পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে দীর্ঘদিনের পরিবারতন্ত্র ও পাঞ্জাবি আমলাতন্ত্রের প্রভাবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইমরানের অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর বিজয়ে হতবাক বিশ্ব। অনেক ধরণের বিশ্লেষণ ও সমালোচনাকে ভুল প্রমাণ করে ইমরান খানই এখণ পাক প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। নতুন দল ও আগের রাজনৈতিক কোন অভিজ্ঞতা না থাকার পরেও ইমরান খানের এই সফলতার কারণগুলো কি তা নিয়ে চলছে নানামূখি বিশ্লেষণ। এই লেখাতে রয়েছে সেই কারণগুলোর সহজ উল্লেখ।
১.
ইমরান খান ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতিপরায়ন না, দুর্নীতি তাকে ছুঁতে পারেনা এটা সাধারণ পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করেছেন। এমনকি ইমরান খানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও ইমরানকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে মনে করতে পারেনি! ইমরানকে বিশ্বাস করার কারণটা হলো: তাঁর প্রথম স্ত্রীর সাথে যখন লন্ডনের আদালতে ডিভোর্স হচ্ছিলো তখন জেমিমা গোল্ড স্মিথের ব্যক্তিগত ১৬০ কোটি পাউন্ডের অর্ধেক সম্পদ ৮০ কোটি পাউন্ড বৃটিশ আইনে ইমরানের প্রাপ্য ছিলো কিন্তু ইমরান তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, “যার সাথে আর এক ছাদের নিচে থাকা হবেনা তাঁর সম্পদ দিয়ে কি করবো? ”
এই ঘটনা মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। এবং জনমনে সম্পদের প্রতি ইমরানের বাড়তি লোভ নাই -এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে সর্বশেষ ক্ষমতাসীন নওয়াজ শরীফের রাজনৈতিক দল এবং তিনি নিজে দুর্নীতির দায়ে প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন এবং এখন জেলে আছেন। অনেক পাক নেতার নাম পানামা পেপারসে আসলেও ইমরান খানের নাম নাই। এই অবস্থায় সততার ইমেজ জনমনে ইমরান খানকে জনপ্রিয় করে তুলেছে অতিদ্রুত।
২.
ইমরানের আরেকটি গুণ হচ্ছে বড় স্বপ্ন দেখানো এবং তা বাস্তবায়ন না হওয়া অব্দি দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করা। উদাহরণ হিসেবে সাতাশি সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের পরে অবসর নিয়ে ফিরে এসে মায়ের জন্য ক্যান্সার হসপিটাল করার স্বপ্ন নিয়ে ৯২’ এর বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। এরপরের ইতিহাসতো পাঠকের ভালই জানা আছে কিভাবে তিনি খাদের কিনারা থেকে পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে টেনে তুললেন। এই সফলতার ইতিহাস প্রতিটি পাক নাগরিক মানেন। এই ইমেজও ইমরানের রাজনৈতিক বিজয়ে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তার পরেও বলতে হবে, শুধুমাত্র উপরোক্ত দুটি কারণেই কিন্তু ইমরানকে পাকিস্তানের মানুষ নির্বাচিত করেননি। আরও বহু কারণ আছে।
৩.
আমরা জানি, পাকিস্তান তথা তৃতীয় বিশ্বের সবচে বড় সমস্যা হলো বাজে গভার্নেন্স। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ইমরানের পিটিআই যুদ্ধ বিধ্বস্ত খাইবার পাখতুনখাওয়ায় সরকার গঠন করে। ওয়ার অন টেররের খপ্পরে পড়ে তালেবানের সাথে দীর্ঘ এক দশকের শাসনে তখন উত্তর পাকিস্তানের এ অঞ্চল বিধ্বস্ত। প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা নিয়ে ইমরান প্রথমেই ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থাকে টেনে তুললেন। শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি নির্মাণসহ পুরো ব্যাবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনলেন। পাঁচ বছরে ৫৭ হাজার নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে সবচে বেশি বরাদ্দ করলেন এর ফলশ্রুতিতে প্রাইভেট স্কুল থেকে সরকারি স্কুলে পাঁচ বছরে প্রায় দেড় লক্ষ শিক্ষার্থী স্থানান্তরিত হলেন। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেন। প্রায় ১ কোটি প্রাদেশিক নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যবীমা নিশ্চিত করলেন যার ফলে নাগরিকরা সর্বোচ্চ ৫ লাখ রূপি পর্যন্ত তাদের স্বাস্থ্য ব্যয় বিনাখরচে করতে পারবেন সরকারি -বেসরকারি যেকোন হাসপাতালে।
৪.
প্রশাসনকে ঢেলে সাজালেন, যার ফলে অপরাধ অনেকটা কমে আসে। খাইবার প্রদেশের ক্রাইমরেট পাকিস্তানের সব প্রদেশ থেকে অনেক কমে নামিয়ে আনেন এই সময়ে। এছাড়াও নাগরিকদের দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ বাড়িয়ে দেন। পর্যটন খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে অর্থনৈতিকভাবে প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। ইমরানের দলের পাঁচ বছরের গুড গভর্নেন্সে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন পাকিস্তানের চার কোটি ষাট লাখ তরুণ ভোটার।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ইমরানের সততা ও মধ্যপন্থী দর্শনে তাকে পীর মাশায়েখ ও সূফী তরিকার ভক্তদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে। ক্রিকেট জীবনে নাস্তিক ও প্লেবয় ইমেজের ইমরান গত তিন দশকে ইসলামিক সূফী তরিকায় আকৃষ্ট হন, তিনি নিজেকে সূফী তরিকায় জড়িয়ে রাখেন। তারপর ‘ওয়ার অন টেররের’ কারণে ওয়াহাবীজমের প্রতি পাকিস্তানের সাধারণ সুন্নিরা বিরক্ত ছিলেন। ইসলামের মধ্যপন্থী সূফী ধারার বিশ্বাসী মানুষের আধিক্য পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি অথচ আমরা অনেকেই প্রগতিশীল মিডিয়ার কল্যাণে পাকিস্তান ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের অভয়ারণ্য বলে মনে করি।
৫.
