যারা আমাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালি দিত আজ তারা কই?

যারা আমাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালি দিত আজ তারা কই?

কবি আল মাহমুদ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই তিতাস নদীর পলিবিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আল মাহমুদ বিষয়বৈচিত্র্যে এত ব্যাপক পরিসরে কাজ করেছেন যা সাহিত্যামোদীদের বিস্মিত করে। গল্প-কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া মিলে তাঁর রয়েছে বিপুল রচনাসম্ভার। নানা পেশায় তিনি সক্রিয় ছিলেন। এক সময়ের আলোচিত পত্রিকা দৈনিক গণকন্ঠের সম্পাদক ছিলেন। কবিতায় তাঁর খ্যাতি দেশের গন্ডি ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। পৃথিবীর নানা ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। তাঁর উপর একাধিক গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে। এই কবি, সাহিত্য-চিন্তামূলক প্রবন্ধের জন্যও খ্যাতিমান। তার রচিত অনেক গল্প-উপন্যাস কথাসহিত্যের ভূবনেও তাঁর শক্তিশালী অবস্থানকে বহাল রাখতে অবদান রেখেছে। সোনালি কাবিন নামক এক অভূতপূর্ব সনেট কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা কবিতার আসনে স্থায়ী অসন পেয়ে যান। এই কাব্যগ্রন্থ কবিতাপ্রেমীদের জন্য এক বিস্ময়ের বিষয়। কবিতা-রাজনীতি-জীবনযুদ্ধের এক বিচিত্র লড়াই তিনি জারি রেখেছেন যা তাঁকে সাংস্কৃতিক জগতের আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। এখন তিনি বয়সের ভারে কিছুটা ক্লান্ত। তবুও ২০১৫-এর ২৪ জুন ভোরে তাঁকে অনেক দীপ্ত মনে হল। এখনও প্রচন্ড দৃঢ়তা নিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তর্ক করেন।

 

রেজাউল করিম রনি : মাত্র মনে হয় ঘুম থেকে উঠেছেন! কেমন আছেন?

আল মাহমুদ : জি, ভাল আছি।

 

অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিল, কীভাবে শুরু করব বুঝতেছি না। আচ্ছা, কাব্য হিংসা কথাটা দিয়া শুরু করি। আপনি এটা লিখেছেন একটা বইয়ের উৎসর্গ অংশে। কাব্য হিংসা জিনিসটা একটু ব্যাখ্যা করবেন?

আল মাহমুদ : কাব্য হিংসা হল, প্রত্যেক কবিই তার বন্ধু কবিকে একটু হিংসা করে। একটু ঈর্ষা করে। এটা জন্মগত। এটা কেউ নিবারণ করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। তো এটারই নাম আমি দিয়েছি কাব্য হিংসা। ওখানে আসলে ছিল শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও ফজল শাহাবুদ্দিনের নাম। তারপর লেখা ছিল, আমাদের এককালের সখ্য ও সাম্প্রতিক কাব্য হিংসা অমর হোক।

 

হিংসার কথাই যেহেতু চলে এল আরও একটা বিষয় আপনার নজরে আনতে চাই। আমাদের সমাজে সাম্প্রতিক সময়ে শাপলা-শাহবাগ বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে। নতুন করে এইটা দেখে অনেক আৎকে উঠছেন। কিন্তু সংষ্কৃতি তো বটেই এমনকি কাব্যিক আবহের মধ্যেও এই জিনিস ছিল। কবিতার জগতে এই বিভাজন শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ বাইনারির নামে জারিই ছিল।

আল মাহমুদ : ছিল, কোনো সন্দেহ নেই। ছিল, কিন্তু তার জন্য তো আমরা দায়ী নই।

 

নাহ, দায়ী আপনারা নন। কিন্তু এই বিভাজনের মধ্যে আপনি তো একটি গ্রুপের মধ্যে পড়ে যান। আপনার গ্রুপটি ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা আপনি প্রকাশ্যে বলেনও। কিন্তু এই ‘মুসলিম’ আইডেন্টিটি নিয়া সারা দুনিয়াতে নানান সঙ্কট ও বিতর্ক তৈরি হয়ে আছে। বাংলাদেশেও এটা নিয়ে রাজনৈতিক অবস্থান আছে। মতাদর্শিক বিরোধও আছে। তো আপনি যখন এই মুসলিম কমিউনিটির হয়ে ফাংশন করেন তখন কবি হিসেবে আপনি তাদের প্রতি কী দায়িত্ব পালন করেন?

আল মাহমুদ : এখানে কমিউনিটি বলতে তো বাংলার আধুনিক মুসলিম কবিদের কথা বলতে হবে। আধুনিক সময়ে যারা অন্য ধর্মের তারাও তো একসঙ্গেই কাজ করছে। তো আমার দায়িত্ব আমি কীভাবে পালন করব? আমি তো কবিতা লিখি। আমি তো লড়াই করি না।

 

সমাজের এই বিভাজনের মধ্যে একটা গ্রুপ প্রতীকী অর্থে হলেও তো আপনাকে তাদের প্রতিনিধি মনে করেন? আপনার ইমাজিনেশন, ভাষা, শব্দ, প্রতীক এগুলোতে তারা নিজেদের খুঁজে পান হয়তো। এর তো একটা তাৎপর্য আছে? আপনি দােিরদ্রের বয়ে বা তথাকথিত সেকুলার মূলধারা চাপে সেটা স্পষ্ট করনে নাই হয়তো।

