বরফ, বৃষ্টি ও অন্ধকারের আখ্যান

ডি মারিয়ার বিশেষ লেখা

বরফ, বৃষ্টি ও অন্ধকারের আখ্যান

আমি ট্রেইনারের টেবিলে বসে আছি পায়ে ইনজেকশন দেয়ার জন্যে। কোয়ার্টারফাইনালে আমার থাই মাসেল ছিঁড়ে যায়, কিন্তু পেইনকিলারের কারণে দৌড়ানোর সময় ব্যথা অনুভব হয় না। আমার মনে পড়ে, ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন, সকাল ঠিক ১১ টায় রিয়াল মাদ্রিদ থেকে চিঠি আসে। চিঠিটা খোলার আগেই আমি ছিঁড়ে ফেলে দেই। আমি আমাদের ট্রেইনারকে ঠিক এই কথাটা বলি, “যদি আমি ভেঙে যাই, তাহলে আমাকে ভাঙতে দিন। আমি পরোয়া করি না। আমি শুধু খেলতে চাই।”

ঘটনাটা এমন ছিল যে, আমি পায়ে বরফ চেপে বসে আছি। এমন সময় দলের ডাক্তার ড্যানিয়েল মার্টিনেজ একটা চিঠি হাতে এগিয়ে আসেন। তিনি আমাকে বললেন, আনহেল দেখো, এটা রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এসেছে।

আমি বললাম, কি বলছেন আপনি?

ড্যানিয়েল আমাকে বললেন, তোমাকে না খেলানোর জন্যে অনুরোধ করছে তারা।

আমি তখনই বুঝে যাই মাদ্রিদ কি চাইছে। সবাই ততদিনে জেনে গেছে বিশ্বকাপের পর তারা হামেসকে দলে ভেড়াবে। আমিও জানতাম হামেস এলে দলে জায়গা করতে আমাকে বিক্রি করে দেয়া হবে। তাই মাদ্রিদও চাইছিল তাদের সম্পদের যেন ক্ষতি না হয়। এটা একদম সোজা হিসাব। ফুটবলের এই ব্যবসায়ী নীতি মানুষ কখনো চোখে দেখে না।

আমি ড্যানিয়েলকে বললাম চিঠিটা আমাকে দিতে। হাতে নিয়েই ছিঁড়ে ফেললাম। আমি চিঠি খুলেও দেখিনি। ড্যানিয়েলকে বললাম, এটা ফেলে দাও। সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার শুধুমাত্র আমার।

আগের রাতে আমি একদমই ঘুমাতে পারিনি। এর একটা কারণ ছিল, আমাদের হোটেলের পাশে ব্রাজিলীয় সমর্থকদের সারা রাত ধরে আতশবাজি। কিন্তু পরিবেশ যদি সম্পূর্ণ নিশ্চুপও থাকত, তাহলেও হয়তো ঘুমাতে পারতাম না। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের রাতের অনুভূতি বলে প্রকাশ করা সম্ভব না। যখন সব স্বপ্ন আপনার চোখের সামনে!

যদি ওইদিন আমার ক্যারিয়ার শেষও হয়ে যেত, তারপরও আমি চাইতাম ফাইনাল খেলতে। কিন্তু একইসাথে আমি আমার দলের জন্যে প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইনি। আমাদের ম্যানেজার সাবেলার সাথে আমি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তাই আমি যদি সকালে উঠেই বলতাম আমি খেলতে চাই, তাহলে তিনি অনুরোধ ফেলতে পারতেন না। কিন্তু ওইদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি মিস্টার সাবেলাকে আন্তরিকভাবে জানালাম, ওই পজিশনে যাকে খেলানো উচিৎ বলে তিনি মনে করেন, তাকেই যেন তিনি নামান। আমি ঠিক এ কথাই বলেছিলাম, “যদি আমি হই তাহলে আমিই। যদি অন্য কেউ হয় তাহলে অন্য কেউ। কিন্তু যদি আপনি আমাকে ডাকেন তাহলে আমি শরীরে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত মাঠে থাকব।”

