লেখক, দার্শনিক এবং নেক্সাস ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা রব রিমেন ১৯৬২ সালে নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। থিওলজি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন টিলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৮ সালে ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে তার প্রথম বই ‘নোবেলিটি অফ স্পিরিট, আ ফরগটেন আইডিয়াল’ প্রকাশিত হয়। ২০১৮ সালে ‘টু ফাইট এগেইনস্ট দিস এইজ’ প্রকাশিত হয়। ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং প্রতিরোধ বিষয়ে লেখা বইটিতে রব রিমেন অনেক নতুন বিষয়ের অবতারণা করে চিন্তাশীল পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ফ্যাসিবাদ নিয়ে কাজ করছেন এমন চিন্তকদের মধ্যে রিমেন বেশ আলোচিত। তিনি মনে করেন, ইতিহাসের অনেক নিন্দনীয় অধ্যায়ের মত, ফ্যাসিবাদকেও আমরা অতীতের ব্যাপার হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। যেন ফ্যাসিবাদ এমন কিছু একটা যা অতীতে ছিল, এখন নাই। আসলে হিটলার এবং মুসোলিনির করুণ পতনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিনাশ হয়ে গেছে -এটা ভাবা বোকামি। স্টিভ পলসনকে দেয়া সাক্ষাৎকারটি টিটিবুক ডট ওআরজি থেকে নিয়ে জবানের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন দেওয়ান মারুফ শুভ
স্টিভ পলসন : আজকের ফ্যাসিবাদকে কিভাবে দেখেন? কীভাবে আমরা ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করতে পারব?
রব রিমেন : ইউরোপের অনেক জায়গায় ফ্যাসিবাদ এখনও বিরাজ করছে, এবং আমাদের আমেরিকায় তো দেখাই যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদের অস্তিত্ব নেই, এটা একটা অদ্ভুদ এবং ভুল ধারণা। যুদ্ধ-পরবর্তী তাত্ত্বিকেরা ভালোভাবেই অনুধাবন করেছিলেন, ফ্যাসিবাদ একটা গণতন্ত্র বিরোধী নীতি। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে মানুষের রাজনৈতিক চেতনাবোধের সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি। ফ্যাসিবাদের কোন আদর্শিক ভিত্তি নাই, কারণ ফ্যাসিবাদের কোন আদর্শই নাই।
যখন ক্ষমতার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ফ্যাসিবাদ কি না সেটা পরিষ্কার না, তখন কি এটা অন্য কিছু হতে পারে?
রিমেন : এতকিছুর পরেও ফ্যাসিবাদ আসলে মানুষের আবেগ নিয়ে খেলে। ভয়, লোভ, লালসা ইত্যাদি ফ্যাসিবাদকে চালিত করে। বাকপটু জননেতা, ক্যারিশমাটিক নেতা এবং পপুলিস্টদের জন্য দ্বার উন্মোচন করে; যারা নিজেদেরকে মিথ্যা ‘মসিহ’ (ত্রাণকর্তা) হিসেবে জাহির করে।
ফ্যাসিবাদ ধর্মের ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম করতে চায়। এই কারণেই মানুষ এই ধরণের ‘ক্ষমতাশালী লোকদের’ বিশ্বাস করতে চায়। বেশির ভাগ সময়ই আমরা দেখি, একজন ক্ষমতাশালী লোক নিজের একটা অরাজনৈতিক পরিচয় উপস্থাপন করে, এবং প্রচার করে তার কাজ হল, সমাজের সকল ব্যাধি নিরাময় করা। এগুলা ফ্যাসিবাদের পরিচিত আচরণ।
ফ্যাসিবাদ সব সময়ই নিজের প্রয়োজনীয়তা বাড়াবে। তারা সবসময়ই একটা সংকট সৃষ্টি করবে এবং সমাজকে সবসময় ভয়, ঘৃণা, এবং হতাশায় ব্যস্ত রাখবে
নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, এখন এই ধরনের মানুষ চিনতে হলে পপুলিস্টদের দেখতে হবে। কিন্ত আপনি এর সাথে একমত পোষণ করছেন না। আপনি বলছেন এটা অনেক সময় ছলনা হতে পারে। তাহলে আমরা ফ্যাসিবাদকে ফ্যাসিবাদ কেন বলি না?