ইমরানের বিজয়ী হওয়ার পিছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের চরম বিরোধী অবস্থান। পাকিস্তানের শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত সব শ্রেণীর জনগণ আমেরিকাকে নিজেদের শত্রু মনে করে। পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় থাকার সময় সোয়াতে মার্কিন ড্রোন হামলার প্রতিবাদে যে লংমার্চ সোয়াত পর্যন্ত গিয়ে দোরান্দ সীমান্তে ন্যাটোর সামরিক বাহিনীর খাদ্যশস্য আটকে দেয় সে কর্মসূচি থেকে ইমরানের জনপ্রিয়তার সূচক বাড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে খাইবার পাখতুনখাওয়ায় ২০১৩ তে ক্ষমতায় আসে আর এইবার টু -থার্ড মেজরিটি অর্জন করে গুড গভর্নেন্সের বদৌলতে।
৬.
আরেকটি কারণ হচ্ছে পাঞ্জাবে শরীফ পরিবারের দীর্ঘ ২৪ বছরের শাসনে বঞ্চিত ও বিরক্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। গত এক দশকের টানা শাসনে পাঞ্জাবের উন্নয়ন বরাদ্দের অর্ধেকেরও বেশি লাহোরে পাচার হয়েছে। যার কারণে সরাইকি ভাষার দক্ষিণ পাঞ্জাব অঞ্চলের বাসিন্দারা সীমাহীন বঞ্চনার শিকার হন। সেন্ট্রাল পাঞ্জাবের শহরাঞ্চলে বিশেষ করে ফয়সালাবাদ, শিয়ালকোট, রাওয়ালপিন্ডি ও লাহোরে বিরাট আরবান মিডল ও লোয়ার মিডল ক্লাস শ্রেণির উথান ঘটে। খাইবার পাখতুনখাওয়ার গুড গভার্নেন্স এসব শিক্ষিত শ্রেণিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। শিক্ষিত তরুণ গোষ্ঠীর আগ্রহ ও উচ্ছ্বাসের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় শরীফ পরিবারের মাফিয়াতন্ত্র।
দক্ষিণ পাঞ্জাবকে আলাদা প্রদেশ বানানোর ঘোষণা নির্বাচনী ইশতেহারে দিয়ে এ অঞ্চলের জনগণকে একই সুতায় আবদ্ধ করেন যার ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ পাঞ্জাবে ক্লিন সুইপ করে পিটিআই।
৭.
ইমরানের বিজয়ের পিছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে কাশ্মির ও আফগাননীতি। ইমরান মনে করেন কাশ্মিরিদের সঠিক মৌলিক অধিকার ভারত জবর দখল করে আছে। ইমরান খান জাতিসংঘের নেহেরুর দেয়া প্রতিশ্রুত কাশ্মিরিদের গণভোট ফিরিয়ে দেয়ার ঘোর সমর্থক এবং আমেরিকার আফগানিস্তানে প্রবেশকে সেদেশের সার্বভৌমত্বের চরম লংঘন হিসেবে বিবেচনা করেন। এই ঘটনায় এবং বিভিন্ন সময়ে শরিফ আমলের ভারতপন্থী নীতি ও ভারতের কঠোর সমালোচনা ইমরান খানকে বিভিন্ন ইসলামী গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর কাছেও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। পাকিস্তানের সেনা স্টাব্লিশমেন্ট ইমরানের সাথে থাকায় এই জয় সাধারণ মানুষের ধারণাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। সবাই সেনা বাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা করলেও ইমরান পাক-সার্বভৌমত্বের জন্য সেনাদের গৌরব নিয়ে ইতিবাচক কথাই বলতেন। ফলে সেনাবাহিনী সহজেই ইমরানে ভরসা রেখেছেন। আর কে না জানে, পাকিস্তানের ক্ষমতার হিসেবে সব সময়ই সেনা বাহিনী অন্যতম গুরুত্বর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এছাড়া, সিন্ধু প্রদেশের জমিদারি সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ইমরান। তিনি মনে করেন মোঘলদের এই নীতি আমজনতাকে শাসকদের দাসে পরিণত করে। সিন্ধুপ্রদেশে এখনও শক্ত অবস্থান নিতে না পারলেও সিন্ধুর রাজধানী করাচিতে এবার ভালো ফল করেছে ইমরানের পিটিআই। বিপুলসংখ্যক উর্দুভাষী মুহাজিরের (৪৭ এ ভারত থেকে আগত) দুর্গে ভালোই হানা দিয়েছে পিটিআই।
পরিশেষে বল যায়, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে ইমরানের এ বিজয় পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার রাজনীতির অনেক হিসেব পাল্টে দিবে। বিশেষ করে চীনের সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানের বাণিজ্য ও অন্যান্য উন্নয়ণ তৎপরতা যদি ইমরান চালিয়ে যেতে থাকেন তা হলে দক্ষিণ এশিয়াতে ভারতের অবাধ প্রভাব বিস্তারের রাস্তাকে পাকিস্তান যেমন দিন দিন আরও কঠিন করে তুলবে, অন্যদিকে আমেরিকার জন্যও দক্ষিণ এশিয়া আর আগের মতো সহজ থাকবে না। এই সবের হিসেব মতে কিছু প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পড়বে। পড়াটাই স্বাভাবিক।