সাইফুল হক ২৬ শে জুলাই ১৯৫৬ সালে চট্রগ্রামের স্বন্দীপে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে স্কুলে থাকতেই রাজনীতি শুরু করেন। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন। ৮২-৯০ এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি’ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাইফুল হক। ১৪ জুন, ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যবদ্ধ যৌথ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার বিরোধিতা করে ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি’ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে শুরু করেন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কস পার্টি। তিনি গত এক দশক ধরে দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সাথে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখালেখিতেও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। ১৮টি বই লিখেছেন। বর্তমানের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বামদলগুলোর একটি ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ‘দুঃশাসন, জুলুম, দুর্নীতি, লুটপাট, পরিবারতন্ত্র রুখো’ এ আহ্বানে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ নামের এই ঐক্য প্রক্রিয়ার অন্যতম উদ্যোক্তা ও সমন্নয়ক সাইফুল হক। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থাসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে জবানের সাথে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাতুল ইসলাম রাফি
বাম দলগুলোর এই ঐক্য বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে?
সাইফুল হক : আমরা তো বহুদিন ধরে কাজ করছি। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রিক যে জোট, আর বিএনপি কেন্দ্রিক যে জোট আছে, এর বাইরে আমরা প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-দেশপ্রেমিক সকল দল ও সংগঠন এবং জনগণকে সাথে নিয়ে একটা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার ডাক দিয়েছি।
এই জোটটা নতুন, কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন রাজপথে লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে আছি। এর ফলে আমরা মনে করছি যে, কার্যত বাংলাদেশে এখন তো দুটি জোট, যারা মানুষকে একধরনের জিম্মি করে ফেলেছে। বিশেষ করে এই সরকার, তাদের যে জুলুম-দুঃশাসন-দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন-জবরদখল-সন্ত্রাস বা রাষ্ট্রীয়সন্ত্রাস এমনকি মানুষের যে সাধারণ ভোটাধিকার ছিল, সেটাও কেড়ে নিচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। এর বাইরে বিএনপি-জামাত মানে ২০ দলীয় জোট, এরাও এর বিরুদ্ধে কথা বলছেন, ভোটাধিকারসহ নির্বাচনের কথা বলছেন। কিন্তু, আমরা দেখছি যে নীতি-আদর্শের দিক থেকে তাদের মাঝে বড় দাগের কোনও পার্থক্য নেই। তারাও যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তারাও এই জুলুম-নির্যাতন-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, এসব কিছুই তারা অব্যাহত রেখেছিলেন।
ফলে যেটা দাঁড়ায়, এদের দুয়েই কার্যত মানুষ জিম্মি থাকছে। আমাদের মানুষ অধিকাংশ সময়ে বিএনপির ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামীলীগকে ভোট দেয়, আবার এর বিপরীতটাও করে। এই মানুষের সামনে আমরা এখনো পর্যন্ত কোন গ্রহণযোগ্য-দৃষ্টিগ্রাহ্য-আস্থাভাজন কোন দল শক্তিশালীভাবে হাজির করতে পারিনি। এই জোটের মাধ্যমে আমাদের লক্ষ্য হল, যেসব মানুষগুলো একটা নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির পক্ষে দাঁড়াতে চায়, সেই মানুষদের জন্যই আমাদের জোট। আমি মনে করি যে, ক্রমান্বয়ে আমাদের জোট মানুষের সমর্থন লাভ করবে, যেহেতু মানবপ্রেম-মানবমুক্তি-জনগণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করাই আমাদের লক্ষ্য এবং আমাদের যুক্তির যে শক্তি -এর মধ্য দিয়ে মানুষের বোধ উদয় হবে, তাদের চেতনার জায়গাটা শাণিত হবে এবং মানুষকে আমরা আমাদের সাথে পাব। আর তাহলে বিদ্যমান রাজনীতির যে সমীকরণ ‘একটা ছেড়ে অন্যটাতে যাওয়া’ এর বাইরে মানুষ একটা বিকল্প পথ পাবে। আর তার মধ্য দিয়েই আমরা জাতীয় রাজনীতিতে একটা প্রভাব রাখতে পারব, নতুন মাত্রা যোগ করতে পারব।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বর্তমান সরকারের যে দমন-নিপীড়ন, তা প্রতিরোধের শক্তি বাম দলগুলোর আছে বলে মনে করেন?
