রূপকথার বালকে কাবু ইংলিশ সিংহ

রূপকথার বালকে কাবু ইংলিশ সিংহ

ক্রোয়েশিয়া ২   – ১ ইংল্যান্ড
পেরিসিচ ৬৮      ট্রিপিয়ের ৫
মানজুকিচ ১০৯

• প্রথমবার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠল ক্রোয়েশিয়া।
• ১৯৮২র পর কখনোই ইউরোপীয় দলের বিরুদ্ধে টানা দুই ম্যাচ জেতা হল না ইংল্যান্ডের। ‘৮২তে তারা হারিয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়া এবং ফ্রান্সকে।
• এবারের আসরে ইংলিশরা গোল করেছে ১১টি। ‘৬৬তেও করেছিল সমপরিমাণ গোল। তবে এবার বিশ্বজয়ের পুনরাবৃত্তি হল না।
• নকআউট পর্বে ক্রোয়েশিয়ার তিন ম্যাচের প্রত্যেকটিই গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে।
• রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার মোট ৮ জন খেলোয়াড় গোলের দেখা পেয়েছেন। কেবল বেলজিয়ামই (৯) তাদের উপরে।

একাদশ…

ক্রোয়েশিয়া : দানিয়েল সুবাসিচ, সিমে ভারসালকো, দেয়ান লভরেন, ডোমাগোজ ভিদা, ইভান স্ট্রিনিচ, মার্সেলো ব্রোজোভিচ, ইভান রাকিতিচ, আন্তে রেবিচ, লুকা মদ্রিচ, ইভান পেরিসিচ, মারিও মানজুকিচ।

ইংল্যান্ড : জর্দান পিকফোর্ড, কাইল ওয়াকার, জন স্টোনস, হ্যারি ম্যাগুইর, কিয়েরেন ট্রিপিয়ের, ডেলে আলী, জর্দান হেন্ডারসন, জেসে লিনগার্ড, অ্যাশলে ইয়াং, রাহিম স্টার্লিং, হ্যারি কেইন।

বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ইংল্যান্ড, বিশ্বকাপকে এবারো সঙ্গে নেয়া গেল না। সোনালি ট্রফিতে চুমু খাওয়ার স্বপ্ন চূর্ণ করে দিল ক্রোয়েশিয়ার সোনালি প্রজন্ম। ফুটবলে সব দলেরই একটা আদুরে ডাকনাম আছে। ইংল্যান্ডের যেমন ‘থ্রি লায়ন্স’, ক্রোয়েশিয়ার ‘ভাত্রেনি’; বাংলায় যার অর্থ ‘রূপকথার বালক’! সত্যিই রূপকথা জন্ম নিল পেরিসিচ-মানজুকিচের পায়ে। যাতে পিষ্ট সিংহের ‘ইটস কামিং হোম গর্জন’।

তার আগে লুঝনিকিতে সম্ভবত সবাই নড়েচড়েও বসেনি! তিন সিংহের ইংলিশরা ক্রোয়েশিয়ার দম্ভে ফাটল ধরায় পঞ্চম মিনিটেই। কিয়েরন ট্রিপিয়েরের নিরীহ দর্শন ফ্রি কিক অতটা আহামরিও ছিল না। তবু জাল ছুঁয়ে যায়, তবু গোল হয়ে যায়। পাঁচ মিনিট শেষেই ইংল্যান্ড এক, ক্রোয়েশিয়া শূন্য! বিশ্বকাপে ট্রিপিয়েরের প্রথম গোল, তাও সেমির মঞ্চে। গোল হবার পর যতটা গতি বাড়ার কথা ছিল ম্যাচে ততটা বাড়াতে পারেনি কেউই। বিচ্ছিন্ন আক্রমণে এদিক ওদিক হয়েছে বল। ২৯ মিনিটে হ্যারি কেইন ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন, দুই দফায়ও কাজে কাজ হয়নি যদিও। পরের মিনিটেই দারুণ এক আক্রমণ রচনা করেন ক্রোয়াট কাপ্তান লুকা মদ্রিচ। সেখান থেকে বল পেয়ে রেবিচ শট নিলেও ইংলিশ ডিফেন্ডার স্টোনস বল ক্লিয়ার করেন। ফিরে আসলে ফের শট নেন রেবিচ, এবার সরাসরি বল যায় গোলরক্ষক পিকফোর্ডের হাতে। ৩২ মিনিটে হেসে লিংগার্ডের নেওয়া শট বারের সামান্য পাশ দিয়ে চলে গেলে আবারো এগুবার সুযোগ হারায় ইংল্যান্ড।

শুরুতেই অনাকাঙ্ক্ষিত গোল খেয়ে থেমে না গিয়ে বরং একটু একটু করে গুছিয়ে নেয় ‘ভাত্রেনি’ ডাকনামের ক্রোয়েশিয়া। মাঝমাঠের দখল নিয়ে বেশ ক’বার সিংহের গোলমুখে হানা দেয় দালিচের শিষ্যরা। ৪৪ মিনিটে রাকিতিচ সুযোগ পেলেও একা একা খেলতে গিয়ে বল হারান। প্রথমার্ধে তাই গোলের দেখা আর পাওয়া হয়নি তাদের।