আল মাহমুদ : এটা তো শুধু একটা আদর্শের ব্যাপার নয়, এটা একটা দেশপ্রেমেরও ব্যাপার। দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুযায়ী আমি মনে করি, আমরাই মূলধারা। আমারাই সবকিছু দেখভাল করি। হোয়েন দ্য টাইম কামস, আমরাই বিজয়ী হব। বিজয় আমাদেরই হবে। এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা সৃষ্টি করছি কাব্য ও স্বপ্ন। আমরা তো কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের ব্যাপার দেখছি না। আমার সারা জীবনই দেখলাম কিছু নোংরা লোক আমার বিরুদ্ধে বলে এসেছে। যা অন্যায় এবং মিথ্যে কথা। কিন্তু আমি তো তাদের মাথায় বাড়ি দিতে যাইনি। আমি সহ্য করেছি। সহ্য করে আমার কাজ অর্থাৎ কবিতা লেখা চালিয়ে গিয়েছি। এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। এখনও আমি লিখি। এটাই আমার কাজ। আমি মনে করি আমি সত্য পথে আছি।

 

আপনার একটা কথা একটু কোট করি। আপনি বলেছেন, “উনারা মুক্তিযোদ্ধা নন এটা আমি শক্ত করে বলেছি। মুক্তিযোদ্ধার চেতনা বলে কিছু নেই। লড়াই করলাম আমি আর মুক্তিযোদ্ধার চেতনা হল আপনাদের? এটা হতে পারে না। বাংলাদেশের কোনো লেখক ইনটেলেকচুয়াল মুক্তিযুদ্ধ করেনি। এই সত্য স্বীকার করতেই হবে।” আরও বলেছেন,“ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিতে যারা আছেন ওরা কেউ মুক্তিযোদ্ধা না। বিজনেস-টিজনেস করে খায়” এখন তো চারদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রাজনৈতিক রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে। এবং এরা সংস্কৃতির জগৎ থেকে ক্ষমতার জগতে এসে পড়েছেন। ভিন্ন চিন্তার বা অবস্থানের সুযোগ সমাজে সীমিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। তো সাংস্কৃতিকভাবে তাহলে আমাদের এইসব লোকদের পজিসনের একটা ফাঁকি আছে। এখন চেতনা সন্ত্রাস অবশ্য এদের উদাম করে ছেড়ে দিছে । এই অবস্থা নিয়ে এখন আপনি কী বলবেন?

আল মাহমুদ : দেখেন, যা সত্য, যার বুকের মধ্যে ট্রুথ আছে তার জন্য এটা কোনো সমস্যা নয়। সত্য এলে অসত্য পালিয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক। অসত্য পরাজিত হয়। আমার বিশ্বাস আমরা সত্যের পথে আছি এবং সাহসের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছি। এত কিছু বলার পরও আমরা পরাস্ত হইনি। পরাজয় স্বীকার করিনি। যারা আমাদের বিরুদ্ধে বলেন তারাই নানানভাবে আজ বঞ্চিত হচ্ছেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের বিশ্বাস ও আদর্শ নিয়ে টিকে আছেন। আমি মনে করি তারা ভালোই আছেন। তাদের অবস্থান দৃঢ়। তাদের কোমরে শক্তি আছে। তারা দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি তো বলেছি, ওরা মুক্তিযোদ্ধা না। ওরা কারা? কারা মুক্তিযোদ্ধা? মুক্তিযোদ্ধা হলে তো আমার পাশেই থাকত। আমি তো মুক্তিযুদ্ধের ফ্রন্টেই ছিলাম। মোটিভেশনে ছিলাম। লড়াই করেছি। মিথ্যা দিয়ে সত্য ঢাকা যায় না।

 

আপনি বারবার বিশ্বাসের কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে, আপনার একটি প্রবন্ধ ‘আমি ও আমার কবিতা’য় আপনি নাস্তিকতা নিয়ে কথা বলেছেন। বলেছেন, ‘কোন কালেই নাস্তিকতার উপর মানবতন্ত্র দাঁড়াতে পারে না।’ কিন্তু আধুনিককালে মানবতাবাদী ধারার একটি বড় অংশই এই নাস্তিকতা চর্চার সঙ্গে জড়িত। তারা ধর্মকে যুক্তির বিচারে পশ্চাৎপদ মনে করেন। একটা সেক্যুলার আদর্শের সঙ্গে বাংলাদেশে ধর্মের বিশেষ ভাবে বললে, ইসলাম ধর্মের একটা আদর্শিক লড়াইও জারি আছে। আরও একটু পরিষ্কার করে যদি বলেন?

আল মাহমুদ : আপনি দেখেন, হিউম্যান নলেজ বা সমস্ত মানবিক শক্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে আস্তিকতার ওপর। নাস্তিকতা তো নেগেটিভ একটা বিষয়। বেশিরভাগ নাস্তিকদের দেখবেন সারা জীবন নাস্তিকতা করেছে কিন্তু মৃত্যু যখন কাছে এসেছে তখন বলছে, হায় আল্লাহ আমাকে মাফ করে দাও! বিশুদ্ধ নাস্তিকতার ওপর মানবতন্ত্রের সৌধ দাঁড়াতে পারে এমন তত্ত্বকথার ঘোর বিরোধী আমি। দেখবেন নাস্তিকতায় উৎসাহদানকারী কমিউনিজম এখন সাম্রাজ্যবাদীদের মতোই পারমাণবিক মারণাস্ত্রসজ্জিত এক আগ্রাসী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ভূমিকা দালালের ভূমিকার মতো রয়ে গেছে। সাম্রাজ্যবাদকে ডেকে আনায় ভূমিকা নিচ্ছে এরা। এসব কথা এখন অল্প বয়সী কবি-সাহিত্যিকরাও বুঝতে শুরু করেছে। এখন আর এত কষ্ট করে বোঝাতে হয় না। যারা বোধবুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে নাস্তিকতা চর্চা করে তা করুন। আমি তাদের পক্ষে নই। আমি আস্তিকদের পক্ষে।

