রাষ্ট্র প্রধানের বয়ান ও সত্যের মৃত্যু

রাষ্ট্র প্রধানের বয়ান ও সত্যের মৃত্যু

মিচিকো কাকুতানি আমেরিকার প্রথম শ্রেণির সাহিত্য সমালোচকদের একজন। তিনি সাহিত্য ছাড়াও সমাজ এবং রাজনীতি নিয়ে কাজ করে থাকেন। অনেকেই মনে করেন নিউইয়র্ক টাইমসের এই গ্রন্থসমালোচক যে কোন বইয়ের সমালোচনা করে লেখককে কাঁদাতে এবং হাসাতেও পারেন। তিনি ১৯৯৮ সালে সমালোচনার জন্য সম্মানজনক পুলিৎজার পুরস্কারও পেয়েছেন।

‘দ্য ডেথ অব ট্রুথ: নোটস অন ফলসউড ইন দ্যা এজ অব ট্রাম্প’ মিচিকো কাকুতানির প্রথম গ্রন্থ। অথচ প্রথম বইয়েই বাজিমাত করলেন তিনি। বইটি ২০১৮ সালের জুলাইয়ের ১৭ তারিখ বাজারে এসেই আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের বক্তব্য-বয়ানে যে ভাবে সত্যের করুণ মৃত্যু ঘটে চলেছে তা নিয়ে খুব গভীর কোন কাজ চোখে পড়ে না। মিচিকো কাকুতানির এ বইটি সে অভাব খানিকটা হলেও ঘুচেছে।

বইটিতে জার্মানি, রাশিয়া এবং আমেরিকার প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা উপস্থাপিত হলেও তা বাংলাদেশের জন্য এই সময়ে বেশ প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ক্ষমতাসীনদের মিথ্যে প্রপাগান্ডা ছড়ানো এখানকারও নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যেস। তাদের প্রতিদিনের বয়ানে ঘটে চলেছে সত্যের করুণ মৃত্যু।

বইটির বিষয় এমন যে, একজন রাষ্ট্রপ্রধান (বইয়ের ভাষায় প্রেসিডেন্ট) মিথ্যে বলেন তারই ইতিহাস এটি। সেই প্রেসিডেন্টের নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান’র একজন ব্যবসায়ী সদস্য। এই ব্যক্তি পরমাণু কূটনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মিথ্যে বলেন অবলীলায়। মিথ্যে তার ভিতর এতটাই প্রোথিত যে তিনি গুরুত্বহীন তার ‘গল্ফ খেলা’ নিয়েও মিথ্যে বলেন হাসতে হাসতে। তিনি মিডিয়ার সামনে খুব আবেগ নিয়ে মিথ্যে বলেন। যা আপনি বাংলাদেশের বেলাতেও হুবহু দেখতে পাবেন। আপনি-আমি, আমজনতা সবাই প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি এমন অনেক বিষয়েও তিনি মিথ্যে বলেন। কিছুক্ষণ আগে বলা কথার ক্ষেত্রেও তিনি মিথ্যে বলেন। আল্লাহর আরশ না কাপা পর্যন্ত যেন তিনি মিথ্যে বলেই যাবেন! যতক্ষণ না আপনি বরফের বালতিতে মাথা ডুবিয়ে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেন। যতক্ষণ না আপনি দুই হাতে কান চেপে এই মিথ্যের রাজত্ব থেকে বধিরত্বে পৌঁছান। ততক্ষণ তিনি মিথ্যে বলেই যাবেন।

আসলে এরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে লাখ লাখ আমেরিকান বেঁচে আছে। বাংলাদেশেও আমরাও কি তাই নই?

