এবারই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি মুসলিম দেশ অংশগ্রহণ করেছে। রাশিয়া বিশ্বকাপে কোন দল গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করতে না পারলেও এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপ মিলে ৭টি দেশ প্রতিনিধিত্ব করেছে মুসলমানদের। ফলে স্বভাবতই এবারের বিশ্বকাপে মুসলমান দেশগুলো থেকে হাজারো মুসলমান ভক্তের সমাগম হয়েছে ইউরোশিয়ার দেশটিতে। কিন্ত ইতিহাস ঘটলে দেখা যাবে রাশিয়ায় মুসলমানদের আগমন এটাই প্রথম না। বরং প্রায় ১৪০০ বছরের মুসলিম ইতিহাস রয়েছে দেশটির। চলুন জেনে নেই, দেশটিতে বসবাসরত বিপুল পরিমাণ মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে নয়টি গুরুত্বপূর্ণ দিক–
দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম
রাশিয়ায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অবস্থান দ্বিতীয়। রাশিয়ায় মুসলমানদের এমন আধিক্যের কারণ হতে পারে প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে রাশিয়ায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের ইতিহাস। মূলত ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পারস্য বিজয়ের পরে রাশিয়ায় ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে মুসলমানদের আগমন ঘটে।
মুসলিম জনসংখ্যা
বর্তমানে রাশিয়ায় মুসলমান বসতি ২ কোটিরও বেশি। যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ। রাশিয়ায় মুসলমান জনসংখ্যা সুইডেন, ডেনমার্ক এবং নরওয়ের সম্মিলিত মোট জনসংখ্যার থেকেও অধিক।
মুসলিম সাম্রাজ্য
ইতিহাসের বিভিন্ন সময় আধুনিক রাশিয়ার বিভিন্ন অংশ একাধিক মুসলমান সম্রাজ্যের অধিকারে ছিল। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গোল্ডেন খানাতে, দ্য সাফাভিদস, দ্য আফশারিদস, দ্য কাযারস এবং অটোমান সাম্রাজ্য। তারা প্রত্যেকেই রাশিয়ায় ইসলামের প্রচার এবং মুসলমান সংস্কৃতির বিস্তারে অবদান রেখেছে।
মুসলমানদের রাজধানী
রাশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত মুসলিম রাজধানী ছিল ‘সারাই’। ১৩০০ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে সারাই রাজধানী ছিল। ইবনে বতুতার মতে, সারাই তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর শহরের একটা। এছাড়া অনেকের মতে আধুনিক রাশিয়ার ইসলামের রাজধানী হচ্ছে কাযান। কারণ কাযানেই অবস্থিত বিখ্যাত কোলসারিফ মসজিদ এবং রাশিয়ান ইসলামিক ইউনিভার্সিটি। এছাড়া কাযানেই রাশিয়ার মুসলমানদের বড় বড় সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। মুসলিম ফিল্ম ফেস্টিভাল, বার্ষিক কুরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতা ইত্যাদি কাযানেই আয়োজন করা হয়।
রাসুলের বংশধর
রাশিয়ায় মুসলমানদের মধ্যে অনেকগুলো বংশ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল দাগেস্তানি। এদের নেতা নিজেকে রাসুলের বংশধর হিসেবে দাবি করেন। তার পরিবারের শিকড় খুঁজতে যেয়ে তিনি খুঁজে পান তার পরিবার ষষ্ঠ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে ইসলাম প্রচার করতে এখানে আসেন। তারা ছিলেন রাসুলের বংশধর।
নিপীড়ন এবং পুনরুত্থান
দু:খজনক হলেও সত্য, রাশিয়ার মুসলমান জনগোষ্ঠী একাধিকবার জুলুম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়। এই দুইশ বছর সময়ে রাশিয়ার অনেক মুসলমানদের জোরপূর্বক দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এছাড়া কমিউনিজমের শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে আরেক দফা নিপীড়িত হয়েছিল মুসলমানরা। কিন্ত রাশিয়া থেকে কমিউনিজিম বিতাড়িত হয়ে যাওয়ার পর আবারো রাশিয়াজুড়ে মুসলমানদের পুনরুত্থান হয়। ১৯৯০-১৯৯৭ সালের মধ্যে মাত্র ৭ বছরে রাশিয়ায় মসজিদের সংখ্যা বেড়ে ১৬০ থেকে ৭ হাজারে গিয়ে ঠেকে। এছাড়া প্রায় ৫ হাজার মুসলিম সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাশিয়া জুড়ে।
মুসলিম প্রদেশ
রাশিয়ায় মোট ৯২টি প্রদেশের মধ্যে ৭টি প্রদেশেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। বাশকরস্থান, তাতারস্তান, দাগেস্তান এবং চেচেনিয়াতেই রয়েছে ১ কোটির বেশি মুসলমান বসতি। শুধু তাই নয়, প্রদেশগুলো স্বায়ত্বশাসিত এবং নিজস্ব রাজধানী ও ভাষা (মূলত তারকিশ ও ককেশিয়ান) রয়েছে।
মসজিদ
রাশিয়ার সবচেয়ে ঐতিহাসিক মসজিদটি হচ্ছে দেগাসতানের দারবানতে অবস্থিত জুমা মসজিদ। মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাছাড়া রাশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদটি হচ্ছে মস্কোতে নির্মিত ক্যাথেড্রাল মসজিদ, যার ধারণ ক্ষমতা প্রায় দশ হাজার। এছাড়া আরো উল্লেখযোগ্য মসজিদগুলো হল কাযানের কোলসারিফ মসজিদ, তাজ মহল মসজিদ, সেইন্ট পিটারসবার্গ মসজিদ ইত্যাদি।
মুসলিমদের মধ্যে খ্যাতিমান যারা
রাশিয়ার বিখ্যাত মুসলমানদের মধ্যে সবার আগে থাকবেন ধনকুবের ব্যবসায়ী এলিসার উসমানভ। বিলিয়নিয়র এই ব্যবসায়ীর আরেকটা পরিচয় হচ্ছে তিনি ফুটবল ক্লাব আর্সেনালের একাংশের মালিক। এছাড়া রয়েছে সাবেক রাশান স্পাই আলেকজান্ডার লিতভিয়েনকো; বক্সার খুসেন বসিনগুরোভ; চেচেন যুদ্ধের ‘বীরযোদ্ধা’ হাদিজাত গাতায়েয়া; এবং টোকিও’র কামজি মসজিতের প্রথম ইমাম, ইসলামিক পন্ডিত এবং অভিযাত্রী আবুরশিদ ইব্রাহিম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।