 

বাংলাদেশে আস্তিকতা-নাস্তিকতা কেবল একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় নেই এখন। এর সঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজনের প্রশ্নটিও জড়িত। বিশেষ করে শাহবাগের পর নাস্তিকতা ও আস্তিকতার একটি সমাজিক-রাজনৈতিক অর্থ তৈরি হয়েছে। এই যে আপনি টুপি পরে আমার পাশে বসে আছেন এর একটা রাজনৈতিক পরিচয়ও তৈরি হয়ে গেছে। বিখ্যাত চিন্তক সাবা মাহমুদ যেভাবে বলেন, ‘পলিটিকস অব পাইটি’। বিশেষ করে ‘ওয়ার অন টেররের’ পর এটা আরও পরিস্কার হয়েছে। ধর্মের সিম্বল রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশে নাস্তিকতার একটি সামাজিক অর্থ মানুষ এতো দিনে বুঝে গেছে। প্রগতিশীলতার নামে এরা যা করে তা চরম পারভারসন আকারে হাজির হচ্ছে। যাকে বৃহত্তর সমাজে খুব নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। অনৈতিক মনে করা হয়। আপনি নাস্তিকতা বা আস্তিকতার প্রশ্নে কি মুসলমানদের কথা বলছেন? মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের একটি দিক কিন্তু এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সামাজিকভাবে হাজির হয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে ব্যাপক মেরুকরণ তৈরি করেছে। ফলে এই প্রশ্নটির একটি সামাজিক ও মতাদর্শিক জায়গাও কিন্তু আছে! আমার প্রশ্ন হল আপনি যখন বলেন আপনি আস্তিকদের পক্ষে তখন কিন্তু একটি রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যায়। এটাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই যে ধারাটার আপনি প্রতিনিধিত্ব করেন এরা তো বর্তমানে জারিমান ‘মূলধারার’ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আজও তেমনভাবে হাজির হতে পারেনি? বা মূলধারা নামের এই জনবিরোধী এলিটিজমকে চিরতরে বিনাশ করা সম্ভব হয়নি। একটা অসমতা কিন্তু দেখা যাচ্ছে। তো আপনার এই বিলংগিং কমিউনিটি বা পলিটিক্যাল কমিউনিটির প্রতি আমার দায়িত্বের কথাটা বলেন একটু?

আল মাহমুদ : ঠিক ধরেছেন। শোনেন, এই কমিউনিটি কোণঠাসা হতে পারে কিন্তু আদর্শের দিক থেকে তারা শক্তিহীন নয়। তারা তাদের আদর্শের জন্য সবসময় জীবন দিয়ে আসছে। এই আদর্শগত লড়াইটা টিকে আছে। যেহেতু আমরা আছি তাই এটা টিকে থাকবে। আমরা আস্তিকরা, বিশ্বাসী মানুষরা আছি। ফলে লড়াইটা টিকেও আছে। আমরা যদি না থাকতাম তাহলে আস্তিকতা পরাজিত হতো। নাস্তিকতা বিজয়ী হতো। কিন্তু নাস্তিকতা আল্লাহর রহমতে বিজয়ী হয়নি। তারা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না আমরা জিতেছি। লড়াই চলছে।

 

কবি হিসেবে আপনার বিশ্বাসের জগতের সঙ্গে কাব্যিক সম্পর্কটা কেমন?

আল মাহমুদ : এ তো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িতই আছে। আমার বিশ্বাস আমার কবিতার মধ্যে দীপ্তি ফেলবেই। তবে আমি যখন কবিতা লিখি তখন একটা গভীর বিশ্বাস আমাকে স্পর্শ করে, আমার গায়ে হাত রাখে। বিশ্বাসের একটা দ্যুতি, একটা স্পর্শ, একটা আলো সব সময় মানুষ হিসেবে আমার সারা শরীরে খেলা করে।

 

আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘বিষয়ী দর্পণে আমি’ কবিতায় একটা লাইন আছে, ‘জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে যেন এক শিশু আর পশুর বিরোধ’ -এই বিশ্বাসীর শরীরে শিশু ও পশুর বিরোধ কেমনে মীমাংসা হয়?

আল মাহমুদ : সম্পূর্ণ কবিতাটা পড়লেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন। এখন হয়তো আর অগের মতো সেভাবে আমি বলি না কিন্তু একটা বিরোধ তো আছেই। শিশু আর পশুর বিরোধ। একটি নিরুপায় অবস্থার সঙ্গে একটি সগর্ব সামন্তবাদী রাজার যে আচরণ সেটা তো আছে।

 

কবি হিসেবে আপনার রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন-অভিজ্ঞতা। এখন এত পথ পেরিয়ে এসে এটাকে কীভাবে দেখেন?

