। আমার কাছে বিষয়টি একটু আলাদা। ব্যাখ্যা করবো পুরো লেখাটাতেই।
আপনি যদি উপমহাদেশের ক্রিকেটের নিয়মিত খবরাখবর রেখে থাকেন, তাহলে ন্যাচারাল ট্যালেন্ট শব্দটা আপনার বেশ পরিচিত হবার কথা। এই ন্যাচারাল ট্যালেন্টদের ন্যাচারাল খেলা নিয়ে বিস্তর হইচই হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও। কিন্তু যে বিষয়টি লক্ষ্য করা প্রয়োজন, সেটি হল এই ন্যাচারাল খেলা খেলে কতজন সফল হয়েছেন এবং কতজন হারিয়ে গিয়েছেন?
গায়ানা ওয়ান ডে বেশ ভালো একটি প্লট বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য। শুরুর দিকে এনামুলের ঝড়টি বিস্মৃত হবার কোনো কারণ নেই। ৯ বলে দুটি চার এবং দুটি ছয়ে তিনি করেছিলেন ২৩ রান। ওপেনিংয়ে নামা একজন ব্যাটম্যানের কাছ থেকে তার দল নিশ্চিতভাবেই নয় বলের ক্যামিও প্রত্যাশা করে না। একই কথা সাব্বিরের জন্যও প্রযোজ্য; জয়টা যখন হাতের মুঠোয় তখন সেফ ওয়েতে খেলা শেষ না করে ঝুকিপূর্ণ শট খেলার ফলাফল তো ম্যাচ শেষেই পরিষ্কার।
এখানে ন্যাচারাল খেলাটাকে কেন টেনে আনা? দুজনই স্ট্রোক খেলতে ভালোবাসেন এবং তাদের ভাষ্যমতে সেটিই তাদের ন্যাচারাল খেলা। এখন এই ধাঁচের ন্যাচারাল খেলার কার্যকারিতা কতটুকু তার উদাহারণ তো উপরেই বয়ান করলাম। হ্যাঁ, ন্যাচারাল খেলা খেলে যে সবাই ব্যর্থ হয়েছেন তা না। উপমহাদেশের কথাই যদি বলি তাহলে স্ট্রোক মেকিংয়ের জন্য শেহওয়াগ বা জয়াসুরিয়ার নাম অনায়াসেই নেয়া যায়। এ দুজন তাদের খেলাটা খেলেই বিশ্বমাত করেছেন। তাই তাদের নিয়ে প্রশ্নও ওঠেনি। কিন্তু এমন কয়জন? আর কারাই বা টিকে রয়েছেন?
এক্ষেত্রে বেশ ভালো একটি উদাহারণ হতে পারেন তামিম ইকবাল। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনিও বেশ অবসেসড ছিলেন এই ন্যাচারাল খেলা নিয়ে। বর্তমান তামিমের সাথে সেই তামিমকে মিলিয়ে দেখুন, আকাশ-পাতাল তফাত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম ওয়ান ডেতেই বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে মন্থরতম সেঞ্চুরিটি করেছেন তিনি। তারপরও বাংলাদেশ ম্যাচটি জিতেছে এবং তামিমও ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন। কারণ, ম্যাচের কন্ডিশন স্ট্রোকের বদলে টিকে থাকা দাবি করছিল। আর সেটি করতে পেরেছেন বলেই তামিম সফল। শুধু প্রথম ওয়ান ডেই না, বিগত কয়েক বছরে তামিমের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ ন্যাচারাল খেলার অবসেশন থেকে বের হয়ে ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলতে পারা। হ্যাঁ, প্রত্যেক ম্যাচেই হয়ত রান আসবে না, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আসবে এবং আসছেও। যার ফলে, টেস্ট, টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ান ডে, তিন ফরমেটেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোরার তিনি।
বাংলাদেশের ব্যাটিং বলতে যা কিছু, তা মূলত চারজনকে ঘিরেই; তামিম-সাকিব-মুশফিক এবং মাহমুদুল্লাহ। এরা প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফল কারণ তারা সময়ের দাবিটা বুঝতে পারছেন। আপনি বিশ্বের অন্যদের সাথে তুলনায় তাদের পিছিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে যে কয়বারই বড় সাফল্য পেয়েছে তাতে এদের অবদানই সিংহভাগ।
