ফ্যাসিবাদের জমানায় হুমায়ূন পাঠ

ফ্যাসিবাদের জমানায় হুমায়ূন পাঠ

পরিহাস বা পরিতাপের কিছু নাই। এখনকার বাস্তবতা হলো ফ্যাসিবাদের থাবার নিচে দাঁড়ায়া হুমায়ূন আহমেদ পাঠের ভূমিকা প্রস্তাব করতে হচ্ছে। এই ভূমিকাকে কৈফিয়ত আকারেও দেখা যায়। এবং এটা আমার একার কৈফিয়ত না অবশ্যই। আমার মতো অসংখ্য তরুণ হুমায়ূন পড়তে পড়তে বড় হয়েছে। তাদের জীবনে হুমায়ূনের প্রভাব এত গভীর হয়েছে যে, আলাদা করে কখনও হুমায়ূনের পর্যালোচনার দিকে এরা নজর ফিরাতে পারে নি। এদের মধ্যে একদল আবার হুমায়ূনম্যানিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। ফ্যাশনের অংশ করেছে হুমায়ূনকে। বাংলাদেশের খাপছাড়া বিজ্ঞাপনী বাজার-সংস্কৃতির একটা বড় ভূমিকা আছে হুমায়ূন নিয়ে এই ফেনানো ভাবটা পয়দা করার পিছনে। এতে আমাদের কোনো লাভ হয়েছে এমনটা বলতে পারব না। তবে ক্ষতি যেটা হয়েছে তা ভয়াবহ। আমরা আত্ম-ভোলা হয়ে গেছি।

হুমায়ূন পড়ে নেশা ধরে যায়। আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই কেন আমরা হুমায়ূন পড়ি বা পড়ব? ফলে এলিট সাহিত্যের মোড়লরা হুমায়ূন-পাঠকদের দেখে চটকদার, হাল্কা পাঠক হিসেবে। হুমায়ূন পায় রাজ্যের তিরস্কার। আবার যেহেতু বাজারে হুমায়ূন এমন একটা গিমিক তৈরি করেছে তাকে নিয়া কিছু কথা না বললে মোড়ল সমাজের চলেই না। তখন তাঁরা চিবিয়ে চিবিয়ে যা বলে তা এক কথায় জঘন্য মিথ্যাচার। প্রায় সবাই কথা বলে হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা নিয়ে। এর সাথে বাজারের যত বেশি সম্পর্ক সাহিত্যের ততটা নাই। অথচ বাংলাদেশের হীনম্মন্য এলিট মোড়লরা হুমায়ূন নিয়ে এই সব ‘খুচরা’ বয়ানই চালু করে থাকে। এতে লেখক হিসেবে হুমায়ূনের প্রতি যেমন সীমাহীন অন্যায় করা হয় তেমনি বিপুল তরুণ পাঠককে আন্ডারমাইন করা হয়।

এখন এর জন্য তরুণরাও কিছুটা দায়ী। নিজেদের হীনম্মন্যতা তারা কাটিয়ে উঠতে কী কী পদক্ষেপ নিবে তা তারা ভেবে দেখে নি। ফলে হাল্কা চটুল বলে হুমায়ুনকে খুব সহজেই ডিজুস সংস্কৃতিমার্কা পোলাপানের লেখকের তকমা দিয়ে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই বাস্তবতা প্রকটভাবে হাজির থাকার কারণে এটা সহজেই সম্ভব হয়েছে। পাঠক হিসেবে আমরা হুমায়ূনকে যত পড়েছি ততই হুমায়ূনকে অবহেলা করার মতাদর্শও শক্তিশালী করেছি একই সাথে। আমরা, হুমায়ূন-পাঠকরা, মুগ্ধ ছিলাম মিডিয়ার ভেল্কিবাজিতে। আমরা একবারও খতিয়ে দেখি নি আসলে হুমায়ূন আহমেদ কী? তিনি কী কাজটা করে গেছেন? বা কিভাবে হুমায়ূনকে বুঝতে পারব তার জন্য কোন মেহেনতও করি নি। আমরা নিজেরা আসলে লায়েক হই নি। তাই হুমায়ূন নিয়ে মাতামাতিতে আছি। কিন্তু হুমায়ূন ইতিহাসের কোন মতাদর্শের সৈনিক তা খুঁজে দেখি নি।