আল মাহমুদ : একটা কথা আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে, আমরা অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করিনি। আমরা গরিব ছিলাম। তখনও আমরা গরিব ছিলাম, এখনও আমরা গরিবই আছি। হ্যাঁ, আমরা কোনো অবৈধ রাস্তায় যাইনি। আমরা সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। আমাদের নামে নানা দুর্নাম করা হয়েছে। আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালি দেওয়া হয়েছে। আমাদের সামনে, আমাদের মুখের ওপর নানান কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতে আমরা ঘাবড়ে যাইনি। আজ কই তারা? যারা আমাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালি দিত, আজ কই তারা? দেখেন, তাদের কোনো চিহ্নও নেই। কিন্তু আমরা তো আল্লাহর রহমতে আছি।

 

অন্য প্রসঙ্গে যাই, ফ্রেডারিক নিৎসের মতো আপনিও বলেন, স্বপ্ন দেখানো কবির কাজ।

আল মাহমুদ : হুম, আমার কাজ কী? আই অ্যাম এ পয়েট। আমাকে দেখে লোকে বলেন, এই তো কবি! এই যে আমি। আমার কাজ কী? আমার কাজ হল, আমার জাতিকে স্বপ্ন দেখানো। সুখের স্বপ্ন, সৌভাগ্যের স্বপ্ন, আনন্দের স্বপ্ন। এটা আমার কাজ ছিল। সারা জীবন এই কাজটাই তো করেছি।

এই ‘জাতি’ বলতে তো আর একরকম মানুষ নেই। এর মধ্যেও তো নানান ভিন্নতা আছে? গোত্র আছে? শ্রেণী আছে, চিন্তা ও মতের পার্থক্য আছে। এই ভিন্নতার সংঘাতও আছে। তো এই যে মতাদর্শের ভিন্নতা এর মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারও আছে। আমার অবজারভেশন হল, আল মাহমুদ যদি কোন রাখডাক না রেখে অবস্থান নিতেন তাহলে আরও ভাল হতো। এত ধোঁয়াশা তৈরি হতো না। সেটা যে দলই হোক। আমাদের এখানে কবি-সাহিত্যিকরা নিরপেক্ষতার নামে আওয়ামী পক্ষ-বিএনপি পক্ষই তো করে। তো এটা ঘোষণা দিয়ে খোলাখুলি হলে সমস্যা কি? নাগরিক হিসেবে তো যে কোন দল করার রাইট মানুষের আছে। আপনিই তো বলেছেন, কবি গাছের মতো। শেকড় থাকে মাটিতে কিন্তু ঝড় এলে নানা দিকে হেলে দোলে। কবি তো কবিই। কিন্তু এই বিভাজনের ভেতর নিজের পজিশন স্পষ্ট করা দরকার। তাতে রাজনীতির প্যাঁচ সহজ হয়। নিজের ভূমিকার পলিটিক্যাল পটেনশিয়ালিটি বা রাজনৈতিক শক্তিটা সমাজের কাজে লাগে। সুশীল সেজে তলে তলে দলের সাথে আশনাই করার চেয়ে এটা ভাল। আপনি এটা ভালোভাবে করতে পারলে আরও ভাল হইত বইলা আমার মনে হয়। যেহেতু আইডেন্টিটির জায়গা সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত। তাই গোপনে ফুসফাস না করে এটা ওপেন করা দরকার। তাইলে কালচারাল রাজনীতিও পোক্ত হয়। আর লেখালেখি তো নিজের প্যাশন ও অন্তরের ব্যাপার। এর সাথে রাজনীতির সম্পর্ক আছে বিরোধ নাই।

আল মাহমুদ : আমি আপনাকে খোলাখুলি বলি, আমি পোয়েট। আমি একজন কবি। আই এম এ পোয়েট। আই এম নট এ পলিটিশিয়ান। আম কোনো রাজনীতিক নই। তবে আমি রাজনীতিক না হলেও রাজনীতি সম্বন্ধে অজ্ঞও নই। আমি এই দেশের পলিটিক্স সম্পর্কে খুবই ভাল করে ওয়াকিবহাল। কিন্তু আমি নিজে রাজনীতি করি না। এটাই আমি বলতে চেয়েছি।

 

‘কবিতা ইমেজ ক্যারি করে, আর ইমেজ ভিশন বহন করে’ -দার্শনিক হাইদেগার বলেন। সেদিক থেকে তো কবিতা জিনিসটা অনেক বেশি রাজনৈতিক। সম্ভবত আধুনিক মানুষ কবিতার শক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত হতে পারেনি। আপনি কী বলেন?

আল মাহমুদ : আপনার কথা অনেকটাই ঠিক। আপনার সঙ্গে আমি একমত। তবে কবিকে সব দেশেই সব জাতি একটু আলাদা চোখে দেখে। একটু আলাদা দৃষ্টিতে দেখে। লোকে বলে এই হল আমাদের কবি। কবি মানে হল… কবি শব্দটা আসছে কোবিদ শব্দ থেকে। যার অর্থ হল, কোবিদ মানে জ্ঞানী। তো যিনি কবি তিনি জ্ঞানী। যিনি জ্ঞানী তিনি কবি। তো কবি বা জ্ঞানী বলেন আমরা শুনি। এই হল কবি। কবি সবসময় বলেন। কাব্যের কথা বলেন। সংগীতের কথা বলেন। কখনো গদ্যেও বলেন। কিন্তু তার ভাষা আলাদা। বাস্তব সমাজ থেকে একটু ভিন্ন ভাষায় তিনি কথা বলেন। শব্দচয়ন করেন মানুষের আত্মার ভেতর থেকে। এই যে কবির একটা স্বতন্ত্র অবস্থা এটা স্বীকার করে নিতে হবে। সমাজে কবি না হলে চলে না এমন তো নয়। অনেক সমাজ আছে যেখানে কবি জন্মাননি। একজন কবির জন্য কী আকুলতা তাদের! তো আমি যেটা বলি সেটা আপনি চিন্তা করে দেখেন, কবি কী করেন, কবি তার জাতির জন্য স্বপ্ন সৃষ্টি করেন। সুখের স্বপ্ন, প্রেম, প্রীতি, আনন্দ ও ভালোবাসার স্বপ্ন তৈরি করেন। এটাই হল কবির কাজ।

 

