ভারত-অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের আয়তন ২ লক্ষ ২২ হাজার ২৩৬ বর্গকিলোমিটার। গত এক বছর ধরে টানা এক অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে অঞ্চলটিতে । ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে গত বছরের ৮ জুলাই হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর থেকে সেখানে পুলিশ ও জনতার মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ চলে আসছে। কাশ্মিরের বিভিন্ন স্থানে কারফিউ উপেক্ষা করে পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষ হতে দেখা গেছে। এই এক বছরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে দুই শতাধিত নিরীহ কাশ্মিরি। আহত হয়েছে আরো অনেকে। গ্রেফতারের শিকারও হয়েছে অসংখ্য জনগণ। ২০১০ সালে আমরা দেখেছি, দীর্ঘ চার মাস ধরে কাশ্মিরে প্রায় একই ধরনের উত্তপ্ত সংঘর্ষাবস্থা চলেছে। সে সময় প্রাণ হারায় ১১০ জন। নিহত কাশ্মিরিদের এদের মধ্যে তরুণের সংখ্যাই ছিল বেশি।
সাম্প্রতিককালে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সাথে প্রধানত সংশ্লিষ্ট রয়েছে কাশ্মিরের শিক্ষিত তরুণেরা। আগের মুজাহিদিনের চেয়ে এরা অনেক বেশি র্যাডিক্যাল ও প্রত্যয়ী। এরা কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী। এসব তরুণের সংখ্যা আগের তুলনায় অভাবনীয়ভাবে অনেক বেড়েছে । এরা দক্ষিণ কাশ্মিরসহ পুরো কাশ্মির উপত্যকাকেই সশস্ত্র আন্দোলনের এক হটবেডে পরিণত করেছে। এরা ভ্রুক্ষেপহীনভাবে হামলা চালাচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশের ওপর। এই সশস্ত্র তরুণেরা ব্যাপক জনসমর্থনও পাচ্ছেন। আসলে ১৯৮৯ সাল থেকে এদের প্রতি জনসমর্থন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বাড়ছে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী জন-আন্দোলনের তীব্রতাও।
কাশ্মিরে ভারতের প্রতি আস্থাহীনতার পারদমাত্রা যে বাড়ছে, তা আঁচ করা যায় নিহতদের জানাজায় মানুষের ঢল দেখে। নিহত বুরহান ওয়ানি এখন কাশ্মিরজুড়ে এক পোস্টারবয়। নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা যত বাড়ছে, ভারতবিরোধী মনোভাবের তীব্রতাও তেমনটি বাড়ছে।
নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের প্রাণহানিও বাড়ছে। বিষয়টি নিরাপত্তাবাহিনীকেও চিন্তিত করে তুলছে। সরকার ততোধিক শক্তি প্রয়োগ করে কাশ্মিরিদের দমন করতে চাইছে। এতে পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত সরকার কাশ্মির সমস্যার শেকড় জানতে দিচ্ছে না ভারতবাসীকে। কাশ্মিরিরা কোন মুসলিম দেশের কাছে থেকেও দরকারী সাহায্য পাচ্ছে না!
পাকিস্তান’র বর্তমান শাসকগোষ্ঠী একরকম ভাবে ভারতেরই মদদপুষ্ট। তারা কাশ্মিরের ইস্যুতে ‘ঝুলিয়ে রাখার নীতি’ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী এস্টাবলিশমেন্ট এর কারণেই নওয়াজ শরীফ কাশ্মির নীতি ডিসক্লোজ করতে পারেননি। এই রাষ্ট্রটি যদি একটু আন্তরিকতার সহিত সহযোগিতা করে এই ম্যুভমেন্ট ধরে রাখতে পারে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর মানচিত্রে কাশ্মির নামে একটা রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটবে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সেই কাজের জন্য নিজেদের পরিকল্পনা ও ট্রেটেজি পরিবর্তন করতে হবে আগে।
১৮৪৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মির ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি প্রিন্সলি স্টেট, যা শাসন করত রাজপুত ডুগরা রাজারা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নামেমাত্র সার্বভৌম স্টেটগুলোকে বলা হতো প্রিন্সলি স্টেট বা ন্যাটিভ স্টেট। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর জম্মু ও কাশ্মির রাজ্য গঠন করা হয়। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এর সাথে কাশ্মির উপত্যকাকে সংযুক্ত করে গোলাব সিংয়ের কাছে হস্তান্তর করেন ৭৫ লাখ রুপির ইনডেমনিটি পরিশোধের বিনিময়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হয়। তখন এই রাজ্যে মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই রাজ্য ছিল অমুসলিম মহারাজা হরি সিংয়ের শাসনাধীনে। তখন প্রশ্ন দেখা দেয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জম্মু ও কাশ্মির কার পক্ষে যোগ দেবে- পাকিস্তানের পক্ষে, না ভারতের, না এ দুই দেশের কোনোটির সাথে সংযুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ স্বাধীন কাশ্মির রাষ্ট্র গঠন করবে? এ নিয়ে নানা বিশৃঙ্খলা চলার মধ্য দিয়েই মহারাজা হরি সিং সামরিক সহায়তার বিনিময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই রাজ্যকে ভারতীয় ডোমিনিয়নে যোগ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর।
এ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই রাজ্যের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকিস্তানের হাতে, যা আজ আজাদ কাশ্মির ও গিলগিট বাল্টিস্তান নামে পরিচিত। একাংশ চলে যায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে, যা ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, কাশ্মিরের ২০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনের হাতে, যা আকসাই চীন নামেও পরিচিত। নিকট অতীতে জম্মু ও কাশ্মির হাইকোর্ট বলছে, জম্মু ও কাশ্মির ভারতের কোনো অংশ নয়। ২০১০ সালের দিকে ভারতের স্পষ্টবাদী লেখিকা অরুন্ধতী রায় ঠিক একই কথা বলেছিলেন : ‘কাশ্মির ইজ নট অ্যা পার্ট অব ইন্ডিয়া’।
এই সত্য উপলব্ধির ওপর ভর করে ওই সময় নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন : ‘কাশ্মির শুড গেট আজাদি ফ্রম ভুখে নাঙ্গে ইন্ডিয়া। সারকথা হল, কাশ্মিরের জনগণ চায় আজাদি। চায় না ভারত কিংবা পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূক্তি। কাশ্মির সমস্যার একমাত্র সমাধান নেহেরু প্রতিশ্রুত গণভোটের দ্রুত আয়োজন। বিগত ছয় দশকের ইতিহাস বলে, দমনপীড়ন চালিয়ে এ সমস্যার সমাধান কোনো দিন হবে না। ঐতিহাসিক প্রতারণা ও ভারত রাষ্ট্রের অত্যাচারে আর কতকাল জ্বলবে পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ কাশ্মির।