জিততে জিততে হেরে গেল বাংলাদেশ

জিততে জিততে হেরে গেল বাংলাদেশ

২১ বছর ২১১ দিন; ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সর্বকনিষ্ঠ উইন্ডিয়ান হিসাবে সেঞ্চুরি করেছেন হেটমায়ার
৮৪ বল; বাংলাদেশের বিপক্ষে উইন্ডিজের হয়ে দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি করেছেন হেটমায়ার। দ্রুততমটি ব্রায়ান লারার
৪.৪ ওভারে ৫০; ওয়ানডে তে বাংলাদেশের দ্রুততম
৭৯; দেশের বাইরে প্রথম পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ
১৪.৫ ওভারে ১০০; ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্রুততম
হোল্ডারের করা শেষ ওভার মাত্র ৪ রান তুলে ৩ রানে হারল বাংলাদেশ
সিরিজে ১-১ সমতা
ম্যাচসেরা : শিমরন হেটমায়ার

বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং চেঞ্জ; সুফল গোটা ইনিংসেই

বোর্ডে ২৭১ দেখার পর যদি বোলিং চেঞ্জকে বুদ্ধিদীপ্ত বলা হয় তাহলে বিভ্রম জাগা স্বাভাবিক। কিন্তু পুরো ইনিংসটি যদি দেখে থাকেন তাহলে সংশয়ের অবকাশ নেই। টস জিতে মাশরাফির বোলিংয়ের সিদ্ধান্তে শঙ্কার মেঘ দেখেছিলেন ভাষ্যকাররা। তাদের ভুল প্রমাণ করে প্রথম আঘাত হানেন মাশরাফি নিজেই। তার বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত যে পরিকল্পনা করেই নেয়া সেটি স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে গেইলের আউটটাতে। মেহেদীকে সরিয়ে নেয়ার এক ওভার পরেই আবারো অ্যাটাকে এনেই সাফল্য। হুমকি হবার আগেই শেষ গেইলের ইনিংস। ৪০ ওভারের পরে আবারো ম্যাশ ঝলক। ক্রিজে ওয়েল সেট হেটমায়ার আর পাওয়েল যখন বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল উইন্ডিজকে তখনই রুবেলকে নিয়ে আসেন মাশরাফি। পাওয়েলকে ফিরিয়ে দিয়ে অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দারুণ ভাবেই দিয়েছেন রুবেল। একই ওভারে ফিরে যেতে পারতেন হেটমায়ারও যদি না সাকিব তার সহজ ক্যাচটি ফেলতেন। স্লগ হিটিংয়ে অভ্যস্ত হোল্ডারকে টোপ দিয়েছেন সাকিবের স্পিনে। ফলাফল? ছয় মারার ঠিক পরের বলেই স্ট্যাম্পড। ২৭১ হতই না যদি রুবেল ৪৮তম ওভারে ২২ রান না দিতেন। পুরো ইনিংসে এটিই শুধু বাংলাদেশের জন্য হতাশার।

গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে গন্ডগোল

ফিল্ডিংয়ে হাত ফসকানো বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু না। গায়ানায় দ্বিতীয় ওয়ান ডেতে আবারো দেখা গেল অপ্রিয় সে দৃশ্য। ৩০ গজের মধ্যেই বল রেখে অসংখ্য সিঙ্গেল নিয়েছেন উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানরা। এক কে বহুবার পরিণত করেছেন দুইয়ে। বোলারদের আটোসাটো বোলিংয়ের বিপরীতে ফিল্ডারদের পিচ্ছল হাতই সহায়তা করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বড় সংগ্রহ গড়তে। ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করেছেন আস্থার অপর নাম সাকিব আল হাসান। হেটমায়ারের সহজ ক্যাচটি ফেলে তাকে উপহার দিয়েছেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি।