হক : প্রথমত, এইটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে তো আমরাই লড়ছি, যদিও এর দ্বারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বি.এন.পি বা তাদের মিত্ররা। কিন্তু, খেয়াল করবেন, আমাদের শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন প্রভৃতি এগুলো আক্রান্ত হচ্ছে। সুতরাং, আক্রমণটা আমাদের ওপরও আসছে। আমরা তো ধারাবাহিক কথা বলছি, লড়ছি; মানুষের সমর্থনও আমরা পাচ্ছি। আমরা কিছু-কিছু ক্ষেত্রে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগও করছি। কিন্তু, সমগ্র দুঃশাসন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করা দরকার, সেটা বোধ হয় আমরা এখনও করতে পারিনি এবং করাটা আমাদের রাজনৈতিক কর্তব্যও বটে। তবে আমরা মনে করি যে, এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আমরা নিশ্চয় সফল হব।
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে অন্যান্য আন্দোলনের তুলনায় বামদের সক্রিয়তার যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কী?
হক : এটা সত্য নয়, আমি দ্বিমত পোষণ করছি। বামদলগুলো কিংবা আমাদের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, অর্থাৎ আমাদের জোটভুক্ত দলগুলো শুরু থেকেই এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতার পক্ষে সমর্থন দিয়ে আসছে, আমাদের জায়গা থেকে আমরা কথা বলছি। এছাড়া আমাদের সহযোগী ছাত্রসংগঠনগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে সক্রিয় আছেন। এমনকি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ব্যানারে যে আন্দোলন চলছে, সেখানেও আমাদের সাথে আদর্শিক বা রাজনৈতিকভাবে যুক্ত ছাত্ররা আছেন। কিন্তু, সেখানে আমরা অন্যান্য দলের মতো দখলদারিত্ব কায়েম করার চেষ্টা করিনি। আমরা মনে করি, এটা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ব্যানারেই হওয়া উচিৎ, এতে আন্দোলন আরো বেশি আবেদন পাবে। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের ওয়াদা দেবার পর যেভাবে তিনশো ষাট ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেলেন, দেখুন, ছাত্ররা কিন্তু কোটা ব্যবস্থার একটা যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছ; বাতিল চায়নি। বাতিলের কথা কেউ বলেনি, বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। রাগ-ক্ষোভ অভিমানে তিনি বাতিলই করে দিলেন। রাষ্ট্রের কোনও প্রধান নির্বাহী এমন আচরণ করতে পারেন না, এটা শপথ ভায়োলেশনের শামিল।
বর্তমান সরকার তথা মহাজোট সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন হওয়ার কোনও সুযোগ নাই
কিছু কিছু বাম দল কিন্তু এর মধ্যে আবার সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনাও করছে, তো তাদের নিয়ে জোটের ব্যাপারে মানুষ কতটা আশাবাদী হতে পারে আসলে?
হক : এটা খুব স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগের সাথে আমাদের জোটের কোনও সম্ভাবনা নাই। বর্তমান সরকারের দুঃশাসনই আমাদের জন্য প্রধান বিপদ। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ আমাদের বিপদ এবং বিএনপি আমাদের আপদ। এই দুই মাফিয়ার বাইরে মানুষের জন্য একটা বিকল্প কিছু গড়ে তোলা এবং সেটারই ডাক আমরা দিয়েছি।
আগামীতে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আপনাদের কী ধরনের তৎপরতা থাকবে?
হক : এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেটা করতে হবে, এখন যে পার্লামেন্ট আছে, যেটা ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে, যার কোনও ম্যান্ডেট নাই, এই পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করতে হবে তফসিল ঘোষণার আগে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকার তথা মহাজোট সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন হওয়ার কোনও সুযোগ নাই; ইতোমধ্যেই তারা এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে।
এমনকি স্থানীয় নির্বাচনেও তারা যে জবরদখল করছে, সেটাও প্রমাণ করে যে এদের দ্বারা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই আমরা বলছি, নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে ও নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ তদারকি-সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে, এটা আর নিরপেক্ষ নাই। কারণ, দেখুন, ইন্টার সিটিকর্পোরেশন নির্বাচন যে হচ্ছে, সেখানে চৌদ্দ থেকে বিশ লাখের বেশি টাকা মেয়র প্রার্থীদের খরচ করবার কথা না, কিন্তু, তারা পোস্টার আর ফেস্টুনেই খরচ করেছে কয়েক কোটি টাকা, ইলেকশন কমিশনের সামনেই। বিশেষ করে সরকারি দল, তবে অন্যরাও করছে। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন তাদের সম্মান-দায়িত্ব-মর্যাদাকে পুরোপুরি ভূলুণ্ঠিত করেছে। সুতরাং, পুরো ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টাতে হবে, আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
আপনি যে ‘তদারকি-সরকার’-এর কথা বলছেন, এটা কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো?