ক্যামিও খেলাটা কখন প্রয়োজন সেটি মুশফিক দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ান ডেতেই। সাব্বিরের মত তার নামের শুরুতে হার্ড হিটার যোগ করা হয় না। গ্রামার মেনেই যে ঝড় তোলা যায় সেটি সেদিন বেশ ভালোভাবেই দেখিয়েছেন তিনি। এখন কথা হচ্ছে, ইনিংস লম্বা করার দায়ও এ চারজনের, ক্যামিওর দায়ও এদেরই; তাহলে বাকিদের কাজটা কি? সাব্বির শেষ কবে একটি কার্যকর ইনিংস খেলেছেন তিনি নিজেও বোধয় জানেন না। এনামুলকে নিয়ে মিডিয়ার বিস্তর হইচইয়ের পর তিনি দলে আসলেন, ৬ টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে এখনো একটি হাফ সেঞ্চুরি পর্যন্ত নেই! চোখে লাগার মত তার আউট হবার ধরনগুলোও।
এমন ন্যাচারাল খেলার ওপরে আসলে কতটা ভরসা করা যায়? ন্যাচারাল খেলার কথাই যদি আসে তাহলে আশরাফুলের নাম আসতে বাধ্য। তিনিও কি খুব সফল ছিলেন? কমপক্ষে ৩০০০ রান করেছেন এমন জেনুইন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আশরাফুলের গড় সবচেয়ে খারাপ। অথচ, তার যে সামর্থ্য ছিল সেটির অর্ধেকও যদি এই অবশেসনে না ভুগে কাজে লাগাতেন তাহলে আশরাফুল আক্ষেপের বদলে অন্য গল্পের নায়কই হতেন।
বোলিংয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মোস্তাফিজের কথাই যদি বলি, তিনি যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছেন আর এখন যা অবস্থা তা বিস্ময়কর। দীর্ঘ ইনজুরি থেকে ফেরার পর স্বাভাবিক ছন্দ পেতে সময় লাগে সত্য, কিন্তু শুধু এটাই সমস্যা? মোস্তাফিজের একমাত্র অস্ত্র কাটার। এখন পর্যন্ত তার হাতে কোনো নতুন ডেলেভারি নেই! শুধু কাটার দিয়ে দিনের পর দিন সাফল্য পাওয়া এ যুগে সম্ভব? এখানে অবশেসনের সাথে অনিহাও যোগ করে নিতে পারেন।
এখানে মিডিয়ারও দায় আছে। একটি সিরিজ ভালো খেলা মাত্রই যেভাবে একেকজনের নামের শুরুতে বিশেষণ যোগ করা হয়, তাতে পা মাটি রাখা কষ্টকরই। সবচেয়ে কষ্টকর হচ্ছে, এরাই যখন খারাপ করে তখন মিডিয়ায় এদের অস্তিত্বও থাকে না। বিষয়টি খেলোয়াড়দেই অনুধাবন করা প্রয়োজন। যে হাইপটি তোলা হয়, সেটি পাবলিক সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ফায়দার জন্য। কাজ শেষ, তো খেলোয়াড়ের দামও শেষ। কিন্তু এই সাময়িক ঝলকানিতেই মাথা ঘুরে পথ হারিয়েছেন বহু খেলোয়াড়। এটি থেকে খেলোয়াড়দেরই শিক্ষা নেয়া উচিত।
বাংলাদেশের যারা তরুণ খেলোয়াড়, তাদের উদাহারণ খোঁজার জন্য বাইরে যেতে হবে না। তামিম-সাকিবদের দেখেই শেখা যায়। এরা দশক পার করার পরেও সমান গ্রহণযোগ্য কারণ তার পারফর্ম করছে, সেটি নিজেদের ন্যাচারাল গেম বিসর্জন দিয়েই। যতদিন এই ন্যাচারাল গেম অবশেসন থেকে খেলোয়াড়রা বের হতে না পারবে ততদিন এ অবস্থা চলতেই থাকবে। নিয়মিত জয়ের পেতে দরকার এমন সব খেলোয়াড় যারা অবসেসড না, পানির মত হবে। পরিস্থিতি যা দাবি করবে সেটা মেটাতে পারবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সামনেই জ্বলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত থাকার পরেও কেউ শেখে না। পরের ম্যাচেই যদি ৪০-৫০ রান আসে, তাহলে বেশ বুক ফুলিয়েই বলতে শোনা যাবে ন্যাচারাল খেলা খেলেই এ সাফল্য! আর মিডিয়াও সেটি নিয়ে আবেগময়ী দুটো গল্প লিখবে!