তামিম-সাকিবের পর মাশরাফি; ৪৮ রানে প্রথম ওয়ান ডে জিতল টাইগাররা

তামিম-সাকিবের পর মাশরাফি; ৪৮ রানে প্রথম ওয়ান ডে জিতল টাইগাররা

২৭৯; ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর
২০৭; যেকোনো উইকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানের জুটি
প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে ওয়ানডে সেঞ্চুরির সংখ্যা দুই অংকের ঘরে নিয়ে গেলেন তামিম
১৪৬; তামিমের সেঞ্চুরিটি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে ধীর গতির
স্কোর : বাংলাদেশ ২৭৯/৪, ৫০ (তামিম ১৩০*, সাকিব ৯৭); ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৩১/৯, ৫০ (মাশরাফি ৩৭/৪, মোস্তাফিজ ৩৫/২)
বাংলাদেশ ৪৮ রানে জয়ী, ৩ ম্যাচ সিরিজে টাইগাররা এগিয়ে ১-০ তে
 ম্যাচসেরা : তামিম ইকবাল

টেস্টে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর ওয়ান ডেগুলোতে বাংলাদেশ কি করতে পারে সেদিকেই আগ্রহ ছিল সবার। এক রানের মাথায়ই প্রথম উইকেট পতনের পর মনে হচ্ছিল টেস্টের পুনরাবৃত্তিই যেন ঘটতে চলেছে ওয়ান ডে তেও। কিন্তু ব্যাট হাতে তামিম-সাকিবের দুটো ইনিংস এবং শেষ দিকে মুশফিকের ক্যামিওর ওপর ভর করে বাংলাদেশ তোলে ২৭৯ রান। পুরো সফরে প্রথমবারের মত ব্যাটসম্যানদের সাফল্যে ম্লান হতে না দিয়ে বোলাররাও তাদের শতভাগ দিয়ে পালন করেছেন অর্পিত দায়িত্ব। তাই শুরুর পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণ করে ওয়ান ডে সিরিজের প্রথম ম্যাচ ৪৮ রানে জিতেছে টাইগাররা।

শুরুতেই লজ্জার শঙ্কা

টেস্ট সিরিজের এসিড টেস্টে চূড়ান্ত রকম ব্যর্থ বাংলাদেশ ওয়ান ডেতে নতুন করে শুরু করবে এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। প্রত্যাশাকে আশঙ্কায় পরিণত করে নিজের শূন্য এবং দলীয় এক রানেই সাজঘরে ফেরেন এনামুল। মেঘলা আকাশ এবং পেসারদের সামনে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান অসহায় অাত্মসমর্পণের তরতাজা দৃশ্যটিই যেন ফিরে আসছিল গায়ানায়।

হাসলো সূর্য, হাসলো ব্যাট

বৃষ্টির কারণে যখন খেলা বন্ধ হয়ে যায় তখনও বাংলাদেশের দু ব্যাটসম্যানের অস্বস্তি বেশ ভালোমতই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু মেঘ সরিয়ে সূর্যের আগমনের মতই বাংলাদেশের ইংনিসের চেহারা বদলে দেন তামিম-সাকিব। ধীর লয়ে শুরু করা দু’ জন সময়ে সাথে সাথে বাড়িয়েছেন রান তোলার গতি। ছয় উইকেট হাতে থাকার পরেও বোর্ডে ২৭৯ রান থাকায় কেউ যদি সাকিব-তামিমকে কাঠগড়ায় তুলতে চান সেটি অন্যায়ই হবে। স্লো উইকেট এবং মন্থর আউট ফিল্ড যেমন ব্যাটিং দাবি করছিল ঠিক সেটিই করেছেন তারা। আর তাদের গড়ে দেয়া ভিত্তির ওপর দাড়িয়েই ক্যামিও খেলে উইন্ডিজকে একটি চ্যালেঞ্জিং টার্গেট ছুড়ে দিয়েছেন মুশফিক।

