ফ্রান্স ৪ – ২ ক্রোয়েশিয়া
মানজুকিচ (ও) ১৮ পেরিসিচ ২৮
গ্রিজম্যান ৩৮ (পে) মানজুকিচ ৬৯
পগবা ৫৯
এমবাপ্পে ৬৫
একাদশ
ফ্রান্স : লরিস, পাভার্ড, ভারানে, উমতিতি, হার্নান্দেজ, পগবা, কান্তে, মাতুইদি, গ্রিজম্যান, জিরুদ, এমবাপ্পে।
ক্রোয়েশিয়া : সুবাসিচ, ভ্রাসালকো, লভ্রেন, ভিদা, স্ট্রিনিচ, রাকিতিচ, ব্রোজোভিচ, রেবিচ, মদ্রিচ, পেরিসিচ, মানজুকিচ
• বিশ্বকাপের এটি ছিল ৯০০তম ম্যাচ।
• মানজুকিচের গোল বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রথম আত্মঘাতী গোল।
• পেলের পর প্রথম টিনএজার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করলেন এমবাপ্পে।
• গত বিশ বছরে একমাত্র দল হিসেবে তিনটি ফাইনাল খেলেছে ফ্রান্স।
• ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ছয় দেখায় একবারও জিততে পারল না ক্রোয়েশিয়া।
• ক্যাসিয়াসের পর দ্বিতীয় ব্যক্তি লরিস যিনি অধিনায়ক এবং গোলরক্ষকের দ্বৈত ভূমিকায় বিশ্বকাপ জিতেছেন।
• ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম মাত্র তৃতীয় ব্যক্তি যিনি খেলোয়াড় এবং কোচ দুই অবতারেই বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছেন।
মস্কোর ফ্যান জোন থেকে প্যারিসের জায়ান্ট স্ক্রিন, শেষের কয়েক সেকেন্ড আগে ডাগআউটে দাঁড়িয়ে চঞ্চল ফ্রেঞ্চ দল, সবার মন ওই সোনার গোলকে। ১৯৯৮ এর পর ২০১৮, কালের গর্ভে বিলীন কুঁড়ি বছর। ফিরে এসেছে ৯৮, ফিরে এসেছে শ্রেষ্ঠত্ব। ফ্রান্স ইজ অ্যা চ্যাম্পিয়ন।
‘ইচ্ছের নীল রং আকাশ ছুঁতে চায়,
সারাবেলা বন্ধ জানালা’
ফরাসির নীল ফানুস উড়ানোর ছায়াপথ বন্ধ রেখেছে ক্রোয়েশিয়া, গোটা প্রথমার্ধ্বেই। বল দখল, পাসিং, আক্রমণ; এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়নি ক্রোয়েশিয়া এর আগে ফাইনাল কী তা জানত না। হায়! সকালের সূর্য দিনের পূর্বাভাস দেয় না! ৬৫ মিনিটে এমবাপ্পের করা শেষ গোলের পর ক্রোয়াট ডিফেন্ডার ভিদার কান্নাটাই বরং হয়ে রইল ম্যাচের সারমর্ম। নীল বিষের পেয়ালায় মৃত্যু ঘটল ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নের।
ম্যাচে প্রথম আক্রমণ শানিত হয় ক্রোয়েশিয়ার পায়ে। তৃতীয় মিনিটে ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডার পাভার্দের ভুলে বল পান পেরিসিচ, পারলেন না। খানিক বাদে ভ্রাসালকোর ক্রস ক্লিয়ার করেন ভারান। নবম মিনিটে স্ট্রিনিচ আরেকবার ঢুঁ মারেন ডিফেন্সে, ফল আসেনি। ১৯তম মিনিটে গ্রিজম্যান আসেন ফ্রিকিক নিতে। তখনো কী এমন হবে ভাবছিলেন? আড়াআড়ি ক্রসটা মানজুকিচের মাথা ছুঁয়ে বল ক্রোয়েশিয়ার জালে। ফাইনালের ইতিহাসে প্রথম আত্নঘাতী গোল! গোলের পর ফ্রান্সের চাইতে ক্রোয়েশিয়া বেশি মরিয়া। ২৮ মিনিটেই দলগত শক্তির সম্মিলনে চোখধাঁধানো গোল ইভান পেরিসিচের। ফ্রি কিকে বল ভিদার কাছে, ভিদা পাস দিলেন পেরিসিচকে। ব্লক করতে সামনে দাঁড়ানো কান্তে। বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বাঁ’পায়ে বল নিলেন, আড়াআড়ি শট। গোল, সমতায় ক্রোয়েশিয়া।