এই অপরিণত অবস্থাটা আসলে জাতি হিসেবে আমাদের অপরিণত থাকারই মামলা। বাংলাদেশ যেমন অসংগঠিত, অসংলগ্ন, এদেশের পাঠকও তেমনি অপরিণত—ইতিহাস বিচারের প্রশ্নে। এই দিক থেকে দেখলে হুমায়ূন খুব ভাগ্যাহত লেখক সন্দেহ নাই। যে হুমায়ূন পড়ে সে জানে না কেন, বা সে হয়তো বলবে ভাল লাগে তাই পড়ি। কিন্তু কেন ভাল লাগে? সে নিশ্চিত না। এই আত্মচেতনাহীনতা হুমায়ূনকে আমাদের কাছে ঐতিহাসিকভাবে অপরিচিত করে রেখেছে। ফলে, আমরা চিনি একজন জনপ্রিয় লেখককে। এটা আরও বেশি চিনি নাটক-সিনেমার কারণে। কিন্তু আমরা হুমায়ূনকে চিনি না। কোনো লেখককে ইতিহাসের বা জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক বিকাশের মধ্য দিয়ে না চিনলে তাকে পড়ে হাসলে বা কাঁদলে কোনোই ফায়দা নাই। এটা কোনো কাজে লাগে না। সেই দিক থেকে হুমায়ূন খুব মন্দভাগ্য বলতে হবে।

 

ফ্যাসিবাদের কালে হুমায়ূন ‘পাঠ’ খুব আরামের কাজ না। বিশেষ করে হুমায়ূনের মধ্যে ফ্যাসিবাদের উপাদান আছে বলে এখানকার বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী-দার্শনিকরা যখন অভিযোগ করে বসে আছেন। আমিও এই অভিযোগকে আমলে নিতে রাজি

 

এই করুণদশা কাটিয়ে উঠার দিকে আমি পাঠকদের দৃষ্টি ফেরাব। এজন্য আমাদের প্রথমে প্রশ্ন করতে হবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের যে বয়ান খাড়া হয়েছে তা নিয়ে। সেই বয়ান হুমায়ূন এলার্জিতে কেন ভুগে সেটাও তখন আমরা সহজে ধরে ফেলতে পারব। হুমায়ূনের অস্থির পাঠককূল এবং বেহুঁশ ব্যবসায়ী দিয়া এই কাজ হবে না। এই কাজের জন্য আমাদের মতাদর্শিকভাবে লড়াকু মানুষ দরকার। যে কিনা জনগোষ্ঠীর নয়া ইতিহাস নির্মাণের হিম্মত নিয়া দাঁড়াবে। এটা হিমুখোরদের দিয়ে হবে না। এরা ফ্যান্টাসি করেই খতম। যে বাংলায় গৌতম বুদ্ধ আছে সেখানে হিমু চরিত্র দেখে আবাক হওয়ার কিছু নাই। আমরা ইতিহাসের পথটা উপনিবেশী বয়ানের মধ্যে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে গেছি। যা হোক আমি শক্তভাবে বলছি, হুমায়ূনকে হাল্কাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নাই। যথেষ্ট মুরোদ না থাকলে হুমায়ূন নিয়া পর্যালোচনা করা সম্ভব হবে না। ফলে হুমায়ূন পাঠের মধ্যদিয়ে আমরা কেবল একটা লেখকের কিছু বই-ই কেবল পড়ব না, একই সাথে আমাদের ঐতিহাসিক নির্মাণের খুঁটিও হদিস করতে পারব। এটাই হুমায়ূন পাঠের নগদ ফায়দা।