আমরা সবাই জানি, আমেরিকা মেক্সিকোর অভিবাসন প্রার্থী শিশুদের তার পিতামাতার কাছ থেকে আলাদা করছে। অথচ ট্রাম্প তা অস্বীকার করছেন, অস্বীকার করছে তার দল রিপাবলিকান। একইভাবে বাংলাদেশেও দেখবেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, হত্যা, গুম, বিরোধীমত-দলের উপর অত্যচার সবই চলছে প্রকাশ্যে। কিন্তু সবই অস্বীকার করছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে ক্রমাগত মিথ্যা বলে চলেছেন। এতে করে ক্ষমতার সাথে জড়িত মানুষ সত্যকে হত্যা করার একটি উৎসবে যেন মেতে উঠেছেন। আমেরিকা বা বাংলাদেশসহ যে কোন গণতান্ত্রিক দেশের অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা লোভী রাষ্ট্রের এটাই যেন সাধারণ চরিত্র এখন। একটি নিষ্ঠুর সত্য কথা হত্যার খেলার মৌসুম যেন চলছে দুনিয়াতে।

মিচিকো কাকুতানি

মিচিকো কাকুতানি তার বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদের শেষে স্টিফেন উইগ’র ১৯৪২ সালের স্মৃতিকথা ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড অফ ইয়েস্টারডে’র দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যেখানে বিস্তারিতভাবে অস্ট্রিয়া এবং হিটলারের উত্থানের ধারাবিবরণী রয়েছে।

যেখানে জনগণ শাসকদের অভ্যস্ত জীবনযাপনে, নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন ও অভ্যাসে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেখানেই মিথ্যের অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। উইগ লিখেছেন, মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না, কিভাবে তাদের স্বাধীনতাকে চুরি করা হচ্ছে। কাকুতানি তার বইয়ে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান সম্পর্কে একটি সতর্কবার্তা তুলে ধরতে চেয়েছেন।

যে বার্তাটি হল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এই বিষয়ে অসংখ্য নিবন্ধ আছে যা আইন, ব্যবসা, ভোটাধিকার, পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা লিখেছেন। কাকুতানি’র ‘দ্যা ডেথ অব ট্রুথ’ দৃষ্টি দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভ্রান্তিকর সাংস্কৃতিক বক্তব্যের দিকে যা আমাদের জীবনে ও রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

ইন্টারনেটের কাজ, যুক্তরাষ্ট্রের উপর রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এবং ভাষার অধঃপতন সবই ঘটছে সত্যকে হত্যার মধ্যদিয়ে। মূলত যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের অফিস থেকে প্রচারিত হচ্ছে। ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে তিনি যা যা জনকল্যানে করেছেন বলে প্রচার করা হচ্ছে, তা হল ভূয়া খবর।

কাকুতানি দেখিয়েছেন সাহিত্যিক কাজে বা শিল্পভাষ্যেও কিভাবে এইসব উগ্র মিথ্যাচারী প্রবণতা প্রভাব বিস্তার করে। স্বৈরাচারী লেখক মানুষের আগেব-অনুভূতির কথা চিন্তা না করেই স্বতস্ফূর্তভাবে একচরিত্র দিয়ে অপর চরিত্রকে পেরেক ঠোকার ক্ষমতা দেখিয়ে থাকেন। যখন একজন সমাজসচেতন লেখক ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন খলনায়ককে ধারণ করেন মনে-মগজে তখন অবশ্যই তিনি জীবনের চেয়েও বেশি নারসিজম, অহংকার, অজ্ঞতা, অন্ধকারই ধারণ করেন। সেইগুলোই প্রধান্য পায় তার কাজে।

লেখক হিটলারের জার্মানি শাসন এবং লেনিনের রাশিয়া শাসনের সমান্তরালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা শাসনকে দাঁড় করিয়েছেন। আর আপনি চাইলে এখন খুব সহজেই সেটাকে বর্তমান বাংলাদেশের সমান্তরালে পড়তে পারবেন।