রিমেন : দেখেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প পপুলিস্ট ছিলেন। এবং বার্নি স্যানডার্সও ছিলেন একজন পপুলিস্ট। এমনকি বারাক ওবামাও পপুলিস্ট ছিলেন। যদি সবাই পপুলিস্ট হয় তাহলে কেউই পপুলিস্ট না।
পপুলিজমের প্রবর্তনই হয়েছে ফ্যাসিবাদ শব্দটাকে বিলুপ্ত করার জন্য। মুসোলিনি, হিটলার, তারা ফ্যাসিস্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন কারণ তাদের নেতৃত্বের মধ্যে একটা ঘোর সৃষ্টিকারী ব্যাপার ছিল। এবং তাতে তারা সফল হয়েছিলেন। তারা জানতেন কিভাবে কথা বলতে হয়, তাদের ওপর মানুষের অগাধ বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।
কিন্ত এরপরই ধীরে ধীরে সামনে আসে অন্য সকল বিষয়। তখন দেখা গেল, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে গণতন্ত্রের বিরোধী শক্তি। ফ্যাসিবাদ নিজেকে প্রথমে অরাজনৈতিক বা নিরপেক্ষ বা জনগণের সেবক হিসেবে উপস্থাপন করবে, কিন্তু একটু জায়গা পেয়ে বসতে পারলেই প্রথমেই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। তখন মানুষের কাছে কোন বিকল্প থাকবে না এবং ফ্যাসিবাদ সব সময়ই নিজের প্রয়োজনীয়তা বাড়াবে। তারা সবসময়ই একটা সংকট সৃষ্টি করবে এবং সমাজকে সবসময় ভয়, ঘৃণা, এবং হতাশায় ব্যস্ত রাখবে।
তাহলে আপনি বলছেন, ফ্যাসিবাদীরা যখন বলে, ‘আমরা দেশের জন্য এটা করতে চাই, ওটা করতে চাই কিন্তু আসলে কি করতে চায় তা নিয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা নাই, যা আছে সবই হচ্ছে হতাশা এবং ঘৃণা?
রিমেন : এ জন্যেই ফ্যাসিজম শুধু ১৯৩০, ৪০ সালে ছিল ভাবলে ভুল হবে। এটা সত্যি না। কারণ স্ট্যালিনের সময়ও সোভিয়েত ইউনিয়নে মানুষ ফ্যাসিজমের কথা বলেছে। এখনও গণতন্ত্রের জিকির তুলে ফ্যাসিজম চলছে।
তাহলে আপনি বলছেন ফ্যাসিজমের ধারণা বাম, ডান দুই ঘরানায়ই থাকতে পারে?
রিমেন : অবশ্যই। ফ্যাসিবাদ শুধু নিজের কথা ভাবে। নিজের ক্ষমতার কথা ভাবে। আর এর জন্যেই তারা ধর্মের ব্যানারে ফ্যাসিবাদী চর্চা শুরু করে। নিজেকে এমন একজন ত্রাণকর্তা বানিয়ে রাখে যার কাছে সকল সমস্যার সমাধান থাকে। আপনার মনে আছে ট্রাম্প যেদিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে লড়বে বলে ঘোষণা দেয়, ট্রাম্প নিজেকে এমন ভাবে উপস্থাপন করেছিল, যেন অন্ধকারে আলো হয়ে, চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে স্বর্গ থেকে নেমে আসেছেন তিনি।
প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান ততটাই শক্তিশালী, যতটা শক্তিশালী জনগণ। কিন্ত প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। এবং যখন এই বিশ্বাস উঠে যাবে, প্রতিষ্ঠানও ভেঙে পড়বে
আপনি এখানে গুরুতর অভিযোগ আনছেন। মানে, আপনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট বলছেন।
রিমেন : হ্যাঁ তার মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে ফ্যাসিবাদী। কিন্ত এটা বলা কি ভয়ানক কিছু? আমরা হাঙ্গেরিতেও একই অবস্থা দেখছি। অষ্ট্রিয়ায়, তুরষ্কে, রাশিয়ায় সব দেশেই এক অবস্থা। তাহলে সত্যটা বলতে সমস্যা কোথায়?
আমার মনে হয়, আমরা যখন ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের কথা ভাবি, তখন আমাদের মাথায় এটা আসে যে, এটা সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান সরিয়ে ফেলতে চায়।
রিমেন : অবশ্যই। কিন্ত দেখেন, আপনাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কি হচ্ছে এখন। গণমাধ্যমের বাক স্বাধীনতাকে সন্দেহভাজন হিসেবে দেখা হচ্ছে, বিচারকদের সন্দেহভাজন করা হচ্ছে। কারণ ‘তারা সবাই জনগণের শত্রু’। এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হচ্ছেন জনগণের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি।
প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান ততটাই শক্তিশালী, যতটা শক্তিশালী জনগণ। কিন্ত প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। এবং যখন এই বিশ্বাস উঠে যাবে, প্রতিষ্ঠানও ভেঙে পড়বে।
১৯৪৮ সালে নোবেল পুরষ্কার জয়ী থমাস মান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দিতে এসে সবার জন্য একটা মহৎ বার্তা দিয়ে যান। তিনি মার্কিনিদের উদ্দেশ্যে বলেন, “দয়া করে আমার কথায় মনযোগ দিন। আমি মিউনিখ থেকে এসেছি। আমি আমার শহরে হিটলারের হাত ধরে ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। একই ভুল আপনারা করবেন না। ফ্যাসিবাদ গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আক্রান্ত করে দিতে পারে এবং এটা শুরু হলে গণতন্ত্রও ভেঙে পড়বে।”
আমাদের বুঝতে হবে যে, ফ্যাসিবাদ হাজির হয় সমাজের ভেতর থেকে। এটা মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না বরং খোদ গণতন্ত্র থেকেই এর উদ্ভব হয়
থমাস মান বলেছিলেন না, “স্বাধীনতার ছদ্মবেশে অ্যামেরিকায় ফ্যাসিবাদ আসবে”?