হক : অনেকটা এরকম। তবে আগেরকার কিছু নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বিধিবিধানগুলো একটু পরিবর্তন করা যেতে পারে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শ করে এটা ঠিক করতে হবে যে, সেই তদারকি সরকারের রুপটা কেমন হবে।
যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে বাম দলগুলোর ইমিডিয়েট রাজনৈতিক ফায়দা কী?
হক : ইমিডিয়েট ফায়দা বলতে, আদতেই যদি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন হয়, তবে আমরা অবশ্যই অংশগ্রহণ করব এবং এর মধ্য দিয়ে আমরা চাইবো এমন একটা ব্যবস্থা নিয়ে আসতে, যা চলমান দুঃশাসন ব্যবস্থাটায় পরিবর্তন আনবে। আমরা মানুষের কাছে আমাদের কর্মসূচি নিয়ে যাব এবং এটাকে জনপ্রিয় করবার চেষ্টা করব এবং কিছু সংগ্রামী মানুষকে আমরা যেন সংসদে নিয়ে আসতে পারি, সে-ব্যাপারে কাজ করব।
আওয়ামীলীগ একটি ফ্যাসিস্ট দলে পরিণত হওয়ার পরও যেসব বাম দল এখনও সরকারের সাথে আছে, তাদের আপনারা গণবিরোধী কিংবা গণতন্ত্র বিরোধী বলে মনে করেন কি না? যদি করে থাকেন, তবে এদের প্রতিরোধের উপায় কী?
হক : আমরা মনে করছি যে, যারা ওদের (আওয়ামী লীগ) সাথে আছে, তারা বাস্তবে এই দুঃশাসনের সহযোগী। মুখে তারা বামপন্থি বলছে যদিও, কিন্তু বহু আগেই তারা বাম-প্রগতিশীল মতাদর্শ বিসর্জন দিয়েছে, রাজনীতি তারা বিসর্জন দিয়েছে। যেহেতু সমাজে এখনও বামপন্থিদের একটা গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, সেহেতু এক প্রকার আলখেল্লা পরে সেটাকে তারা ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। ফলে, তাদেরকে আমরা আর বামপন্থি-শিবিরের লোক বলে গণ্য করি না। আর তাদের মোকাবেলা করার ব্যাপারে বলব, সরকারের এই দুঃশাসন মোকাবেলার মধ্য দিয়ে ওদেরকেও মোকাবেলা করার কাজটা হয়ে যাবে। তাছাড়া ওদেরকে আলাদা করে প্রতিরোধ করবার এজেন্ডা আমাদের নাই এবং ওরকম কোনও শক্তিও তারা নয়।
ধর্মকে যেভাবে পশ্চাৎপদ-প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার জায়গা থেকে আখ্যায়িত করা হয়েছে, এতে করে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে অনেক সময় জেনে বা না জেনে আঘাত দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি, ধর্মের ব্যাপারটাকে শুরু থেকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়নি। ধার্মিক মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, তাদের বক্তব্যের মাঝে আমরা আমাদের কর্মসূচিকে নিয়ে যেতে পারিনি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামদের গণভিত্তি দুর্বল হওয়ার কারণ কী?
হক : প্রথমত, সবাই যেটা বলে যে, আমাদের মধ্যে অনেকগুলো ভাগ-বিভক্তি, যার ফলে দল ছোট হয়েছে, সাংগঠনিক শক্তি কমেছে। সুতরাং, ভাঙন-বিভক্তি একটা কারণ। দ্বিতীয়ত, যখন একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখনই আমাদের বামপন্থিদের কেউ কেউ শর্টকাট ক্ষমতায় অংশীদার হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। যেমন, এখনও মহাজোটের সাথে থাকা বামপন্থি বলে দাবি করা দলগুলো কিন্তু যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় আসতে চাইছে। এদের এই যে প্রতারণা-বেঈমানি-বিশ্বাসঘাতকতা এটা মানুষের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। ফলে নীতির প্রশ্নে অটল বলে বামদের প্রতি যে আস্থা ছিল জনমানুষের, এই দলগুলোর ডিগবাজি মানুষের মনে এব্যাপারে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এছাড়া রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সময়েও আমাদের কিছু ভুল রয়েছে। জনবিচ্ছিন্ন তৎপরতা, হঠকারিতা কিংবা বলতে পারি সুবিধাবাদী আপসকামিতা, যেটা এখন ইনু-মেননরা করছেন, এগুলোও মানুষের মনে বিশাল এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।
ইসলাম প্রশ্নে বাম দলগুলোর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব লক্ষণীয়। এই বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