তামিম পারলেন, সাকিব পারলেন না

দুজনই তখন নব্বইয়ের ঘরে। তিন অংকের ম্যাজিক ফিগারটাকে আগে ছুঁতে পারেন আলোচনায় ছিল সেটিই। উইকেটে পুরো সেট হয়ে যাওয়ায় অন্য কোনো ভাবনাও কাজ করছিল না। কিন্তু দেবেন্দ্র বিশুকে সুইপ করতে গিয়েই আরো একবার সেঞ্চুরির কাছ থেকে ফিরে যান সাকিব। সাকিব না পারলেও তামিম পেরেছেন। রান তোলার তাড়া ছিল অবশ্যই, আর সেটি করতে গিয়েই টাইমিংয়ের হেরফের হয়ে গিয়েছে সাকিবের। পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি প্রংশসারই দাবি রাখেন। একই কথা প্রযোজ্য তামিমের বেলায়ও। সেঞ্চুরির জন্য যে কটি বল খেলতে হয়েছে সেটিই বলে দেয় ইনিংসটি তামিম সূলভ না। কিন্তু পরিস্থিতির দাবি মেনে নিজের স্বাভাবিক ব্যাটিং বদলে পুরো ইনিংসটি যেভাবে খেলেছেন এমনটাই তার কাছে প্রত্যাশা থাকে সবার।

গায়ানায় মুশি ঝড়

মুশফিক যখন ব্যাটিংয়ে নামেন তখন স্লগ করা বৈ ভিন্ন কোনো পথ ছিল না তার সামনে। দু’ প্রান্তে দুই পেসার, যার ফলে কতটা কি করতে পারেন সেটিই দেখার ছিল। আরো একবার মুশফিক দেখালেন নিজের মান। তিনি যে স্লগেও ঝড় তুলতে জানেন সেটিই উইন্ডিজ বোলারদের পিটিয়ে প্রমাণ করলেন মুশফিক। তার ক্যামিও বাংলাদেশকে শুধু আড়াইশই পার করায়নি, সাহায্য করেছে চ্যালেঞ্জিং একটি টার্গেট ছুড়ে দিতে।

অভাগা সাব্বির

এমনিতেই ভুগছেন রানখরায়, তার ওপর যদি আম্পায়ারও অমার্জনীয় ভুলের জন্য তাকেই বেছে নেন তাহলে কিই বা বলার থাকে? বিশুর বলে ফ্লাইট মিস করেছিলেন সাব্বির, তড়িৎ গতিতে বলটি স্ট্যাম্পে লাগিয়ে আবেদন করেন হোপ। তারপর যেটি হল ততটা বোধয় হোপও আশা করেননি। থার্ড আম্পায়ারের কাছে না পাঠিয়ে নিজেই সাব্বিরকে আউট দিয়ে দেন জোয়েল উইলসন। টিভি রিপ্লেতে পরিষ্কার দেখা যায় বেল যখন পড়ে যাচ্ছে তখনও সাব্বিরের পা ক্রিজের ভেতরেই!

মাশরাফি-মেহেদীতে দারুণ শুরু

গায়ানার স্লথ উইকেটে ব্যাটসম্যানরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছেন যথাযথভাবে। এরপর দায়িত্বটা ছিল বোলারদের ওপর। সে দায়িত্ব পালনের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যাক্তিটিই ছিলেন বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বে। মাশরাফির সাথে পাল্লা দিয়ে আটোসাটো বোলিং করে মেহেদীও চেপে ধরেছিলেন ফাঁসটা। আর তাতেই হাসফাস করে মাশরাফির বলে মাহুমুদাল্লাহর হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান লুইস। পাওয়ার প্লের পুরোটা সময় হাত খুলতে পারেননি গেইলও। ব্যাটসম্যানদের পর বোলাররাও নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করায় ঠোঁটের হাসিটা আরো বেড়েছে বাংলাদেশের।

আউট-নট আউট খেল! নট-আউট আউট!