একটা জনপ্রিয় ব্যাখ্যা হল, আল মাহমুদ মানে আধুনিকতায় লোকজ উপাদান। এই আধুনিকতার নানান সমস্যা এতদিনে পরিষ্কার। আধুনিকতা নিয়ে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই।

আল মাহমুদ : প্রথম কথা হল, আধুনিকতা কত বছরের? একটা কথার কি জবাব দিতে পারবেন? এই যে আধুনিক কবিতার কথা বলা হচ্ছে, এর বয়স কত? একশ’ বছর। তো একশ’ বছর তো পার হয়ে গেছে। এখনও কি এটা আধুনিক আছে? তাহলে? কবিতা কবিতাই। কবিতার কোনো আধুনিকতা নেই।

 

আধুনিকতা নিয়ে তর্ক বহু পুরনো। এটা একটা পশ্চিমি সভ্যতার বা গ্রিক-খ্রিস্টান সভ্যতার ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছে। পরে প্রযুক্তির উন্নয়নের ভেতর দিয়ে এটাকে ইউনিভার্সাল করে হাজির করা হয়েছে। এতে প্রত্যেক লোকাল বা স্থানীয় অর্গানিক চিন্তা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এর একটা মোকাবেলার জায়গাও কিন্তু শক্তভাবে জারি রয়েছে। উপনিবেশবিরোধী চেতনাতেও এটা উৎসাহ দেয়। তো যারা এই আধুনিকতাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছে এবং এটার জন্য প্রতিযোগিতা করেছে তার একটা কাব্যিক অহংকে পেয়েছে কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়েছে আমাদের অর্গানিক সম্পর্কের সূত্র থেকে। আধুনিকতার সর্বগ্রাসী রূপ তো মানুষকে এক ধরনের দাসে পরিণত করে। অনেক বড় বড় দার্শনিক আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়েছেন। আমাদের এখানে বরং এটাকে আদর্শ ধরে নিয়ে মারামারি শুরু হয়েছে। এর মধ্যে আবার কলকাতার সংস্কৃত সাহিত্যজাত রুচির শাসনও কিন্তু ডমিনেন্ট ছিল। আমাদের কবিতায় একটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এটা এখন কাটছে কিছু কিছু করে। তো যারা এই আধুনিক হতে গেছে তারা তো অতীত হয়ে যাচ্ছে। আর যারা দেশ-মাটি নিয়ে পড়েছিল তারা তো এখনও নতুন নতুন আবহে ফিরে আসছে। আধুনিকতার চূড়ান্ত বিকাশের ভেতর দিয়ে আপনি কবি হয়ে উঠেছেন। আপনার কালের কবিরা অনেকে টিকে নেই। আপনি আছেন।

আল মাহমুদ : হা হা হা… এখন তো উত্তরাধুনিক কাল। দেখেন, বাংলা কবিতার যেটা মূল ধারা বা যেটা সাম্প্রতিক স্রোত, এর ক্ষতি করার মতো কোন ব্যক্তি বা কোন ধারা নেই। আমি তো দেখি না। আমি তো দেখি কবিতা কবিতার গতি নিয়ে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষায় অনেক বড় কবিরা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও ত্রিশের কবিরা আছেন। ত্রিশের কবিদের বৈচিত্র্যময় রচনা আছে। এদের রচনা ভালো করে পাঠ করলে এদের রচনার যে বৈচিত্র্য সেটা আপনার কাছে ধরা পড়বে। এত সুন্দর। আর আছে ছন্দ। বাংলা ছন্দের বিবর্তন এটা একাডেমিক ব্যাপার হতে পারে কিন্তু এটা তো কবিরাও পড়েন। “আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি, তবুও কেন মুখ বুজে আছো মিছে ছলে, কোথায় পালাবে? ধু ধু করে মরু ভূমি, ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।” আজি দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই, নির্বাক নীল, নির্মম মহাকাশ…

ধরুন, আমি তো বুড়ো মানুষ, বয়স আশি হয়ে গেছে, স্মৃতি তো আগের মতো নেই। যা মনে আছে তাই থেকে বলছি।

 

তিতাস পাড়ের আল মাহমুদের সঙ্গে নাগরিক আল মাহমুদের সংগ্রামটা কেমন?

আল মাহমুদ : সেই অর্থে কোন সংগ্রাম নেই। আমি এই দেশে জন্মেছি এই দেশের ভাষায় কবিতা লিখেছি। আমাকে যদি আপনি আধুনিক বলে স্বীকার করেন তাইলে সবটাই আধুনিক।

 

আমি গ্রাম-শহর অর্থে বলছি না। কিন্তু আধুনিক কবিতার অনেক বৈশিষ্ট্যের একটি হল এটা উম্মুল। আপনার কবিতা তো গ্রাউন্ডেড। প্রশ্নটা কি করতে পারছি?