ফ্যাসিবাদের কালে হুমায়ূন ‘পাঠ’ খুব আরামের কাজ না। বিশেষ করে হুমায়ূনের মধ্যে ফ্যাসিবাদের উপাদান আছে বলে এখানকার বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী-দার্শনিকরা যখন অভিযোগ করে বসে আছেন। আমিও এই অভিযোগকে আমলে নিতে রাজি। কিন্তু তাদের যে অনুমান তা আমি মানতে রাজি না। কারণ হুমায়ূনে এই ঘটনা কেমনে ঘটেছে তার হদিস করতে গিয়ে আমি ভিন্ন জিনিস পেয়েছি। যারা মনে করেন হুমায়ূন ফ্যাসিবাদের খপ্পর থেকে বের হতে পারেন নি, তাদের এই অভিযোগের পিছনে বড় যুক্তি বিপুল জনপ্রিয়তা, বিশাল পাঠক তার কজ্বায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বয়ানকে তিনি ঘোষণা দিয়ে কোথাও বিরোধিতা করেন নি। তাকে নিয়ে মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে তুমুল উন্মাদনা। এগুলোর সাথে ফ্যাসিজমের যোগ আাছে এটা অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু এগুলার সাথে হুমায়ূনের ডিলিংটা তীক্ষ্ণভাবে খেয়াল না করলে একদিকে হুমায়ূনকে উল্টা বুঝব, অন্যদিকে হুমায়ূনের লড়াইটাও আড়ালে পড়ে যাবে। জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। লড়াইটা তিনি তাঁর মতো করেই করেছেন। খুব উচ্চকিতভাবে নয় অবশ্যই।

একটু আগে যা বললাম, হুমায়ূনের পাঠক আত্মভোলা, ফলে এর ফ্যাসিবাদী হওয়ার সম্ভাবনা নাই। আত্মগরিমা ছাড়া ফ্যাসিবাদ হয় না (ফ্যাসিবাদ বলতে এখানে বেঙ্গলি ন্যাশনাল-এর কালচারাল ফ্যাসিবাদ বুঝানো হচ্ছে)। অন্যদিকে হুমায়ূন মাঝে মাঝে পত্রিকায় তাৎক্ষণিক কলাম বা ছোট ছোট যে সব কমেন্টারি করেছেন তা পড়েই এই বুদ্ধিজীবীরা হুমায়ূনকে বুঝেছেন। এই সব তাৎক্ষণিক রচনায় হুমায়ূন খুব কাঁচা চিন্তা যে হাজির করেন নি তা নয়, হাস্যকর মতামতও খুঁজে পাওয়া যাবে মেলা। কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি হুমায়ূনের যেটা কাজ মানে গল্প-উপন্যাসে এই জিনিস নাই। এই দুই ফারাককে বুঝব কেমনে?

ছোট করে বলি, যখন সচেতনভাবে হুমায়ূন জাহানারা ইমাম বা ইউনূস নিয়া লিখেন তখন তা গণবিভাজনের নিরিখেই লেখেন। নানা হিসাব-নিকাশ তো এইসব লেখায় থাকেই। কিন্তু একজন ফিকশন রাইটার হিসেবে তিনি যেই ইতিহাসের ন্যারেটর, তা স্বাভাবিক বা সহজাত প্রবণতায় হুমায়ূনকে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে, যা তিনি নিজে সবসময় ঠাহর করে উঠতে পারেন নি। মহৎ লেখকের প্রজ্ঞার যে ঐতিহাসিক বিবেচনা তা হুমায়ূনের ছিল। এটা সচেতনভাবে তার মধ্যে ছিল, এটা অন্তত তাঁর সাক্ষাৎকার বা নিজের সম্পর্কে বক্তব্য থেকে হুবহু সবসময় প্রমাণ করা যাবে না। এখানে হুমায়ূন বঙ্কিমের ঠিক উল্টা। অন্যদিকে বাংলাসাহিত্যের যে ঐতিহাসিক ধারাক্রম তা বঙ্কিমবাহিত উপনিবেশী-ক্যালকেশিয়ান বয়ান বৈ তো নয়। হুমায়ূন এই লিনিয়ার ইতিহাসের বাইরের নায়ক। ঢাকা সম্পর্কে কলকাতার বয়ানটা তো আপনারা জানেন—‘কুকুর, ডাস্টবিন আর মুসলমান’—বঙ্কিম।

 

