উগ্র জাতীয়তাবাদের সর্বশেষ শিকার ওজিল

উগ্র জাতীয়তাবাদের সর্বশেষ শিকার ওজিল

বর্ণবাদ নামক বিষটির সাথে নিয়তই জুঝতে হয় আমাদের। এর বিস্তার ব্যক্তি জীবন থেকে খেলার ময়দান পর্যন্ত বিস্তৃত। রাশিয়ায় বর্ণবাদমুক্ত একটি বিশ্বকাপ শেষে যখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে ফিফা তখনই আবার সামনে এলো এই ইস্যু। এবার সামনে নিয়ে এলেন সদ্য সাবেক হওয়া ‘১৪র বিশ্বকাপ জয়ী জার্মান তারকা মেসুত ওজিল।

সাদা চোখেই এটা স্পষ্ট ছিল যে ‘১৪র জার্মান দলটি আর ‘১৮র জার্মান দলটিতে আকাশ-পাতাল ফারাক। রক্ষণ থেকে আক্রমণ সবখানে দুর্বলতা ছিল স্পষ্ট। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে জার্মান মিডিয়ার অধিকাংশ তোপই ছিল ওজিলকে লক্ষ্য করে। এটা সত্য যে, ওজিল তার স্বাভাবিক খেলাটাও খেলতে পারেননি বিশ্বকাপে। কিন্তু যেখানে পুরো দলই ব্যর্থ তখন শুধুই একজনের ওপর ক্রমাগত দায় চাপানোর পেছনে খেলার বাইরের ভিন্ন কারণ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সেটিকেই একদম স্পষ্ট করে সামনে নিয়ে এসেছেন ওজিল।

গন্ডগোলের সূচনা বিশ্বকাপের আগে তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান এরদোগানের সাথে ওজিলের হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবিকে ঘিরে। এটা ফুটবলাঙ্গনের সকলেই জ্ঞাত যে জার্মান জাতীয় দলের এই তারকার শেকড় তুরস্কে। নিজ মাতৃভূমির প্রতি টান থাকা এবং তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে ছবি তোলা তাই মারাত্মক কোনো পাপ হবার কথা না। এটি স্বাভাবিক ভাবনা হলেও ওজিলের বেলায় বদলে যাবার কারণ তুরস্কের সাথে জার্মানির শীতল সম্পর্ক এবং ওজিলের মুসলিম পরিচয়। এমনটাই বলেছেন ওজিল। এটি বিশ্বাসের মতো যৌক্তিক কারণও রয়েছে।

জার্মান দলে ওজিলই একমাত্র অভিবাসী খেলোয়ার নন। ‘১৪র বিশ্বকাপ জয়ী দলের ক্লোসা এবং পোডোলস্কিও অভিবাসী পরিবারের সন্তান। তাদেরও নাড়ি পোতা ভিন্ন দেশে। কিন্তু ক্লোসা বা পোডোলস্কি কেউই এমন প্রতিকুল পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। বর্তমান দলটিতেও রয়েছে একাধিক অভিবাসী খেলোয়াড়। তাদেরও এমন অভিজ্ঞতা এখন পর্যন্ত অন্তত হয়নি যেমনি ওজিলের ক্ষেত্রে হয়েছে।

মজার বিষয় হচ্ছে এই জার্মানির হয়ে খেলার জন্য তুরস্কের ডাক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ওজিল। জার্মানির বর্ষসেরা খেলোয়াড়ও হয়েছেন পাঁচবার। তাতেও যে তার পূর্ব পুরুষের পরিচয়টা মুছে যায়নি সেটি বেশ স্পষ্টই বোঝা যায় জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের সভাপতির বয়ানে। যিনি ওজিলের অবসরে বেশ আনন্দিত। জেনে রাখা ভাল যে ওজিলের অবসরে আনন্দিত দুর্নীতির দায়ে জেল খাটা এই আদমি যে টাইম লাইন দিয়েছেন ওজিলের সর্বশেষ ভাল খেলার তার পরেও ওজিল দুবার বর্ষসেরা হয়েছেন। তাহলে একটা প্রশ্ন তো এসেই যায় যে, ওজিল যদি এতটাই খারাপ হন যে, জাতীয় দলে তাকে দেখা দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়, তাহলে বাকি যারা এই ওজিলকে টপকাতে পারেননি সেরা হবার দৌড়ে তারা কতটা খারাপ?

শুধু ওজিলই নন, পারফরম্যান্সের গ্রাফ নিন্মমুখী হলেই জাতিগত এই বর্ণবাদের শিকার হবার হবার কথা জানিয়েছেন করিম বেনজেমা, রোমেলো লুকাকুর মত তারকারা। শুধু জার্মান দলেই যে অভিবাসী খেলোয়াড়রা খেলেন তাও না, বর্তমান বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স দলটির অধিকাংশ তারকাই অভিবাসী। আগেও ছিল, তবু থামানো যাচ্ছে না বর্ণবাদের বিষ।

স্বস্তির বিষয় হচ্ছে জার্মান চ্যান্সেলরের কার্যালয় বায়ার্ন সভাপতির সাথে কন্ঠ মেলানোর বদলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একটা ব্যাপার এখানে চলেই আসে, সেটি হচ্ছে, ইউরোপের সবচাইতে বেশি সিরীয় শরণার্থীকে তারাই জায়গা দিয়েছে, এবং সে সংখ্যা প্রায় দশ লাখ। অন্যদিকে অনেক তারকা খেলোয়াড়ও পাশে দাঁড়িয়েছেন ওজিলের। বিশ্বকাপের ব্যর্থতায় অবসরের সিদ্ধান্ত অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ী একজন তারকা যখন নিজ দেশেই নিজেকে অচ্ছুৎ মনে করেন সেটি ভয়াবহ। বিশ্বজুড়ে জাতিগত উগ্রপন্থা কতটা ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে সেটির একটি ভয়াবহ চিত্রই যেন ওজিলের এই অবসরের ঘোষণাটি।

জাতীয়তাবাদের চরম উগ্রধারা এখন পত্রপত্রিকার নিয়মিত খবর। কোথাও ধর্ম নিয়ে তো কোথাও জাত নিয়ে। এর বিরুদ্ধে যারা ভূমিকা রাখেন সেই খেলোয়াড়দেরই বর্ণবাদের শিকার হতে দেখাটাই বুঝিয়ে দেয় এর শেকড় কতটা বিস্তার লাভ করেছে। এটি রোধ করা কোনো সংস্থার পক্ষ্যে এককভাবে সম্ভব না। ঘুণে ধরা মনগুলো থেকে ঘুণ পোকা তাড়াতে না পাড়লে এর মুক্তি নেই। অপেক্ষা সেই সুদিনের যেদিন বর্ণবাদ শব্দটার ঠাঁই হবে জাদুঘরে। ওজিলকে দিয়েই নাহয় সে লড়াইটা শুরু হোক।