আল মাহমুদ : বুঝছি। শোনেন, কবিতায় আমি কিছু নতুন উপাদান যোগ করেছি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে কাজের আগেই আমি কিছু উপাদান যোগ করেছি। আমি মনে করি ভাষা জীবন্ত হয় আঞ্চলিকতা দিয়ে। তার একটা আঞ্চলিকতা থাকে। সেখানে অসংখ্য শব্দ থাকে। সব শব্দ আমরা সাহিত্যে ব্যবহার করি না। আমরা যে করি না, এই আমরা কে? আমরা কি বিচারক? আমরা কেন এসব শব্দ ব্যবহার করি না। যেমন ধরেন আপনি বলেন, কলস একটি শব্দ। এই জিনিসটি আরও একটি শব্দ দিয়ে বলা হয়। আমরা কলস না বলে ঠিল্লা বলি। তো ঠিল্লাটা আপনি ব্যবহার করেন না কেন? ঠিল্লার অপরাধটা কী? এই যে ভাষার অর্ধেক ব্যবহার করলেন আর অর্ধেক ব্যবহার করলেন না এইটা ধরিয়ে দিয়েছেন কে? এটা ধরিয়ে দিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এই সেই শহীদুল্লাহ যিনি সংস্কৃত ভাষায় তার থিসিস জমা দিয়ে ব্রাহ্মণদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। মুসলমান ছেলে সংস্কৃত ভাষায় থিসিস দেয় এ তো বড় পন্ডিত! সেই সময়টা চিন্তা করতে হবে। সেই সময়টা কেমন ছিল? তখন ভিসি ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন, আশুতোষ মুখার্জী। তিনি বাস্তবিক অর্থেই অনেক পন্ডিত ব্যক্তি। উদার ছিলেন। তো এসব তো জানতে হবে। ইতিহাস না জানলে তো হবে না। আমাদের ভাষার বয়স কত? হাজার দেড়েক বা দুয়েক হবে। এগুলো নিয়ে চর্চা করতে হবে।

 

অনেকে বলেন জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দের একটা সম্মিলন ঘটেছে আল মাহমুদে?

অাল মাহমুদ : এটা অনেকে বলেন। আমি তার প্রতিবাদ করিনি। এর প্রতিবাদ করেছেন…নামটাই ভুলে গেছি। বিখ্যাত লোক। আহ, নামটাই ভুলে গেছি। যাক আমি বলব বরং এর উল্টাটা হয়েছে, জসীমউদ্দীন এবং জীবননান্দ আমি নই। আমি জসীমউদ্দীন উত্তমভাবে পড়েছি। উনার যেটা কাজ সেটা প্রবন্ধ লিখে আমি সমর্থন করেছি। জসীমউদ্দীন বলেছেন, সে আসিবে কাল মুখখানা যার নতুন চরের মতো। এই হল জসীমউদ্দীনের প্রধান গুণ। আগে বলা হতো প্রেয়সীর মুখ চাঁদের মতো। কিন্তু জসীমউদ্দীন প্রথম এসে চাঁদের সঙ্গে না দিয়ে চরের মাঝির সঙ্গে প্রেয়সীর মুখের উপমা দিলেন। অনেকে অনেক সমালোচনা করেন জসীমউদ্দীনের। কিন্তু তিনি তো আছেন। আপনি ইচ্ছে করলেই তাকে সরাতে পারছেন না। তিনি ক্ষেতের আইলের পাশে জমে থাকা পানির মতো রয়ে গেছেন। আপনি চাইলেই তিনি নাই হয়ে যাচ্ছেন না। তিনি আছেনই। আর জীবনানন্দ আধুনিকতাকে পাঠ করেছেন বিদেশি পুস্তক থেকে। তারপরও আমি জীবনানন্দের কাজকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। শ্রদ্ধাও করি। এবং শেষদিন পর্যন্ত তার পরিবারের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। তার মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ আমার কাছে আসত। যাই হোক, সে অনেক কাহিনী। তার কবিতার সঙ্গে তার পরিবারের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তা তো কবির সম্পর্ক। আমি কবি মানুষটাকেও দেখি তার কবিতাকেও দেখি।

 

আপনি এক জায়গায় বলেছেন, ‘আমি গ্রাম্য নই কিন্তু আমার চিন্তার বিষয় হল গ্রাম’। এই যে চিন্তার বিষয় এবং বিষয়ীকে আলাদা করা এই যে সাবজেক্ট ও অবজেক্টকে আলাদা করা এটা আধুনিক জ্ঞানতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এনলাইটমেন্টের পরে বিশেষ করে দেকার্তের পর এটা প্রভাবশালী হয়েছে। এর একটা সমস্যা তো আছেই শেষ পর্যন্ত?

আল মাহমুদ : আমি নাগরিক মানুষ। আমার চিন্তার বিষয় হল গ্রাম। তো আপনি কী করবেন এখন? দেখেন, আধুনিকতা থাকুক বা না থাকুক আধুনিকতা এখন নেইও। সেই সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু একজিস্ট করে কী? একজিস্ট করে কবিতা। কবিতায় কবিতা থাকতে হবে। আধুনিক হওয়াটা হল আপনার আরোপিত বিষয়।

 

বাংলাদেশে শিল্প-সাহিত্য একটি সেক্যুলার চর্চার বিষয়। বিশেষ করে বাম প্রগতিশীলতার সঙ্গে এর সম্পর্ক শক্ত। এর বিপরীতের শক্তির একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছেন আল মাহমুদ। এর সঙ্গে আপনার একটা লড়াইও আছে। যদিও আপনি যে পরিমাণ গুরুত্ব ধারণ করেন এসেনশিয়ালি তা আপনি যে পরিপ্রেক্ষিত থেকে কথা বলেন তার চেয়ে অনেক অনেক পাওয়াফুল। এটা হয়তো আপনার মধ্যে এমনি হইছে। এটা খেয়াল করেছেন কি না জানি না, আপনি বলেন আধুনিকতার কথা বাট আপনি এই বেরিয়ার অতিক্রমকারী কবি…

