চল্লিশের দশকে কোন এক নির্জন রাতে কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ দাশ উচ্চারণ করেছিলেন, “মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্না’র প্রান্তরে”— এরপর কেটে গেছে কয়েক দশক। নিওলিথ যুগের মহেঞ্জোদারের ঘোড়াগুলোকে দেখা যায়নি নাগরিক কলকাতায়। তারপর আকস্মিক একদিন সংবিগ্ন এক দল ঘোড়া নেমে আসে বাংলা গানের ময়দানে। তখন সত্তরের দশক। এরাই হলো আধুনিক বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে ‘আরবান রক’ ঘরানার গানের দুরন্ত ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’।
বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাসে কিংবদন্তি এই ব্যান্ড গানের হাওয়া বদলে রেখেছে অসামান্য অবদান। ষাটের দশকে বব ডিলানের হাত ধরে যে ‘আরবান ফোক’ পৃথিবীর সংগীতপ্রেমীদের মন জয় করেছিল, মহীনের ঘোড়াগুলি সেই গানের ধারাকেই বাংলায় প্রতিস্থাপন করেছিলেন নিজস্ব গঠনে। পৃথিবীব্যাপী তখন গানের ইতিহাস বদলে যাচ্ছে; বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন, জিম মরিসনরা ক্লাসিক সংগীতকে ভেঙ্গে দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন নতুন ফর্ম। উল্টোপাশে বাংলা গান তার রোমান্টিক ধারাকে যেন ছাড়তেই পারছে না। ঠিক তখন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ বাংলা গানকে মুক্তি দিয়েছিল এক পশলা ভালোবাসা, একাকিত্ব, রাজনীতি-বিপ্লব, দারিদ্র, অন্যায়-অবিচার, স্বাধীনতা, যৌনপেশা আর নাগরিক জীবনযাপনের মিশেলে।
নকশাল আন্দোলনের সৈনিক ও রাজনীতি মনস্ক ব্যক্তিত্ব শিল্পী গৌতম চট্টোপাধ্যায়ই এই ব্যান্ডের পুরোধা পুরুষ। প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, তাপস দাস, আব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তিনি গঠন করেন ‘সপ্তর্ষি’ নামক গানের দল। ১৯৭৫ সালের কোন এক অনুষ্ঠানে দলের নাম ঘোষণা করেছিলেন ‘গৌতম চ্যাটার্জি বিএসসি অ্যান্ড সম্প্রদায়।” এরপর একদিন আড্ডায় লেখক এবং দলের সদস্য রঞ্জন ঘোষাল জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতা থেকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নামটি প্রস্তাব করেন। সে সময়ে কলকাতার সাহিত্য মহলে ও সাহিত্যরসিকদের মধ্যে সুররিয়ালিজম, যাদুবাস্তবতা, অ্যাবসার্ড ইত্যাদি শব্দগুলো জনপ্রিয় ছিল তাই ব্যান্ডের নাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সহজেই গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠল।
দল গঠন করার আগে গৌতম চট্টোপাধ্যায় কলকাতার বিভিন্ন হোটেলে একটি ওয়েস্টার্ন ব্যান্ডে স্যাক্সোফোন বাজাতেন। তিনি ব্যান্ডের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন নতুন ধরনের গানের সাথে। মিশ্রন ঘটান গীটার, স্যাক্সোফোন, ড্রামস, ভায়োলিন ও বাঁশির সাথে। তৈরি হয় নতুন সুরের মূর্ছণা। বাউল, রক, জাজ, ব্লুজ ও লাতিন মিউজিকের সমন্বয়ে নতুন গানের জগৎ উন্মোচিত হয় বাংলা গানের শ্রোতাদের সামনে। গানের কথায়ও আসে ভিন্নতা। গৌতম ছিলেন নকশাল আন্দোলনের সাথে যুক্ত। জেলও খেটেছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বৈপ্লবিক চিন্তা প্রভাব ফেলেছিল গানের কথায়। শুধু গানের কথা নয় কনসার্টের উপস্থাপনায় ছিল রঞ্জন ঘোষের ব্যতিক্রমী ভঙ্গি, টিকিটে থাকতো সদস্যদের আঙুলের ছাপ। আবার প্রতিটি অ্যালবামের সাথেই বের হতো বুকলেট তাতে লিখা থাকতো গানগুলোর নেপথ্যের সব ঘটনা।