ম্যাচের বয়স ৩৫ মিনিট। কর্ণার করল ফ্রান্স। বল পেরিসিচের হাতে। রেফারি পেনাল্টি দেননি। কিন্তু এ তো একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বকাপ। ভিএআরে রায় আসে পেনাল্টির, গ্রিজম্যানের লক্ষ্যভেদে ভুল হয়নি। আগের দুই বিশ্বকাপে গোল হয়েছে দুটি, ম্যাচের অর্ধেকটা পেরুনোর আগেই এবার তিনটি। প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে কর্ণারে এগিয়ে যেতে পারত ক্রোয়েশিয়া, পারেনি। পিছিয়ে থেকেই বিরতিতে যায়।
Meanwhile in Paris… pic.twitter.com/onrpmfLeKo
— ITV Football (@itvfootball) July 15, 2018
অনেক নাটকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আগ্রাসী ক্রোয়েশিয়া। হার না মানা মনোবলে পুরো আসরে যারা বাহবা পেয়েছে, দালিচ বাহিনী তার ব্যত্যয় ঘটায়নি এইরাতেও। ৪৮ মিনিটে রেবিচের দুরন্ত শট দারুণ এক সেইভ করে দলের লিড অক্ষুণ্ণ রাখেন ফরাসি গোলরক্ষক হুগো লরিস। ৫১ মিনিটে পল পগবা বল দেন এমবাপ্পেকে। গতির ঝড়ে ভিদাকে পরাস্ত করলেও সুবাসিচ রক্ষা করেন ক্রোয়েশিয়াকে। কিন্তু ৫৫ মিনিটে সুবাসিচ আর পারলেন না। কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন থেমে গেছে বিশ্ব। ডি বক্সের বাইরে থেকে পগবার আচানক শটে ৩-১ এ এগিয়ে যায় ফ্রান্স। টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মত আত্মবিশ্বাস হারায় ক্রোয়েশিয়া। সেই সুযোগটাই লুফে নেন এমবাপ্পে। ৬৫ মিনিটে লেফট উইং থেকে হার্নান্দেজের ক্রস, আনমার্কড এমবাপ্পে ক্ষিপ্র শটে বল জালে জড়াতে এতটুকু কাল বিলম্ব করেনি। গোল দিয়েই ইতিহাসের পাতায় তুলে নিলেন নিজেকে। পেলের পর এতদিন আর এত কম বয়সে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল পায়নি কেউ।
৪-১ স্কোরলাইন দেখে ভাবতে পারেন একচেটিয়া খেলা হচ্ছে। হয়েছেও তাই, তবে খেলেছে ক্রোয়েশিয়া! গোলটাই কেবল পাওয়া হয়নি। ৬৯ মিনিটে অবিশ্বাস্য ম্যাচে আরেকখান ভূতুড়ে গোল! উমতিতির ব্যাকপাসে লরিস ধীরেসুস্থে বলটা মারতে চেয়েছেন হয়ত, মারিও মানজুকিচ যে গোল দিতে মরিয়া। তাকে কাটাতে চেয়েও পারেনি লরিস, চমৎকার চিপে খেলায় ফেরান ক্রোয়েশিয়াকে।
এরপর আরো একবার দুর্দান্ত ক্রোয়েশিয়াকে দেখেছে লুঝনিকি। পরাজয় যখন চোখ রাঙাছিল, তারাও উল্টো তাদের দিকে রক্ত চোখে আলোকপাত করেছে। কখনো ডানপ্রান্ত, কখনো বামপ্রান্ত, কখনো মধ্যমাঠ, প্রতি ইঞ্চি জায়গা থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করেছে ক্রোয়েশিয়া। শেষ বিশ মিনিটে লড়াইটা যেন ফরাসি ডিফেন্স বনাম ক্রোয়াট রক্ষণের।
ম্যাচের ৫২ মিনিটে চার দর্শকের মাঠে বিনা নিমন্ত্রণে আগমন। ক্রোয়েশিয়ার ভাগ্যটা কি কেড়ে নিতে এসেছিল ওরা? সম্ভবত ফ্রান্সকে বর দিয়ে গেল। আগামী চার বছরের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তোরা, চারটে গোল দিয়ে কাকতালীয় এক ব্যালেন্সও করে ফেলল দেশমের দল।
পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে যখন মেডেল নিতে উঠল ক্রোয়েশিয়া, আচমকা আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল! যেন বিধাতাও কান্না আটকাতে পারেননি, চেষ্টাটাও করেননি। বৃষ্টির জলে ক্রোয়াট কান্না কিছুটা আড়াল হলে ক্ষতি কি! নাকি ফরাসিদের আনন্দাশ্রু! কে জানে? অভিবাদন, ফুটবলের নতুন রাজা…
ম্যাচসেরা : আঁতোয়ান গ্রিজম্যান (ফ্রান্স)