আল মাহমুদ : দেখেন, আপনি যেটাকে লড়াই বলছেন এর কোন যদি দার্শনিক ব্যাখ্যা দিতে হয় তাইলে আমি বলব, লড়াইটা তো আজকের নয়। এরও একটা ইতিহাস আছে, খুব প্রাচীনতা আছে। সেই লড়াইয়ের ঐতিহাসিক সময়ের গতিকে ধরে রেখেই চলছে কিন্তু, হোয়েন দ্য টাইমস কাম…সামনে আরও সময় আছে। চিন্তা, বিবেচনা, লড়াই এগুলো দ্বারা নির্ধারিত হবে। এর ভেতর দিয়েই দার্শনিক বিষয়টি মীমাংসা হবে। এই মীমাংসা যদি নাও হয় একটা জিনিস ঘটবে আধুনিক সভ্যতার এমন এক পরিণতি হবে যে, মানুষ আধুনিক শব্দটা আর ব্যবহার করবে না। সবকিছুর পর কবিতার বেলায় বলতে হবে কবিতা তো কবিতাই, তার আবার আধুনিকতা কী? দেখেন, এক সময় কলকাতার কি প্রভাব ছিল? এখন কলকাতা কই? নেই, কোনো প্রভাব নেই। কলকাতা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

 

আপনি অনেক কবিকে লিখে প্রশংসা করেছেন। এক ধরনের সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তো আপনি যাদের অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করেছেন তারা তো কবিতায় নেই। এত দিনে দেখা গেল আপনার সার্টিফিকেট নিয়েও তো কেউ কবি হইতে পারল না। এটা দেওয়ার তাৎপর্য কি? তাদের তো দেখা যাচ্ছে না এখন?

আল মাহমুদ : এটা হল প্রতিভার লড়াই। খুব নিষ্ঠুর। যদি এদের মধ্যে কোনো বড় কবি আসতেন তাহলে এ কথা আপনি বলতেন না। আপনার বিচারে মনে হচ্ছে এদের মধ্যে বড় কবির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস এদের মধ্যেই বড় কবির সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি তর্কে, পদ্যে, গদ্যে তার আদর্শের লড়াই দিয়ে যেমন আসবেন তেমনি বিজয়ের পতাকা নিয়েও আসবেন।

 

আপনি একটু আগে বলছিলেন কবিরা জ্ঞানী। চিন্তক। কিন্তু বাংলাদেশে কবিরা তো চিন্তক হিসেবে খুব হতাশাজনক নজির রাখছেন। বলে রাখি, একজন কবি আর একজন চিন্তক বা দার্শনিকের চিন্তা করার ধরণের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে যদিও। বাংলাদেশে চিত্রটা হস্যকর…

আল মাহমুদ : এটা একটা বাজে কথা।

 

নাহ, আমি আবার প্রশ্নটা করি, এখানে কবিরা তো দেখি নানান গ্রুপ করে। সুবিধা নেয়ার জন্য নানান দলেও হাজির হন। নিজের কাব্যপ্রতিভা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রিতে স্থান পাওয়ার হিংসায় লিপ্ত হন। কবি হয়ে ওঠার চেয়ে কবি আকারে পারফরমেন্সের দিকে বেশি মনযোগ দেখা যায় এখানে। কোনো ক্রিটিক্যাল চিন্তার মধ্যে না গিয়ে সমাজের মূলধারায় হাজির হতেই এরা মরিয়া হয় এটা তো আর উন্নত চিন্তার পরিচয় হল না। কোনো ডিভাইন পোয়েটিক জার্নি না করে সে কবিতাকে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর চেতনার হাতিয়ার বানিয়েছে। কাউকে মৌলবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে নিজেরা প্রগতিশীল-মৌলবাদী হয়ে উঠছে। এটা তো আর চিন্তাশীল আচরণ নয়। কবি তো সব হিংসার বাইরেও, সব কনভেশনাল পথের বাইরে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?

আল মাহমুদ : দেখেন, প্রকৃত কবি যখন সমাজে উদিত হন তিনি কিন্তু শুধু ভাষারই অগ্রভাগে থাকেন না। সব কিছুরই অগ্রভাগে তাকে দেখা যায়। প্রথম কথা হল কবিকে তার দেশ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। দেশপ্রেমটা বুঝতে হবে। থাকতে হবে। কবি তার জাতির সুখ-দু:খ বুঝতে পারেন। কিসে তার জাতি শিহরিত হয় তা জানেন। কিসে সুখ পায়, দুঃখ পায় তাও বোঝেন। এটা কবিই একমাত্র বলতে পারবেন। কবির কাছে মানুষের অনুভূতির একটা ভাণ্ডার আছে। তার কেন্দ্রে কবি বসে থাকেন। একটা কথা আছে বুঝলেন, পরাজিত হয় না কবিরা। কবিরা কখনও ডিফিটেড হয় না।

 

আপনি তো প্রচুর গল্প-উপন্যাস লিখছেন। ধরে ধরে কথা বলার সময় হয়তো আজ পাব না। তাও একটু বলি, অনেকের একটা কমন দৃষ্টিভঙ্গি হল আপনি যৌনতার অবাধ আশ্রয় নিয়েছেন এসব গল্প-উপন্যাসে। যৌনতা প্রবল।

আল মাহমুদ : পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কি আপনি পড়েছেন যার মধ্যে যৌনতা নেই? বলতে পারবেন?

 

অনেক অনেক উদাহরণ আছে, একজনের কথা বলি, জালালউদ্দিন রুমির কথা বলতে পারি। অনেক লেখা আছে যৌনতার নাম-গন্ধও নাই।

আল মাহমুদ : হা হা হা। রুমি আপনি পড়েছেন বলছেন, তার একটা পরিচ্ছেদ আছে সেটা হল ইশক। ফানা-ফিল্লাহ হয়ে যাওয়া। সেখানে দেখেন কিসের মধ্যে ফানা-ফিল্লাহ। সেখানে তো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে মানুষের যৌন ইচ্ছে। যৌনতাকে আলাদা করে দেখারই তো কোন দরকার নেই। আমি পুরুষ বা নারী যাই হই আমাদের সম্পর্ক তো যৌনতার দ্বারা বিচার হবে।

 

ফানা-ফিল্লাহর সঙ্গে যৌনতার কোনো সম্পর্ক নাই। যা হোক বেয়াদবের মতো তর্ক করব না। অন্য কথা বলি, আপনি তো এখন পড়তে পারেন না। কিন্তু আপনার তো অনেক পড়ার অভ্যাস ছিল এখন এটা ম্যানেজ করেন কীভাবে?