মহীনের ঘোড়াগুলি’র কথা লিখতেন গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও রঞ্জন ঘোষাল। কণ্ঠ দিতেন গৌতম, প্রদীপ, তাপস ও তপেশ। লীড গিটার ও স্যাক্সোফোন ছিল গৌতমের দখলে। বেস গিটার প্রদীপ, গিটার তাপস ও তপেশ, ড্রামস বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়। পিয়ানো, ভায়োলিন, ভায়োলা বাজাতো আব্রাহাম মজুমদার। আর ১৯৭৮-৮১ সালের সময়টাতে রাজা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিল গিটারিস্ট। এছাড়াও দলে ছিল প্রণব সেনগুপ্ত, তপন চট্টোপাধ্যায়, প্রবাল হালদার, শর্মীষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গীতা ঘোষাল।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ সাল এই কয়েক বছর ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ চরে বেড়িয়েছে জ্যোৎস্না স্নাত কলকাতায়। তারপর যে যার পেশায় মুখ লুকিয়েছে। এই সাত বছরে তিনটি অ্যালবাম উপহার দিয়েছে শ্রোতাদের। অ্যালবামগুলো হলো ‘সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক’ (১৯৭৭), ‘অজানা উড়ন্ত বস্তু ও অ-উ-ব’ (১৯৭৮), ‘দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি’ (১৯৭৯)। অ্যালবাম তিনটিতে ছিল মাত্র আটটি গান।
মহীনের ঘোড়াগুলি’র গানের শ্রোতাপ্রিয়তা তখন এত ছিল না। তারা ছিল সময়ের তুলনায় অগ্রসর যার কারণে তাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগও তুলেছিল গতানুগতিক ধারার শিল্পীরা। যেমনটা ঘটেছিল ষাটের দশকের সাহিত্য আন্দোলন ‘হাংরি জেনারেশন’র ক্ষেত্রে। হাংরিয়েস্টদের আদালত পর্যন্ত যেতে হলেও এদের যেতে হয়নি। নানা প্রতিবন্ধকতায় আটটি গান ও স্টার থিয়েটার, রবীন্দ্র সদন, কলকাতা আন্তর্জাতিক জাজ উৎসবের মতো পনেরো-বিশটি অনুষ্ঠান আর রেকর্ড না হওয়া কয়েকটা গান নিয়ে হারিয়ে যেতে হয় তাদের আশির দশকের প্রথম বছরে অর্থাৎ ১৯৮১ সালে।
১৯৮১ সালে ব্যান্ড ভেঙে যাওয়ার পর কেটে যায় এক যুগেরও বেশি। নব্বইয়ের দশকে কলকাতার নাগরিক জীবন হয়ে ওঠে আরও দ্বন্দ্বমুখর। মানুষের একাকিত্ব বাড়তে থাকে। তৈরি হয় ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গানের শ্রোতা। সুব্রত ঘোষাল নামক এক তরুণের আগ্রহে আবার পুনর্গঠিত হয় ব্যান্ডটি। ১৯৯৫ সালের বইমেলায় তাদের ৪র্থ অ্যালবাম ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ মুক্তি পায়। এতে গৌতম যে গানগুলোকে মানুষ প্রত্যাখান করেছিল সে গানগুলোকেই ফিরিয়ে এনে ঠাই দেন অ্যালবামে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত ৫ম ও ৬ষ্ঠ অ্যালবাম ‘ঝরা সময়ের গান’ ও ‘মায়া বাজারে আসে’ মুক্তি পায়। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় ‘ক্ষ্যাপার গান’ শিরোনামের ৭ম ও শেষ অ্যালবাম। সংকলিত অ্যালবামগুলোতে বিভিন্ন নবাগত প্রতিশ্রুতিশীল ব্যান্ড যুক্ত ছিল। তারা লিরিক রচনা ও সুর করায় সহযোগিতা করত।
মহীনের ঘোড়াগুলির গানগুলোর মধ্যে পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, চৈত্রের কাফন, সংবিগ্ন পাখিকূল, পড়াশোনায় জলাঞ্জলি, ধাঁধার থেকে জটিল তুমি, তোমায় দিলাম, আমার প্রিয়া ক্যাফে, দক্ষিণ খোলা জানাল, হায় ভালোবাসি, টেলিফোন সর্বাধিক জনপ্রিয় গান।
১৯৯৯ সালের জুন মাসের ২০ তারিখ ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র পুরোধা এবং বাংলা জীবনমুখী গানের আদিস্রষ্টা গৌতম চট্টোপাধ্যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করলে ব্যান্ডটি আমাদের কাছে হয়ে যায় কোন এক প্রাচীন সভ্যতার উবে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস। খুব অল্পসময় এবং কম তৎপরতায় বাংলা গানের কিংবদন্তি হয়ে ওঠা ব্যান্ডটি আজও আধুনিক মনস্ক মানুষের সংগীতের খোরাক হয়ে বয়ে চলেছে একটি নদীর মতো। যত সময় গড়াচ্ছে ততই আবেদন বাড়ছে চিরন্তন এই গানগুলোর আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষের মনের মধ্যে নিজস্ব আসন করে নিচ্ছে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’।
তথ্যসূত্র:
মহীনের ঘোড়াগুলি/ গৌতম কে শুভ
কবি জীবনানন্দ দাসের মহীনের ঘোড়াগুলি/ রেজওয়ান হাসান
মহীনের ঘোড়াগুলি/ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়