হ্যাটস অফ হেটমায়ার

বয়স মাত্রই ২১। অভিজ্ঞতাও মাত্রই ১০টি ওয়ান ডে’র। কিন্তু প্রভিডেন্সে যেভাবে ব্যাট চালালেন তাতে এটি বিশ্বাস করাই কঠিন। গায়ানার ঘরের ছেলে হওয়ায় মাঠটি তার পরিচিত। আগের ম্যাচেই তুলে নিয়েছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। সেটি যে ডেমো ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে এ ইনিংসটিতে। ধৈর্য্য, স্কিল কি ছিল না? ক্রিজে কাটানোর প্রায় অর্ধেকটা সময় কেটেছে ইনিংস মেরামতেই। পাওয়েলকে নিয়ে ভীত গড়ে যখন সেঞ্চুরির প্রায় কাছাকাছি তখনো নামের পাশে মাত্র ৩টি চার এবং ৪টি ছয়। অর্ধেকেরও বেশি রান নিয়েছেন দৌড়ে। ক্লান্তির কাছে যে তিনি হার মানেননি সেটি দেখিয়েছেন ইনিংসের শেষ দিকে। রুবেলকে নাইটমেয়ার উপহার দিয়ে যে দুটি ছয় মেরেছেন তা চোখে লেগে থাকার মত। ইনিংসে কলঙ্ক বলতে শুধু রুবেলের বলে একবার সুযোগ দেয়া। কলঙ্ক নিয়ে চাঁদ যদি যুগের পর যুগ রুপসীদের রুপের তুলনায় ব্যবহৃত হতে পারে তবে এ ইনিংসটি দেখার পর কে যাবে খুঁত খুঁজতে? বাংলাদেশের তরুণ ব্যাটসম্যানরা এ ইনিংসটি থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। বাউন্ডারি ছাড়াও যে বোলারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় তার অনবদ্য একটি উদাহারণ ইনিংসটি।

স্বপ্নের মত শুরু

২৭২-এর এর মত টার্গেট তাড়া করার জন্য ভাল শুরু আবশ্যক। কিন্তু গায়ানায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যেটি করেছেন সেটি ছাড়িয়ে গিয়েছে ভালোর সংজ্ঞাকেও। হোল্ডারের ওপর এনামুলের চওড়া হওয়া দিয়ে শুরু। পরের ওভারেই ৯ বলে ২৩ রানের টর্নেডো খেলে তিনি ফিরে গেলেও তামিম-সাকিব শান্তি দেননি ক্যারিবিয়ানদের। গায়ানায় সুনামি তুলে দু’ জন দলীয় অর্ধশতক তুলে নিয়েছেন মাত্র ৪.৪ ওভারেই। এ ফরম্যাটে যেটি বাংলাদেশের দ্রুততম। সে ধারাবাহিকতায় সেঞ্চুরিও আসে মাত্র ১৪.৫ ওভারে। যেটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্রুততম। প্রথম পাওয়ার প্লেতে আসে ৭৯ রান। যেটি দেশের বাইরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। এমন শুরু বোধয় স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ।

নার্সের সেবা আর বিশুর বিষে কক্ষে উইন্ডিজ

পেসারদের বেধড়ক পিটিয়ে অাস্কিং রেটটাকে শুধু কমিয়েই আনেননি সাকিব-তামিম; বরং এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যেখান থেকে জয়টাকে মনে হচ্ছিল কেবলই সময়ের ব্যাপার। সে সময়ই হোল্ডার নার্সকে বেছে নেন সেবার জন্য। এবং নার্স সেটি দিয়েছেনও। পাগলা ঘোড়ার মত ছুটতে থাকা রানের গতিতে লাগাম পরানোর কাজটি তিনিই প্রথম করেছেন। তাতে প্রথম থেকেই স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে খেলতে থাকা সাকিব-তামিম হাসফাস করতে শুরু করলেন। নার্স থেকে প্রাথমিক শুশ্রশা নেয়ার পর হোল্ডার বিশুকে বাছাই করলেন পাল্টা আঘাতের জন্য। হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেয়া তামিমকে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে সে কাজটি বেশ ভাল মতই করেছেন বিশু। কোটা শেষ করার আগে নার্স তুলে নিয়েছেন সাকিবের উইকেটটি। দুজনের ঘুর্ণির সাথে গেইলও যোগ দেয়ায় হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া ম্যাচে দারুণ ভাবেই ফিরে আসে উইন্ডিজ। সাকিব-তামিম দুজনই ফিরেছেন পঞ্চাশের ঘরে। তামিম করেছেন ৫৪ এবং সাকিবের সংগ্রহ ৫৬ রান।

