পথশিশু শব্দটাই তুলে দিতে চান যারা

পথশিশু শব্দটাই তুলে দিতে চান যারা

রোদে পুড়ে যাওয়া গায়ের রঙ, জীর্ণশীর্ণ শরীর, হাতে আধছেঁড়া বস্তা, ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া চুল, পরনে হাফপ্যান্ট— ‘পথশিশু’ শব্দটি শুনলেই এমন এক পরিচিত চিত্র ভেসে ওঠে আমাদের মনে। অবহেলায় নুইয়ে পড়া তিন থেকে পনেরো বছরের হাজারো ছেলে-মেয়ে দেখতে পাওয়া যায় ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে। ডাস্টবিনই এদের খাদ্যসংস্থানের প্রধান উৎস। রাস্তার পাশের ফুটপাথ এদের বাসস্থান। মাথার উপরের খোলা আকাশ দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী।

মনে হতে পারে, এদের নিয়ে ভাববার কেউ নেই। কিন্তু না, এই স্বার্থপরায়ণ পৃথিবীতে কিছু লোক অন্তত এখনও বেঁচে আছে, যারা কিনা এদের নিয়ে ভাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন-ফিল্ম স্টাডিজের প্রথম বর্ষের ছাত্র হাসান বিশ্বাস। চলার পথে চোখের সামনে পড়া এসব জীর্ণকায়-অসহায়-অবহেলিত শিশুদের নিয়ে সেও ভাবতে শুরু করে একটা সময়। সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদেরও যে স্বপ্ন-ইচ্ছে-আল্লাদ থাকতে পারে, তারাও যে ‘অ-আ; ক-খ’ শেখবার দাবি রাখে—এসব ভাবতে ভাবতেই আরও কয়েকজন বন্ধু নিয়ে হাসান নেমে পড়েন পথশিশুদের নিয়ে কিছু করার প্রয়াসে। প্রতিষ্ঠা করেন ব্লুমিং বার্ডস নামক পথশিশুদের জন্য অবৈতনিক একটি স্কুল। নানা বিপত্তির বেড়াজাল কাটিয়ে আইন বিভাগের ফাহমিদা লুবনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তাওহীদুল ইসলাম তামিম, সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউটের হাসান মতিউর রহমান ও টেলিভিশন-ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের হাসান বিশ্বাস গত ১১ই ফেব্রুয়ারি ব্লুমিং বার্ডস স্কুলের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটায়।

শুরুতে সদস্য সংখ্যা কম থাকলেও বর্তমানে বেড়েছে সদস্যের পরিমাণ। প্রায় ৫৩ জন সদস্য নিয়ে ব্লুমিং বার্ডস স্কুল এগিয়ে চলেছে।

পাঠদানের জায়গা হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের জায়গাটুকু। প্রতি মঙ্গলবার ও শুক্রবার বসে শিশুদের পাঠদানের আসর। নিজ পকেটের টাকা খরচা করে খাদ্য-খেলনা দিয়ে শিশুদের স্কুলমুখী করতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করেন না প্রথম বর্ষে পড়ুয়া এসব উদ্যমী শিক্ষার্থীরা।

অনেকদিন যাবৎ অবহেলা-অসামঞ্জস্যতা ও স্বাভাবিক শিশুতোষ জীবনের বাইরে থাকা এসব শিশুকে পাঠদানের ক্ষেত্রে বেশ বেগ পেতে হয়। বুঝিয়ে, গান শুনিয়ে, নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে, খেলনা দিয়ে সামলাতে হয় তাদের।

শিশুরা ঈদের জামা পেয়ে আনন্দে খেলায় মেতে ওঠে তারা

ব্লুমিং বার্ডস শুধু পাঠদানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; করেছে বিভিন্ন অনুপ্রেরণাদায়ক কাজ। গত এপ্রিলের তেরো তারিখে তারা ৩৭ জন পথশিশুর হাতে বস্ত্র তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে বৈশাখী আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছে।

প্রথম রমজানে ব্লুমিং বার্ডস স্কুল শহীদ মিনারেই ইফতারের আয়োজন করেছে পথশিশুদের নিয়ে। পথশিশুদের ঈদ-আনন্দে যাতে ঘাটতি না পড়ে, সেদিকটা খেয়াল রেখে গত ১৫ই রমজান ৪০ জন পথশিশুর হাতে তুলে দিয়েছে ঈদের কাপড়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এসবের অর্থায়নের পুরোটাই সদস্যদের কাঁধের ওপর যায়। কিছু মানুষের একটু কষ্টের ফল হিসেবে দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্য জোটে অনেক শিশুর পেটে; পৌঁছায় শিক্ষার আলো। হাসানরা এগিয়ে এসেছে, এবার সম্মানের উচ্চাসনে বসে থাকা ব্যক্তিবর্গের সাহায্য দরকার, দরকার এগিয়ে আসার মানবিক প্রয়াস। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই অভিধান থেকে বিদায় করতে পারে ‘পথশিশু’ শব্দটিকে। হাসান বিশ্বাসরা স্বপ্ন দেখেন সম্মিলিত প্রয়াস জারি থাকলে একদিন পশশিশু শব্দটাই হারিয়ে যাবে আমাদের সমাজ থেকে।