পশ্চিমা মূল্যবোধের সমর্থকদের সম্পূর্ণ হতাশ করে দিয়ে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে এখন দুটি জনগনের সমর্থন নিয়েই জনপ্রিয় একনায়কতন্ত্র চলছে। একটি হচ্ছে পুতিনের রাশিয়া, আরেকটি হল এরদোগানের তুরস্ক।
প্রবল অস্বস্তি নিয়ে পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই দুই নেতাকে ঢালাওভাবে সমালোচনা করে যাচ্ছেন। আবার এটাও বলতে পারছেন না যে সেখানে কোন রকম গণতন্ত্র নাই। সেখানে ভোট হয়। জনগন স্বাধীনভাবে ভোটও দেয়। তবে এই দুই নেতা সব মাপকাঠি পেরিয়ে ক্ষমতায় চলে আসছেন একাধিকবার। তাদের আপত্তি এই দুই দেশের গণতন্ত্র ঠিক প্রকৃত লিবারেল নয়। এমন অনুদার গণতন্ত্রের সমালোচনা করেই যাচ্ছেন তারা।
এর মধ্যদিয়ে দেখা যাচ্ছে, সারা দুনিয়ার মানুষকে সভ্য করার পাশ্চাত্য মিশন দুর্বল হয়ে পড়া নিয়ে শোক প্রকাশ করেও কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ইতিহাস ও বাইবেলের দোহাই দিয়ে একটি জগাখিচুড়ি দর্শন দাঁড় করাচ্ছেন। তারা ডার্থ ভেডারের মতো মহা খলনায়ক পুতিন থেকে শুরু করে এরদোগান, শি জিনপিং এবং খামেনিকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত।
আর্নল্ড টয়েনবির ভবিষ্যদ্বাণীটা ছিল এমন- ‘ইতিহাস আবার যাত্রা শুরু করছে’। এটারই নতুন রিমিক্সটা বোঝার চেষ্টা করার পরিবর্তে তারা বাকি দুনিয়ার সাথে পশ্চিমের বিরোধের বয়ানের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছেন। ইউরেশিয়া (ইউরোপ ও এশিয়া একত্রে) পুনর্গঠনের শক্তিশালী প্রক্রিয়া বুঝার ক্ষমতা সম্ভবত তাদের নাই। রজব তাইয়্যেব এরদোগান কেন তুরস্কে জনপ্রিয় তা না বুঝতে পারাও এই অক্ষমতারই অংশ।
অনেকে মনে করেন, সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ী হয়ে এরদোগান এখন একজন সুলতান এবং একই সাথে সিইও হিসেবে তুরস্ক শাসন করার জন্য প্রস্তুত। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সম্পর্কিত নতুন নিয়ম এরদোগানেরই মাথা থেকে এসেছে। এর আওতায় দেশটিতে প্রধানমন্ত্রীর কোনও পদ থাকছে না। ২০১৪ সালে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে এরদোগান নিজেই তিন মেয়াদে (১২ বছর) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এরদোগান হয়ত প্রশাসন ও বিচারবিভাগ শাসন করতে পারবেন, কিন্তু আইন প্রণয়নের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট ও ২৯৫টি আসন পাওয়ায় এরদোগানের একেপি দল ১৬ বছরের মধ্যে প্রথমবার পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। তাই তাদেরকে চরম ডানপন্থি এমএইচপি দলের সাথে জোট গঠন করতে হচ্ছে।
এতে অনেকে ভীত হয়ে উঠছেন। তারা ইসলামের নামে অসহিষ্ণু রাজনীতি ও চরম ডানপন্থি ফ্যাসিস্ট রাজনীতির মিশ্রণকে বিষাক্ত জোট হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। তবে বাস্তবতা আরও সুক্ষ্ম। এমএইচপি দল একেপির চেয়েও বেশি পাশ্চাত্যবিরোধী এটা মনে রেখেও সামনের পরিকল্পনা ভূ-রাজনৈতিকভাবে শুধু একটি দিকেই ধাবিত হতে পারে এবং তা হল, ইউরেশিয়াকে কূটনৈতিকভাবে এক করে ফেলা! যত যাই হোক, তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অন্তর্ভুক্ত করার বিঘ্নিত প্রক্রিয়ায় আর নতুন কোন অগ্রগতির সম্ভাবনা নাই। ইইউয়ের কাছে এরদোগান একজন অনাকাঙ্ক্ষিত, অনুদার ও ছদ্ম গণতন্ত্রবাদীর বেশি কিছুই নন। তাকে নিয়ে ইউরোপে একধরণের ভীতি আছে। এই ভীতির অবশ্য ঐতিহাসিক কারণও আছে। সেই আলোচনা অনেক লম্বা। আজ ঐ দিকে যাব না।
তবে ইউরোপের কুর্দিদের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক মনোভাব আছে। কিন্তু সেই টানের কারণে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে স্থান পাবে এমনটা মনে করার কোন কারণ নাই।