এখনকার বাস্তবতা হলো ফ্যাসিবাদের থাবার নিচে দাঁড়ায়া হুমায়ূন আহমেদ পাঠের ভূমিকা প্রস্তাব করতে হচ্ছে। এই ভূমিকাকে কৈফিয়ত আকারেও দেখা যায়। এবং এটা আমার একার কৈফিয়ত না অবশ্যই। আমার মতো অসংখ্য তরুণ হুমায়ূন পড়তে পড়তে বড় হয়েছে। তাদের জীবনে হুমায়ূনের প্রভাব এত গভীর হয়েছে যে, আলাদা করে কখনও হুমায়ূনের পর্যালোচনার দিকে এরা নজর ফিরাতে পারে নি

 

বাংলাদেশ রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার পর এই মুসলমান তো আগের মতো রইল না। কলকাতা দিল্লির কাছে এমন মাইর খাইল যে কোমর ভাইঙ্গা গেল। আর দাঁড়াতেই পারল না। কলকাতাও বাধ্য হলো বাংলাদেশে ঝুঁকতে। হুমায়ূনেও আগ্রহী হলো। যারা তাকে অশিক্ষিত লোকের লেখক মনে করত তারাও হুমায়ূনকে খাতির করতে শুরু করল। আর আমরাও মনে করলাম আমাদের প্রিয় লেখক হুমায়ূন বুঝি ‘জাতে’ উঠল? মনে রাখতে হবে হুমায়ূন ‘অজাতের’ লেখক। সে উকিল মুন্সী, শীতলং ফকিরের ভাষার মাধুরী নিয়া বাংলা সাহিত্যে হাজির হয়েছে। এটা নিয়া আলাদা লিখছি। তো, হুমায়ূন কত বড় লেখক এটা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি কেবল দেখাতে চাইছি আমাদের জন্য হুমায়ূনের জরুরৎটা কতটুকু। এটা খুঁজতে গিয়ে বলা যায় আমি খনির সন্ধান পেয়েছি। হুমায়ূন সেই লেখক যাকে ইন্টারপ্রেট করতে পারলে আমাদের ইতিহাসের অবর্জনা সাফ হয়ে যাবে। বাংলাসাহিত্য যে ক্যালকেশিয়ান উপনিবেশের খপ্পরে পড়ে আছে তা থেকে দ্রুত আমরা বাংলাদেশের রুটে ফিরতে পারব হুমায়ূনের হাত ধরে। মনে রাখতে হবে হুমায়ূন জাতীয় সাহিত্য প্রকল্পের লোক না। তাকে সবসময় র‌্যাশনালি ব্যাখ্যা করতে চাওয়া গাঁজাখোরি হবে। হুমায়ূন র‌্যাশনাল সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারত। এবং সেটা অতিক্রমও তিনি করতে পেরেছেন। আশা করি হুমায়ূন বড় লেখক, মহান লেখক ইত্যাদি ফাঁকা কথা আর বলতে হবে না। তাঁর গুরুত্বের জায়গাটা আন্দাজ করা যাচ্ছে।

আমাদের এখানে সাহিত্য আলোচনার নামে যে পৌত্তলিকতা পয়দা হইছে তা না ভাঙলে তো হুমায়ূন নিয়া কথা উঠানো যাবে না। ‘সরলমনা অধ্যাপকীয়’ চালে হুমায়ূন আলোচনা কেবল দুর্গন্ধই ছড়াবে। আমরা সেই পথ সচেতনভাবে বাদ দিব। সাহিত্যের সাথে ক্ষমতা, রাজনীতি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের সম্পর্ক নিয়া হিম্মতওলা তর্ক আমাদের এখানে এখনও উঠে নি। পশ্চিমা চিন্তার দাসত্ব যারা করেন এরা কিছু ফটকা আওয়াজ দেন মাঝে মাঝে। ফুকো, দেরিদার নাম ঝাড়েন মাত্র। এগুলা মূলত পড়েও দেখেন না। আমাদের বদনসিব হলো এখনও আধুনিকতার আছর আমাদের ছেড়ে যায় নি। ‘আর্ট’-এর নামে একটা ধর্মতত্ত্ব আমরা খাড়া করেছি। যা জন্ম নিয়েছে আবার প্রোটেস্টানিজমের গর্ভে। এই দিক থেকে হুমায়ূন পাঠের ফায়দা এবং তাৎপর্যটা যদি আমরা বুঝতে পারি তাইলেই নগদ লাভ।

 