হোপ করে হতাশ করার রুবেলের ঠিক আগের বলটা থেকেই শুরু এ রঙ্গের। গেইলকে করা মিরাজের বলে জোরালো আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার। মাশরাফি আগ্রহ থাকলেও মুশফিকের পরামর্শে রিভিউ নেননি মাশরাফি। পরে রিপ্লেতে দেখা যায় রিভিউটা নিলেই নিশ্চিত গ্যালারির পথ ধরতে হত গেইলকে। ঠিক পরের বলে হোপকে বিট খাওয়ানোর পর রুবেলের আবেদনে সাড়া দেন আম্পায়ার। এবার রিভিউ নিতে চেয়েছিলেন হোপ। কিন্তু গেইলের পরামর্শে রিভিউ না নিয়েই ফিরে যান তিনি। এবার রিপ্লে হতাশ করে হোপকে। বলটি পরিষ্কার বের হয়ে যাচ্ছিল স্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে! এরপর আর রিভিউ না নেয়ার ভুল করেননি মাশরাফি। কিন্তু রিভিউ নিয়েও কোনো লাভ হয়নি। অাম্পায়ারের নট আউট শেষ পর্যন্ত নট আউটই থাকে রিভিউ তে!

মাশরাফিতে টালমাটাল উইন্ডিজ

টেস্টে পেসারদের মাথা কুটতে দেখে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের পেসাররা বোধয় একদম নির্বিষ। কিন্তু কন্ডিশন যেমনই হোক আর প্রতিপক্ষ যেই হোক মাশরাফি যে মাশরাফি সেটা আরেকবার প্রমাণ করলেন তিনি। প্রথমটিসহ পরে তুলে নিয়েছেন আরো তিনটি উইকেট। সেটিও মাত্র ৩৭ রান খরচ করে। বাংলাদেশের পেস ডিপার্টমেন্টে এখনো যে মাশরাফির কোনো বিকল্প নেই সেটিই যেন আরো একবার দেখল সবাই। অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ, পেসের তারতম্যে বেশ কঠিন একটি পরীক্ষাই নিয়েছেন উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের। অধিনায়ক নিজেই যখন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তখন বাকিরাও যে নিজেদের উজাড় করে দিবেন সেটাই স্বাভাবিক।

মোস্তাফিজের অম্ল মধুর অভিজ্ঞতা

প্রথম স্পেলে উইকেট শূন্য থাকার পর দ্বিতীয় স্পেলে এসেই পুরোনো ঝলক দেখাতে শুরু করে ছিলেন মোস্তাফিজ। পরপর দুই বলে দুটি উইকেট তুলে নিয়ে আশার বারতাই যেন দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্ত সে আশার আলোকে আধারে ঢেকে দেয়ারই যেন পণ করেছিলেন আন্দ্রে রাসেল। ছয় মেরেই ক্ষ্যান্ত হননি, বল পাঠিয়েছেন সোজা মাঠের বাইরেই!

অপূর্ণতা বলতে শুধু অল আউট করতে না পারাটাই

ব্যাটিংয়ের পর বোলাররাই শুধু না বেশ আলো ছড়িয়েছেন ফিল্ডাররাও। মোসাদ্দেকের হাত একবার ফসকালেও সেটি একদম শেষ মুহুর্তেই। এর আগে বোলারদের পুরো সাহায্যই করেছেন ফিল্ডাররা। সহজ-কঠিন যেমনই হোক ক্যাচগুলো সব তালুবন্দি হতে দেখাটা বেশ ভালো লেগেছে।

গায়ানার এ জয়টা বাংলাদেশের জন্য ভীষণ দরকার ছিল। ওয়ান ডেতে বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই ধারাবাহিক একটি দল। এ জয়টি তাই নতুন করে সামর্থ্যের জানান দেয়ার না। এ জয়টা বরং শেষ কয়েক ম্যাচের টানা ব্যর্থতা থেকে মুক্তি দেয়ার একটি মোক্ষম দাওয়াই। যেভাবে পুরো ম্যাচটি খেলেছে বাংলাদেশ তা দেখে কে বলবে এ দলটিই দু টেস্ট মিলিয়েও পুরো পাঁচ দিন খেলতে পারেনি।