কুর্দিদের প্রতি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ওয়াইপিজের বিরুদ্ধে ইউফ্রেটিস শিল্ড ও অলিভ ব্রাঞ্চ -এই অভিযানগুলোর সফলতার পর এই সম্ভাবনা কম। ওয়াইপিজেকে তুরস্ক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখে, এটাকে পিকেকের বর্ধিত অংশ হিসেবে অভিহিত করছে দেশটি। আগে কুর্দিদের দখলে থাকা আফরিন এখন তুরস্কের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এবং দখলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যকার একটি চুক্তির কারণে ওয়াইপিজেকে ‘মানবিজ’ এলাকা ছেড়ে যেতে হবে। এমনকি বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা ছাড়তেই হবে এই ঘোষণা বাতিল করার পরও তুরস্ক সব ধরনের বাস্তব কারণে সিরিয়ায় প্রভাব বজায় রাখতে চাইবে। একই সাথে তারা রাশিয়া ও ইরানের সাথে আস্তানা শান্তি প্রক্রিয়াতেও অংশ নিচ্ছে।
তুরস্কের রাজনীতিতে আগে ডানপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল চলত, কিন্তুু ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সামরিক বাহিনী সবসময়ই পুতুল নাচের অধিকর্তার ভূমিকায় থাকত। ডানপন্থী ধর্মীয় দলকে সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখা হতো, কারণ সামরিক বাহিনী আনাতোলিয়া অঞ্চলে এদের জনপ্রিয়তার কারণে ভীত থাকত। যখন ২০০২ সাল থেকে একেপির রাজনৈতিক বিজয় শুরু হয় তখন তারা ইউরোপপন্থী ছিল। একেপি কুর্দিদের সাথেও সুসম্পর্ক রাখে। কুর্দিরা তাদের সর্বময় গ্রামীণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রক্ষণশীল ছিল। একেপি ও এরদোগান গুলেনপন্থীদের সাথেও জোট গঠন করেছিল। কিন্তু নির্বাচনী এলাকায় পাকাপোক্ত ভিত্তি তৈরির পর সব আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
২০১৩ সালে গাজী পার্ক আন্দোলন দমনটা সম্ভবত বাঁক বদল ছিল। এরপর ২০১৫ সালে কুর্দি সমর্থক এবং বামপন্থী ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টি (এইচডিপি) এসে একেপির ভোট নিয়ে যেতে শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় এরদোগান এইচডিপির সাথে ‘সন্ত্রাসী’ পিকেকে দলকে মিশিয়ে ফেলার একটি কৌশল গ্রহণ করেন। দলটির নেতাদের নিয়মিত জেলে ঢোকানো হয়। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে এইচডিপির নেতা সেলাহাত্তিন দেমিরতাস জেলে থেকেই প্রচারণা চালান। অসংখ্য বাধাবিপত্তির মুখেও এইচডিপি উল্লেখযোগ্য ১১ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট নিয়ে ৬৭টি আসনে জয়লাভ করেছে।
ওয়ান ম্যান রুল বা একজনের শাসন আসলে পুরো দুই বছর আগেই শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর গুলেনপন্থীদের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই আসলে এটা হয়েছিল। এরদোগান ও একেপির নেতারা এখন নিশ্চিত যে গুলেনপন্থীরা ন্যাটোর সহায়তা পেয়েছিল। এরপরে সামরিক বাহিনী থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের সরিয়ে ফেলার যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তা ছিল প্রলয়ঙ্করী, যার শিকার হাজার হাজার মানুষ। সর্বশেষ কয়েকদিন আগে ১৮ হাজার ৬৩২ জনকে সরকারি চাকরিজীবীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এরদোগান কিভাবে ইরাক-সিরিয়ার ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর দোহাই দিয়ে আগাম নির্বাচনকে অপরিহার্য হিসেবে তুলে ধরেছেন তার ওপর জোর দেন তুরস্কের ইতিহাসবিদ কাম এরিমতান। এরদোয়ান বলেন, অনিশ্চিত অবস্থা পার হয়ে যাওয়া তুরস্কের জন্য একান্ত জরুরি। একেপি ও এমএইচপির পিপলস অ্যালায়েন্সকে এরিমতান একবিংশ শতাব্দীর তুর্কি-ইসলামী সমন্বয় বলে অভিহিত করেন। ইরানের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক এখন স্থিতিশীল রয়েছে। রাশিয়ার সাথে জ্বালানি ও সামরিক সম্পর্ক এরচেয়ে ভাল আর কখনো ছিল না। তুরস্ক এখন মধ্য এশিয়া জুড়ে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে পারে। রাশিয়া ও চীন তাদেরকে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) তে যোগ করার জন্য প্রলুব্ধ করছে। এরদোগান হয়ত শেষমেষ তুরস্ককে নতুন সিল্ক রুট বা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ও পাশ্চাত্যের মধ্যে অপরিহার্য সেতু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হবেন। এখন দেখার বিষয় এরদোগান পশ্চিমা ক্লাবের দিকে ধাবিত হবেন না মধ্য এশিয়া খাইবার গিরিপথে সিন্ধু অববাহিকার স্রোতে গা ভাসাবেন।