ঢাকার ফুট ওভারব্রিজগুলোতে রাতের অন্ধকারে নেই কোন নিরাপত্তা। রাতে লাইট জ্বালানোর ব্যবস্থা থাকলেও জ্বলছে না বেশিরভাগ ব্রিজে, আন্ডারপাসগুলোতে বিদ্যুৎ চলে গেলে নেই কোন বিকল্প ব্যবস্থা। আর যত অন্ধকার বাড়তে থাকে ব্রিজগুলো যেন বিপদের আখড়া হয়ে ওঠে।
ঢাকায় ৯১টি ফুটওভার ব্রিজ ও ৩টি আন্ডারপাস রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী, ঠিক জায়গায় ফুটওভার ব্রিজগুলো না তৈরি করার কারণে ঠিক মত ব্যবহার হচ্ছে না। অনেকগুলোতে ছিন্নমূল মানুষের বসবাসের স্থান হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। যেগুলো মানুষের পারাপারে ব্যস্ত, এগুলোর বেশি অংশ থাকে হকারদের দখলে। নিউমার্কেট, ফার্মগেটে ফুটওভার ব্রিজগুলোতে যাতায়াতের অর্ধেকটাতে পণ্যে সাজিয়ে বসে থাকে হকাররা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা কেন্দ্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে বছরে চার শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটে। যার ২৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে পথচারী রাস্তা পার হতে গিয়ে। গবেষণায় এসব দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে পথচারীদের ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করার বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়।
ফুটওভার ব্রিজগুলো অনেকটা মাদকসেবীদের দখলে। নির্জন এলাকার ব্রিজগুলো পারাপারে দিনের বেলাও অনিরাপদ মনে করেন পথচারীরা। সন্ধ্যার পর শুরু হয় ওভারব্রিজে ছিনতাইয়ের ঘটনা। ফুটওভার ব্রিজের খোলা যায়গাগুলো অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের ব্যানার দিয়ে ঢেকে যায়। এতে ছিনতাইকারীদের সুবিধা হয়। ঢাকাতে আগের চেয়ে অনেক ছিনতাই বেড়ে গেছে। আর ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোর একটা বিরাট অংশ ঘটে ফুটওভার ব্রিজগুলোতে। মিরপুর, শাহবাগসহ অনেক ফুটওভার ব্রিজে চলে দিনে রাতে ছিনতাই। এমনকি রাতে আপত্তিকর ঘটনা ঘটে, ব্রিজগুলো রাতে চলে যায় ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের হাতে।
ছিনতাইকারীদের কবলে প্রাণ গেছে অনেক মানুষের। ফুট ওভারব্রিজকে কেন্দ্র করে শুধু ছিনতাই নয়, গাঁজাসহ নানা মাদক বিক্রি ও যৌন ব্যবসা চলছে রাজধানীতে। যেসব ব্রিজে মানুষ বেশি চলাচল করে সেসব ব্রিজে শুরু হয়েছে হিজড়াদের ততপরতা। সন্ধ্যার পর থেকে সারারাত চলে এই ছিনতাইয়ের রাজত্ব। মিরপুর-১, ১০ ও আসাদগেট, রামপুরা, বনশ্রী এলাকায় ছিনতাইকারীদের অতিরিক্ত তৎপরতা দেখা যায় ভোর বেলা।
হাবিব নামের মাঝবয়সী পথচারীর কাছে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ী মানুষ, টাকা-পয়সা নিয়া চলাফেরা করি। সব সময় এ ফুট ওভারব্রিজে নেশাখোরদের আড্ডা বসে। তাদের নেশার টাকা কম পড়লে, যার কাছে যা পায়, তা-ই রেখে দেয়। তাই ফুট ওভারব্রিজের চেয়ে সড়কই নিরাপদ। সম্প্রতি শাহবাগ মোড়ে ফুট ওভারব্রিজে ছুরিকাঘাতে এক হকারের মৃত্যু হওয়ার পর থেকে নতুন করে ফুটওভার ব্রিজের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি আসে।
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)। ১৪৩ জন পথচারীর ওপর জরিপটি পরিচালনা করেছে ডুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। জরিপের শুরুতে অনাগ্রহের ১০টি কারণ শনাক্ত করা হয়। পরে ওই ১০টি কারণের ওপর চারটি ক্যাটাগরিতে পথচারীদের মতামত সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ পথচারী বলেছেন, ফুট ওভারব্রিজে নিরাপত্তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে তারা ফুট ওভারব্রিজ এড়িয়ে চলেন। ৩৪ ভাগ পথচারী বলেছেন ফুটওভার ব্রিজের প্রবেশমুখ খুবই সংকীর্ণ থাকে। ৬২ ভাগ পথচারী বলেছেন, ফুটওভার ব্রিজ হকারদের দখলে থাকায় তা ব্যবহার করা যায় না। ফুট ওভারব্রিজ স্থাপনের জায়গা সঠিক নয় বলে মত দিয়েছেন ৩৭ শতাংশ পথচারী।
রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজগুলোতে উঠে আসা পথচারীদের ভয় দেখিয়ে সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন ও মূল্যবান সামগ্রী কেড়ে নেয় তারা। শুধু ছিনতাইকারী নয় দেহব্যবসায়ীদের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে রাজধানীর বেশ কয়েকটি ফুট ওভারব্রিজে। এতে প্রতিনিয়তই পথচারীরা বিব্রতকর নানা ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
নগরীরর ব্যস্ততম এলাকা কারওয়ান বাজারের আন্ডার পাসটিতেও ছিনতাইকারীদের ভয়ে রাতে কোন পথচারী এটি ব্যবহার করে না বললেই চলে। ফার্মগেট, মিরপুর-১ ফুট ওভারব্রিজগুলো ছিনতাইকারীদের পাশাপাশি দেহব্যবসায়ীদের রমরমা ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মূলত সন্ধ্যার পর থেকে এসব এলাকার ওভারব্রিজগুলোতে এদের আনাগোনা বাড়ে।
ফুট ওভারব্রিজগুলোতে ব্যানারে থাকলে সহজে ছিনতাই করা যায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। নানা প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক ব্যানারে ঘেরা ফুটওভার ব্রিজে ছিনতায়ের ঘটনা ঘটছে বেশি। ব্যানারের আড়ালে খুব সহজেই করছে এই সব কাজ।