হুমায়ূন পড়ে নেশা ধরে যায়। আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই কেন আমরা হুমায়ূন পড়ি বা পড়ব? ফলে এলিট সাহিত্যের মোড়লরা হুমায়ূন-পাঠকদের দেখে চটকদার, হাল্কা পাঠক হিসেবে। হুমায়ূন পায় রাজ্যের তিরস্কার

 

হুমায়ূনের জন্ম কোনোভাবেই উপনিবেশী কালচারাল ফ্যাসিবাদী বয়ানের ভেতর হয় নি। হুমায়ূন ঘোষণা দিয়ে এন্টি-বাঙালি জাতীয়তাবাদী না হলেও, মহৎ লেখকের যে মৌলিক মানবিক জায়গা থাকে তা হুমায়ূনের ছিল। এর ঐতিহাসিক যে এডভান্স দিক থাকে তাও হুমায়ূনের আছে। প্রবলভাবেই আছে। কলামের সচেতন হুমায়ূন আর উপন্যাসের আখ্যান বয়ানকারী সহজাত হুমায়ূন সম্পূর্ণ আলাদা। একটা আরেকটার কনট্রাডিকটরি।

পিলখানার হত্যাকাণ্ড নিয়ে তিনি যখন কলাম লেখেন তখন যে সচেতন হুমায়ূনকে পাই, তিনি যখন ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’ লিখেন, তা এসেনশিয়ালি সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি ইউনূস নিয়ে যে উচ্ছ্বসিত লেখা লিখেন বা জাহানারা ইমাম তাঁর কাছে যেভাবে হাজির হয় তার সাথে যে ইতিহাসের বয়ানের ভেতর তিনি আখ্যান লেখক আকারে হাজির হন, তার কোনো মিল নাই। তাছাড়া এই কলামগুলোও যে তিনি চিন্তার জায়গা থেকে লেখেন তাও না। কোথাও কোথাও কনট্রাডিকশনসহই তিনি কলামে হাজির হয়েছেন। ‘ঘাতক-দালাল র্নিমূল কমিটি’ বা জাহানারা ইমামের নামে হালে যে মাতৃতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ আমরা দেখছি তার সাথে হুমায়ূনের সর্ম্পক প্রশ্নহীন ছিল না। উদাহরণ হিসেবে জাহানারা ইমামের সাথে তাঁর ফোন-আলাপের কিছু অংশ পড়ি:

জাহানারা ইমাম: আপনি স্বাধীনতা-বিরোধীদের পত্রিকায় লিখেন কেন? আপনার মতো আরও অনেকেই এই কাজটি করে। কিন্তু আপনি করবেন কেন?

আমি হকচকিয়ে গেলাম। আক্রমণ এদিক থেকে আসবে ভাবি নি। তবে পত্রিকায় লেখা দেওয়ার ব্যাপারে আমার কিছু যুক্তি আছে। খুব যে দুর্বল যুক্তি, তাও না। যুক্তিগুলো তাঁকে শোনালাম। মনে হলো তিনি আরও রেগে গেলেন।

এই লেখায় হুমায়ূন জানাচ্ছেন ‘ঘাতক-দালাল র্নিমূল কমিটি’ যে ১০১ জন নিয়ে যাত্রা শুরু করে তিনি এই ১০১ জনের একজন। হুমায়ূন লিখছেন, ‘আমি সেই আন্দোলন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। পরে আমার আর কোনো খোঁজ খবর নেই। কাজেই আমার ভূমিকায় অস্পষ্টতা আছেই। (বসন্ত বিলাপ, পৃষ্ঠা ৬১)

এখানে বলে রাখি, আমরা অপরাধের বিচার চাই। বিচারের পক্ষে। কিন্তু কোনো নাগরিককে র্নিমূল করার মতো ঘাতকদের মেনে নিতে পারি না। সেই দিক থেকে মধ্যবিত্ত আর্ট-কালচার করা লোকজন যখন ‘ঘাতক’ হয়ে উঠছে, হুমায়ূন তখন তার ভূমিকা নিয়া দ্বিধায় পড়েছেন। তিনি মধ্যবিত্ত সাহিত্য সমাজের সবচেয়ে বড় ফিগার। কিন্তু যারা বলে হুমায়ূন মধ্যবিত্তের লেখক তাঁরা জাত-মূর্খ। সাহিত্য, আর্ট-কালচার এগুলো আদতে মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলের ভিতরকারই কারবার। তাই বলে এগুলাকে একাট্টা মধ্যবিত্তের বলে চালানোর চেষ্টা গুয়ার্তুমি। তিনি কোনোভাবেই মধ্যবিত্তের লেখক নন। তার চরিত্র নানা শ্রেণি থেকেই উঠে এসেছে। তিনি বাংলাদেশের লেখক। দেশের নানান শ্রেণি তাঁর লেখায় স্ব-মহিমায় হাজির। এখানে মার্ক্সীয় শ্রেণি ব্যাখ্যার দিকে যাচ্ছি না।