বিরতির পর ফিরে খেলায় গতি বাড়ায় ক্রোয়েশিয়া। ৬৮ মিনিটে পেয়ে যায় কাঙ্খিত গোল। রাইট উইং থেকে ডিফেন্ডার ভ্রাসালকোর লম্বা ক্রসে পেরিসিচের দূরদর্শী লবে সমতায় ফেরে তারা। যেন সম্বিত ফিরে পায় সুকারের উত্তরসূরীরা। মিনিট দুয়েক পরই সুযোগ যেন পায়ে এসে ভেড়ে পেরিসিচের, বাঁ’পায়ের ক্ষিপ্র শট বেরসিক গোলবারে লেগে সেই যাত্রায় এগিয়ে যাওয়া হয় না। নির্ধারিত সময়ের বাকিটুকুয় ক্রোয়াটরা চেষ্টা করেছে যতভাবে সম্ভব।

খেলার শুরুতেই গোল দেখার পর দর্শক ভেবেছিল জমাট একই ম্যাচই বুঝি দেখতে চলেছে তারা। কিন্তু কিসের কি! উল্টো ইংল্যান্ডের খেলায় চোখের জ্বালা বেড়েছে! ম্যাচের দশম মিনিটে কর্ণার কিক নিতে গিয়ে প্রায় দুই মিনিটের মত সময়ের অপচয় করেছিল অ্যাশলে ইয়াং। পুরোটা সময়ই খেলায় সৌন্দর্য বাড়ানোর চাইতে নষ্ট করায় মনোযোগী ছিল সাউথগেটের দল। এক গোলের লিড ধরে রেখে রক্ষণ শক্ত করা পুরনো কৌশল, সেখানে প্রথমার্ধ থেকেই টাইম পাসের হীন্যমনতা কোনো যুক্তিতেই ধোপে টিকবে না। রসকষহীন ইংলিশদের দৃষ্টিকটু খেলায় প্রলেপ দিতে ক্রোয়েশিয়া খেলেছে পেশাদারিত্ব আর জয়ের তীব্রতা অনুভব করা খেলোয়াড়ি মানসিকতায়ই।

এক্সট্রা টাইমে আবার অন্য রূপে ইংলিশরা। আলি, কেইন, রাশফোর্ডরা মিলে বারবার ভয় ছড়ায় বিপক্ষ রক্ষণে। সাউথগেটের শিষ্যরা নিজেদের রক্ষণ ঠিক রেখে আক্রমণ শানাতে থাকে। আটানব্বই মিনিটে কর্ণার থেকে স্টোনসের জোরালো হেডার বাঁধাপ্রাপ্ত হয় সেকেন্ড বারে মানব দেয়াল হওয়া ভ্রাসালকোর ব্লকে। বাড়তি সময়ের প্রথম অংশে টাইম শেষ হবার একটু আগে কাউন্টার অ্যাটাকে বামপ্রান্ত থেকে পেরিসিচের ক্রসে মানজুকিচ পা ছোঁয়ালেও পিকফোর্ডের দক্ষতায় রক্ষা পায় ইংল্যান্ড। ম্যাচের ৮২তম মিনিটেও মানজুকিচকে গোলবঞ্চিত করেন পিকফোর্ড। লেফট উইং থেকে ব্রোজোভিচের শটে মারিওর জোরালো শ্যুট গোলপোস্টের একহাত সামনে দাঁড়িয়ে চমৎকার সেইভ করেন তিনি।

মানজুকিচ যেন আজ পিকফোর্ডের জন্য রগচটা পরীক্ষকের ভূমিকায় আবর্তিত! একের পর এক চেষ্টায় অবশেষে পরাস্ত হতেই হলো ইংলিশ কিপারকে। ১০৯ মিনিটে বন্ধ হয়ে গেল থ্রি লায়ন্সদের ঘরে ফেরার যানটাও! স্টোনসের ব্লক উপরে উঠলে হেড করেন পেরিসিচ, বেশ চতুরটার সঙ্গে অফসাইডের ফাঁদ ভেঙ্গে বামপায়ের শটে জালে পাঠান বল। পরের দশ মিনিটে চলেছে সাসপেন্সের পালাবদল। কখনো ইংল্যান্ড কখনো ক্রোয়েশিয়া, কখনো পিকফোর্ডের হাতে অকেজো আক্রমণ, কখনে আবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হতাশা!

বেলাশেষে কেউ হাসে কেউ কাঁদে। ঘাসের বিছানায় গা এলিয়ে ইংলিশ অশ্রুজলে ভিজেছে লুঝনিকি, সেটিকেই স্লিপার বানিয়ে মারিও মানজুকিচের স্লাইডিং সেলিব্রেশন। মানজুকিচও কেঁদেছেন, জয়ের কান্না। ক্রোয়াট ফুটবলের প্রেসিডেন্ট ডেভর সুকার কী করছেন? কু্ঁড়ি বছর আগে সেমিতে যাওয়া সেই সোনালি দলকে টপকে কুঁড়ি বছর পর এই প্রজন্ম ফাইনালে। সুকারও নিশ্চয়ই কাঁদছেন! উল্লাসের শিহরণে!

ম্যাচসেরা : ইভান পেরিসিচ (ক্রোয়েশিয়া)