রিমেন : হ্যাঁ, কারণ ফ্যাসিবাদী নেতাদের সবচেয়ে বড় কৌশল হচ্ছে মিথ্যার রাজনীতি। তারা সবাই মিথ্যাবাদী। সবাই। এবং তাই ফ্যাসিবাদ আসবে স্বাধীনতা অথবা গণতন্ত্রের বেশে। তারা জানে কিভাবে ‘রেটরিক’ বা চাপাবজিকে কাজে লাগতে হয়, আবেগকে ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে স্লোগানের ব্যবহার করতে হয়। তাদের শুধু প্রয়োজন প্রোপাগান্ডা।
এখন আপনি হয়তো পাল্টা যুক্তি দিবেন, যেহেতু সহিংসতা নাই সেহেতু ফ্যাসিবাদের কথা বলা যাবে না। কিন্ত আপনি যদি সমাজে ভয়, ঘৃণা, বিবাদ ছড়াতে থাকেন তাহলে এক সময় সমাজ ভেঙে পড়বে, এটা বুঝতে আপনার মনোবিদ্যায় পিএইচডি থাকার প্রয়োজন নেই।
মানব প্রকৃতিতে কোন পরিবর্তন আসেনি। ফ্রয়েড আমাদের দেখিয়েছেন, আমরা মানুষেরা কতটা আক্রমণাত্মক। এবং আমরা যদি বারবার একই ধরনের রাজনীতির চর্চা করতে থাকি যা মানুষের সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রবৃত্তিগুলোকে জ্বালানি সবরাহ করে, তাহলে সেখানে সহিংসতা দেখা যাবেই। আমার কি মনে করিয়ে দিতে হবে ১৯৯০ সালে বলকানে কি হয়েছিল? যেখানে মিলসেভিচ এবং অন্যান্যরা জাতিগত নিধনের মাধ্যমে দেশের বিনাশ করতে শুরু করেছিল? অথবা রুয়ান্ডাতে যা হয়েছিল?
কথা শুনে মনে হচ্ছে, ফ্যাসিজমে প্রবেশের ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা এখন ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে। তাহলে আমরা ফ্যাসিবাদের এই যাত্রাকে কীভাবে প্রতিহত করব?
রিমেন : প্রথমে আমাদের এই সংকটের শিকড় খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, ফ্যাসিবাদ হাজির হয় সমাজের ভেতর থেকে। এটা মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না বরং খোদ গণতন্ত্র থেকেই এর উদ্ভব হয়। আমাদের প্রথম কর্তব্য হবে গণতন্ত্রের প্রকৃত চেতনাবোধকে পুনরায় জাগ্রত করা, যেমনটা থমাস মান বলেছিলেন ১৯৪৮ সালে। গণতান্ত্রিক চেতনাবোধই মানুষের উন্নতি সাধন করতে চায়, মানুষ এখন যেমন রয়েছে তার চেয়ে ভাল করতে চায় এবং এমন একটা জীবনের প্রতি ধাবিত করে যা সকল মানুষের আত্মমর্যাদার দিকে নজর দেয়। অতএব আপনার প্রয়োজন সত্য, ন্যায়, সৌন্দর্য্য, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা।
এই ভোগবাদী সংস্কৃতি, যার দৃষ্টি শুধুমাত্র কার্যকারিতা এবং ভোগের দিকে নিবদ্ধ, এর বিপরীতে সহনশীলতার সংস্কৃতি চর্চা করা প্রয়োজন। কিন্ত আমাদের বর্তমান বস্তবাদী সংস্কৃতিতে সবকিছুই হতে হবে ভোগের উপযোগী।
তাহলে বলতে হয়, যদি সমস্যা হয় আমাদের বস্তবাদী সংস্কৃতি এবং এটাই যদি হয় কলুষিত রাজনীতির কারণ, তাহলে ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুক। আমরা বেঁচেই আছি বস্তবাদের দুনিয়ায়।
রিমেন : আমরা পরিবর্তন আনতে পারি, কিন্ত আমাদের এখন যা দরকার তা হচ্ছে প্রতিরোধের সংস্কৃতি। এটা এত কোমল ভাবে ঘটে না। ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’-এর মতো মোলায়েম কিছু না। যা ষাটের দশকে হয়েছিল। কিন্ত এমন একটা সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে যা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে, “মানুষের ক্ষুধার চাহিদাই একমাত্র বেঁচে থাকার কারণ নয়।”
কী আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে? কিভাবে আমরা এমন একটা সমাজ পেতে পারি যেটা শুধু নিজের জন্যে চিন্তা করবে না, বরং পুরো সমাজের ভালোর দিকে নজর দিবে।