মিচিকো কাকুতানি ঐতিহাসিক অ্যান অ্যাপলবায়াম এবং রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হান্নাহ আরেন্ড এর বইয়ের রেফারেন্স টেনেছেন তার পর্যবেক্ষণের কাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়া কিভাবে প্রভাব ফেলে তাও ব্যাখ্যা করেছেন বইটিতে। তিনি উল্লেখ করেছেন ভার্চুয়াল বাস্তবতার অগ্রপথিক জ্যারোন লানিয়ের এবং কলম্বিয়া ল’ স্কুলের অধ্যাপক টিম উ’র উদ্ধৃতি। ইতিহাসবিদ রিচার্ড হফস্টাডটার এর ১৯৬০ সালের একটি বিশ্লেষণ ব্যবহার করেছেন ট্রাম্প-সমর্থকদের মনোভাব বোঝার জন্য।

কাকুতানি মনে করেন, উত্তরাধুনিকতার উপর এই ভুয়া খবরের দায় বর্তায়। এই তত্ত্বটিকে জ্যাক দেরিদা ও মিশেল ফুকো জনপ্রিয় করে তুলেছেন। যেখানে শব্দ এবং শব্দের অর্থ আলাদা। এই যুক্তিতে অনেক মিথ্যা বলেও সেটাকে তাত্ত্বিক মোড়কে বা রাজনৈতিক প্রতিভার আলোকে বৈধতা দিতে চান।

তিনি জেন মায়ার’র ‘ডার্ক মানি’ গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছেন উগ্র ডানপন্থি রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করার জন্য। বর্ণবাদের ভয়াবহতা বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন তা নেহিসি’র ‘বিটউইন দ্যা ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড মি’। দরিদ্র এবং ধনীর মধ্যকার যে দূরত্ব তা ভালো ভাবে বুঝবার জন্য কাকুতানি সহায়তা নিয়েছেন থমাস পিকেটি’র আলোচিত বই- ‘ক্যাপিটাল’ এর।

যাইহোক, বইটির সাবটাইটেলে স্পষ্টত ‘নোট’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এটি সমস্ত পর্যবেক্ষণকে একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন আসলেই আমেরিকায় কি ঘটছে? আমার অনুমান, একজন গ্রন্থসমালোচক রচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা বিষয়ক বই যারা হাতে নেবেন তারা অবশ্যই নিউজ চ্যানেল কমবেশি দেখেন। এবং তারা জানেন জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তব। তারা অবশ্যই লেখকের মতোই ট্রাম্পের ট্যুইট বার্তার নিন্দা করবেন। তারা অবশ্যই রবার্ট ম্যুলারের রাশিয়া বিষয়ক অনুসন্ধানকে সাপোর্ট করবেন। তারা সংবাদ দেখা অব্যাহত রাখবেন এবং পত্রিকার গ্রাহক হবেন। প্রতিদিন যা ঘটছে তার বিশ্লেষণ যা পত্রিকায়, অনলাইনে, রেডিওতে, টেলিভিশনে নিয়মিত হাজির হচ্ছে তার ভোক্তা হবেন। কিন্তু এই সবের মধ্য দিয়ে কি ভাবে সত্যের মৃত্যু ঘটছে তারই অসামান্য বিশ্লেষণ এই বইটি তুলে ধরেছে।

শেষ পরিচ্ছেদে, কাকুতানি দৃষ্টি নিবন্ধিত করেছেন ২০১৬ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপে প্রসঙ্গে। তিনি রাশিয়ান প্রোপাগান্ডা মাস্টার ভ্লাদিসভ সুরকভ’র স্ট্রাটেজি ব্যবহার করেছেন। সুরকভ একজন উত্তরাধুনিক থিয়েটার ডিরেক্টর যাকে বলা হয় পুতিনের সময়কালের প্রকৃত মেধাবী। কিভাবে প্রচার চালিয়ে জনগণকে বশ করতে হয় তার ওস্তাদ লোক তিনি।

কাকুতানি’র গ্রন্থসমালোক থেকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হয়ে ওঠাটা আংশিক সফল বলতে হবে। তবে বইয়ের মধ্যে বসবাস করা একজন ব্যক্তি হিসেবে পাঠকদের কাছে তার অভিব্যক্তি আরও পরিস্কার হওয়া উচিত ছিল। অন্তত বলা উচিত ছিলো, “জনতা বোকা নয়!”। সত্যের মৃত্যু জনগণ টের পান।