হক : প্রথমত, ধনিক শ্রেণীর রাজনৈতিক দল-সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদী-মৌলবাদীদের ধারাবাহিক অপ্রপচার এর জন্য দায়ী। ‘এরা নাস্তিক, আল্লাহ-খোদা মানে না’ -এসব বলে অপপ্রচার করা হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতি জড়াজড়ি করে আছে -এখানে ধর্মের পুরো বিষয়টাকে আমরা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারিনি। যেমন, ধর্ম মানবপ্রেম-মানবমুক্তি-দেশপ্রেমের কথা বলে, এসব তো আমাদের আন্দোলনের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে। অথচ এসব না বলে ধর্মকে যেভাবে পশ্চাৎপদ-প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার জায়গা থেকে আখ্যায়িত করা হয়েছে, এতে করে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে অনেক সময় জেনে বা না জেনে আঘাত দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি, ধর্মের ব্যাপারটাকে শুরু থেকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়নি। ধার্মিক মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, তাদের বক্তব্যের মাঝে আমরা আমাদের কর্মসূচিকে নিয়ে যেতে পারিনি। আমরা, বিশেষ করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এসবের কারণে তেমন সমস্যায় পড়িনি। আমি মনে করি, ধর্মের যে মানবমুক্তির কথা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা, তার সাথে সমাজতন্ত্রের মূলগত কোনও বিভেদ নাই। তবে বিরোধটা হচ্ছে, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে। ধর্মকে দিয়ে যে সাম্প্রদায়িকতা তৈরির চেষ্টা করা হয়ে থাকে, মানুষের মাঝে উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়, মানুষের মাঝে সহিংসতা উসকে দেয়ার চেষ্টা, আমরা সেটার বিরোধী। সুতরাং, ইসলাম বা যেকোনো ধর্ম আমাদের প্রতিপক্ষ নয়।
আপনি কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন?
হক : দেশটা হবে গণতান্ত্রিক, ১৯৭০ সালে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমাদের জনগণ যে ম্যান্ডেট দিয়েছিল, সেটার প্রতি পাকিস্তানিরা সম্মান করেনি বলেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চাই, আমি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চাই। যে বাংলাদেশ ধর্মের ভিন্নতার কারণে কোনও বৈষম্য করবে না। সবশেষে একটা শোষণ-বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্র দেখতে চাই। যেখানে নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব কিংবা জাতিগত সংখ্যালঘুদের মাঝে কোনও বৈষম্য করা হবে না।
দীর্ঘ সময় রাজনীতি করে পরিবার ও ব্যক্তিজীবনে নিশ্চয় অনেক অপূর্ণতা রয়েছে; আপনার কি কোনও আক্ষেপ আছে?
হক : আমার ব্যক্তিজীবন নিয়ে তেমন কোনও আক্ষেপ নেই। তবে আমার আক্ষেপ আছে একটা (একটু হেসে), আমি ক্লাসিক খুব পছন্দ করি। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর ধরে আমি ক্লাসিক পড়ার সুযোগ কম পাচ্ছি। আমি লিখতে পছন্দ করি, কিন্তু আমি লেখবার সময়ও খুব একটা পাচ্ছি না। এগুলো একদমই ব্যক্তিগত। রাজনীতির ক্ষেত্রে যদি বলি, তবে বলবো আমিও কিছু ভুলের সাথে জড়িত। একটা বড় সময় আমার অপচয় হয়েছে। অনেক সময় আমি প্রতারিত হয়েছি, আর এসব নিয়েই আমার মাঝে কিছুটা আত্মধিক্কার আছে, আক্ষেপ আছে।
আগামী প্রজন্মের জন্য চিন্তা কী?
হক : প্রজন্মের মধ্যে আমি দেশপ্রেমটা জাগিয়ে তুলতে চাই। বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি -এদের বেশিরভাগ শেকড় যতটা না দেশে, তারচেয়ে বেশি বাইরে। এদের পরিবার-পরিজন-ধন-সম্পদ অধিকাংশই দেশের বাইরে। এই বাংলাদেশ জলোচ্ছ্বাসে-ঝড়ে-বন্যায় ডুবলে-মরলে এদের কিচ্ছু যায় আসে না। ফলে আমি চাইবো, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ ব্যাপারে সচেতন হবে, দেশপ্রেমিক হবে। এক্ষেত্রে আমার তরুণদের ওপর অগাধ আস্থা আছে।
আপনাকে অনেক অসংখ্য ধন্যবাদ এবং জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
হক : আপনাকেও ধন্যবাদ, আপনার মাধ্যমে পাঠকদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।