আল মাহমুদ : পড়তে চাই। কিন্তু পারি না। অনেককে বলি, পড়ে শোনায়। এই যেমন আপনি আপনার কিছু কবিতা শোনালেন। বেশ ভালো লাগল। আরও লিখবেন। সে রকম লোক আমার আছে। এখনও আমি লিখি। ডিটেশন দিয়ে লেখাই। সেই লেখা ছাপা হয়। সেটা নিয়ে আলোচনাও হয়। এখনও সক্রিয় আছি।

 

আপনার অক্লান্ত লেখালেখি অনেককেই বিস্মিত করে। জয় গোস্বামীর মতো কবিও আপনার কাছ থেকে প্রেরণা নিতে আসেন। এর রহস্যটা কী?

আল মাহমুদ : আমি লিখি। আপনি জানেন, আমি পেশায় সাংবাদিক ছিলাম। আপনিও তো সাংবাদিক। জানেন তো সাংবাদিকদের খেটে খেতে হয়। আমি তো মুখে বললে হবে না। যা বলছেন তা লিখে প্রকাশ করতে হবে। আমার জীবন কেটেছে সাংবাদিক হিসেবে। আমি ভাত খেতাম সাংবাদিকতা করে। আর কবিতা-টবিতা এসব হল আমার প্রতিভার ব্যাপার।

 

অনেকে বলেন, আল মাহমুদ তার চিন্তার এবং বিশ্বাসের অবস্থানটা দার্শনিকভাবে জাস্টিফাই করেননি। আপনি কী বলেন?

আল মাহমুদ : আমার বিশ্বাস। আমি হইলাম একজন ইমানদার মানুষ। ফেইথফুল মানুষ। আমি প্রার্থনা করি। আই প্রে। আমার জীবনের মধ্যেই এটা আছে। আমি একটা সময়কে আমার প্রার্থনার জন্য নির্ধারণ করি। এই সময় চুপচাপ বসে আমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করি। এটা যারা আধুনিক মানুষ, বা যারা বস্তুতান্ত্রিক তারা তো এটাকে পাত্তা দেবে না। বা এটাকে পাত্তা দিতে চায় না। কিন্তু যেই আমি তাদের অস্বীকার করি এবং তাদের অস্তিত্বকে আমার ব্যাখ্যার দ্বারা হালকা করে ফেলি তখন কিন্তু তারা হিংস্র হয়ে যায়। তখন তারা আর যুক্তির পথে চলতে চায় না। তারা আমাকে আক্রমণের পথ খোঁজে। আমি মানুষকে যুক্তি, বুদ্ধি ও বিশ্বাস দিয়ে বোঝাতে চেয়েছি। কিন্তু তারা যখন তা পারছেন না তারা সরাসরি শারীরিকভাবে আমাকে আক্রমণ করত এসেছেন। এটা আপনি কীভাবে মানবেন?

 

আপনাকে যারা পছন্দ করেন। তারাও এই কথা বলেন? যদিও তাদের অবস্থানের একটা চোরা সেক্যুলার জায়গা আছে। তারা মুখে ইসলামের কথা, ঈমানের কথা বলে আর চরম বেঈমানির জীবনযাপনও করে। আমি নাম বলছি না। আপনি চিন্তাশীল ভাবে মোকাবেলা করতে পারেন নি বলে তারা মনে করেন। আপনি কি বলেন?

আল মাহমুদ : দেখেন, আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেন। এখন তো আমি কনফার্ম, যে ধর্ম বিশ্বাস করি সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদের ঘোর বিরোধিতা করার ঐতিহ্য তার আছে। ধর্ম তো বিপ্লব করছে। ছদ্দ বিপ্লবীরা বাইরে থেকে কে কী বলল তাতে কিছু আসে যায় না।

 

মাহমুদ ভাই আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। আসলে আমরা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছি। অল্প সময়ে শেষ করার কথা ছিল হইল না, আরও কয়েক বছর আগে আপনার সাথে কথা কেন বলি নাই এখন আফসোস হচ্ছে। আরও তর্ক জমা রইল। একটা প্রশ্ন করে আজ শেষ করি। কাব্য হিংসা থেকে মুক্তির উপায় কী?

আল মাহমুদ : হুম, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আপনি তো আগে আসেননি। আরেকদিন আসবেন। আরও কথা বলব। দেখেন, আমার কথাটাই সত্য হয়েছে। সব হিংসা নিয়েই সবাই কবিতার ধারায় নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। আমার বন্ধু শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দিন –আমরা বন্ধু ছিলাম। আমাদের মধ্যে হিংসা ছিল। ঈর্ষাও ছিল। আমরা কাব্যের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতা করেছি। তিরিশের কবিরা ধরেন। তারপরও তো রবীন্দ্রনাথ আছেন। অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করে প্রিয় কবি কে? আমি কোনো দ্বিধা না করে জবাব দেই– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তো আমার কথা হল, আামদের মধ্যে এমন একজন কবি আসবেন যিনি সব বিরোধের মীমাংসা তিনি নিজেই করে ফেলতে পারবেন। এটা আমি বিশ্বাস করি। আমরা সেই কবির জন্য অপেক্ষা করছি।