আরো একটা কথা বলা হয়, হুমায়ূন উপন্যাস লিখতে পারত না। যা লিখেছে তা উপন্যাস হয় নি। উপন্যাস কেমনে হয়? ইলিয়াসের মতো লিখলে উপন্যাস হয়? এটা এক ধরনের পৌত্তলিকতা। কোনো সাহিত্যের ইতিহাস এই ধারা একাট্টা ধারণার রাজত্ব বরদাশত করে না। ইউরোপে যখন এপিক উপন্যাসের ধারণা প্রবল তখন বেকেটের মতো লেখকরা কী করছে তা একটু দেখলে আমাদের মুরুব্বিদের গাঁজাখোরি তত্ত্ব ঝেঁটিয়ে বিদায় করা সহজ হবে। স্যামুয়েল বেকেট যে প্রোজ ফিকশনগুলা লিখেছেন তা ছিল আধিপত্যশীল ক্লাসিক- র‌্যাশনাল-এক্সিস্টেনশিয়াল লিটারেরি ধারার বিরুদ্ধে জেহাদ স্বরূপ। তার কাজ সম্পর্কে বলা হয়, grotesquely comic and also irrational and nonconsequential; it is parody not only of the traditional assumptions of western culture…characters carry on, even if in a life without purpose, trying to make sense of the senseless and to communicate the uncommunicable. ( M. H. ABRAMS; Eight edition: Glossary of literary terms. Uk-1929)

আমি স্যামুয়েল বেকেটের সাথে হুমায়ূনের কোনো তুলনামূলক আলোচনা করছি না। আমার দাবি সামান্য। আমি বলছি, হুমায়ূনের উপন্যাসেও আমরা দেখব যুক্তিহীন, পরম্পরাহীন কৌতুককর বিষয় এবং এই ব্যাপারগুলো আমাদের পূর্ববাংলার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে আছে। মনে হবে তিনি বুঝি খামাখা বা খামখেয়ালি কিছু চরিত্র সৃষ্টি করেছেন? মর্মহীন মর্ম ধরে হুমায়ূন বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্কের সূত্রধর হিসেবে আর্বিভূত হয়েছেন।  হুমায়ূন এগুলাই লেখক হিসেবে প্রোজেক্ট করেছেন। গড়ে তুলেছেন এমন এক ন্যারেশান যা তাকে সাহিত্যের ভিন্ন একটা ধারা, যার নাম দিতে পারি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ধারার নায়কে পরিণত করেছে।

কাজেই মধ্যবিত্ত দোহাই দিয়ে আমরা হুমায়ূনকে কালচারাল ফ্যাসিবাদের খপ্পরে ফেলে দিতে পারি না।

অন্যদিকে হুমায়ূন পাঠের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস নির্মাণের যে জরুরি কাজটি বাকি আছে তার দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতে পারব। বঙ্কিম আপসোস করে বলেছিল, ‘বাঙালির কোনো ইতিহাস নাই’। পরে বাঙালির ইতিহাস বলে যা দাঁড়ালো, তার মধ্যে বাংলাদেশের ভূগোলের হদিস থাকলেও প্রাণটা নাই। বাংলাদেশের প্রাণের স্পন্দনটা হুমায়ূন টের পেতেন। ফলে আমাদের ইতিহাস নাই আমি বলব না। আমাদের ইতিহাসের বোধ নাই। ‘উপন্যাসপ্লাবিত বাংলাদেশের’ ইতিহাস আছে, ন্যারেশান বা বয়ানও আছে। হুমায়ূনও আছেন।