অবশেষে রিভিউতে সাফল্য

বাংলাদেশের রিভিউ অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর না। অতীতে অধিকাংশ সময়ই রিভিউ নিয়েও হাসি ফোটেনি বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ঠোঁটে। গায়ানায় আজকে একটি নতুন দৃশ্যই দেখা গেল। প্রথমে সাকিব এবং তারপর মাহমুদুল্লাহর বিপক্ষে উইন্ডিজের আবেদনে আঙুল তুলে দিয়েছিলেন আম্পায়ার। দুবারই বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ জানায় আম্পায়ারের কলকে। দুবারই সাফল্য দেখে বাংলাদেশ! আশ্চর্যবোধক ব্যবহারের কারণটি শুরুতেই বয়ান করা হয়েছে। সাকিব রিভিউ ভাগ্যের সহায়তা নিয়ে খুব বেশিক্ষণ টিকতে না পারলেও মাহমুদুল্লাহ কাজে লাগিয়েছিলেন সুযোগটিকে। প্রথম দু’ দফায় নন স্ট্রাইক এন্ডে থাকা মুশফিক সঠিক পরামর্শ দেয়ার পর নিজেও চমৎকার ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন রিভিউকে। মাহমুদুল্লাহর সাথে জুটি বেঁধে দলকে যখন একটু একটু করে জয়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই বিশুর আরো একটি আবেদনে অাঙুল তুলে দিয়েছিলেন আম্পায়ার। সামান্য দ্বিধা না করে রিভিউ নেন মুশফিক, রক্ষা পায় বাংলাদেশ।

অারো একবার আক্ষেপের গল্পে মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ

বাংলাদেশের অনেক স্বরণীয় জয়ের নায়ক এ দু’জন। বাংলাদেশের সবচেয়ে কষ্টের গল্পটিতেও রয়েছে দু’জনের নাম। গায়ানাতে ভারতের বিপক্ষের সে ম্যাচটির ওয়ান ডে ভার্সনের গল্পই যেন লিখলেন দুজন। দ্রুত সময়ের মধ্যেই তামিম-সাকিবকে হারানোর পর যখন বাংলাদেশকে চেপে ধরেছিল উন্ডিজ তখন স্নায়ুর চরম পরীক্ষা দিয়ে উইন্ডিজকে হতাশ করে জয় রাস্তাটাকে সহজ করে তুলেছিলেন দু’জন। প্রথম দিকে উইকেটে টিকে থাকা নিয়ে যুদ্ধ করতে হলেও সময়ের সাথে সাথে চওড়া হয়েছেন দু’জন। মুশফিকের ফ্লিক করে এবং মাহমুদুল্লাহর কাভার ড্রাইভে মারা দুটো ছয় ছিল চোখে লেগে থাকার মত। রান আউট হয়ে ম্যাচটা শেষ না করতে পারার হতাশা নিয়ে মাহমুদুল্লাহ ফিরে যাবার পর অাক্ষেপ নিয়ে ফিরেছেন মুশফিকও। হোল্ডারকে হিট করার জন্য বেছে নিয়ে ম্যাচটিকে মুঠোয় পুরে নেন বাংলাদেশ এর সাবেক এই অধিনায়ক। হোল্ডারের করা ৪৭তম ওভারে অসাধারণ দুটি চারসহ ১৩ রান নিয়ে জয়ের পথটিকে সহজ করে তোলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত হোল্ডারের বলেই আউট হয়ে ফিরে গিয়ে ভারতের বিপক্ষে টি টোয়েন্টির স্মৃতিটাই নতুন করে মনে করিয়ে দেন মুশফিক। আর তার আউটির পরেই অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচটি জিতে নেয় উইন্ডিজ।

খলনায়ক থেকে নায়ক হোল্ডার

শুরু থেকে নিজের শেষ ওভারের আগ পর্যন্ত যে বোলিংটি হোল্ডার করেছেন তাতে সিরিজ হারের মুল খলনায়ক হতে পারতেন তিনিই। এমন শঙ্কার সামনে দাড়িয়েও শেষ ওভার করার সাহসটিই বদলে দিল সব কিছু। প্রথম বলেই মুশফিককে তুলে নেয়ার পরের পাঁচ বলে দিলেন মাত্র চার রান। অবিশ্বাস্য এক জয় ছিনিয়ে নিয়ে নায়ক বনে গেলেন হোল্ডার। পুরো ম্যাচ খারাপ করার পরেও ক্রিজে সেট একজন ব্যাটসম্যানকে শেষ ওভার করতে আসার সাহস দেখানোর পুরষ্কারই এটি। হোল্ডারের হাঁসিতে হতাশায় পুড়ল বাংলাদেশ।