ম্যাচ শুরুর আগে টিম টক শেষ হল। সাবেলা এনযো পেরেজকে সুযোগ দিলেন, যেহেতু পেরেজ ১০০ ভাগ ম্যাচ ফিট ছিল। আমি তার সিদ্ধান্ত মেনে নেই। কিন্তু আমিও প্রস্তুত ছিলাম বেঞ্চে, যেন ডাক পড়লেই মাঠে নামতে পারি। খেলা শুরুর আগে একবার ইনজেকশন নিলাম, দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর আগে আরো একবার। কিন্তু আমার ডাক পড়ল না। আমরা হেরে গেলাম। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত, এবং আমি কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে মিডিয়া আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলা শুরু করল। কেন আমি খেললাম না। কিন্তু আমি যা বলছি, এগুলাই সত্য।

ফাইনালের দিন সকালে সাবেলার সাথে কথা বলার মুহূর্তটি আমাকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। আমি ওইদিন তার সাথে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়ি। এখন আমার মনে হয়, তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আমি স্নায়বিক চাপে পড়ে এমন ভেঙে পড়েচিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে, কান্নার সাথে আমার স্নায়বিক অবস্থার কোন সম্পর্ক ছিল না। কারণ আমরা স্বপ্নের এত কাছে চলে এসেছিলাম যে আমি তখন সব আবেগ জয় করে ফেলেছিলাম। বিশ্বকাপ এতটাই আরাধ্য ছিল আমার কাছে।

অনবদ্য ফুটবলের অপর নাম ডি মারিয়া

আমাদের বাড়ির দেয়ালের রং সাদা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার যতটুক মনে পড়ে আমি কখনো সাদা রং দেখিনি। প্রথম দিকে সেগুলো ধুসর ছিল। তারপর কয়লার ধুলোয় কালো হতে থাকে। আমার বাবা কয়লা শ্রমিক ছিলেন। কিন্তু কয়লা খনিতে কাজ করতেন না তিনি। আমাদের বাড়ির পেছনের উঠানে চারকোল প্রস্তুত করতেন তিনি। বাড়ির পেছনে একটা টিনের চালের নিচে ছোট যায়গায় চারকোল প্রস্তুত করে ব্যাগে ভরতেন, তারপর বাজারে বিক্রি করতেন। কিন্ত তিনি শুধু একা কাজ করতেন না। দুইজন ছোট সাহায্যকারী ছিল তার। স্কুলে যাওয়ার আগে আমি এবং আমার ছোট বোন ঘুম থেকে উঠে তাকে সাহায্য করতাম। আমাদের তখন ৯ কি ১০ বছর বয়স। যখন ট্রাক আসত কয়লা নিয়ে যেতে, আমরা ঘরের ভেতর দিয়ে ব্যাগগুলো সামনের দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে আসতাম। আর এভাবেই আমাদের দেয়ালের রং সাদা থেকে ধূসর, ধূসর থেকে কালো হতে থাকে। আর এভাবেই আমাদের টেবিলে খাবার আসতো।

বাবার প্রথম ব্যবসা অবশ্য ঠিক কয়লার ব্যবসা ছিল না। আমাদের বাড়ির সামনের ঘরে দোকান দিয়েছিলেন তিনি। বাবা বড় বড় ড্রামে করে ব্লিচ, ক্লোরিন, সাবান ছাড়াও বিভিন্ন পরিচ্ছন্ন করার দ্রব্য নিয়ে আসতেন। তারপর বাসায় এনে ছোট বোতলে করে আলাদাভাবে বাবা ও মা মিলে বিক্রি করতেন। আপনি যদি টাউনে থাকেন তাহলে এক বোতল সিআইএফ কিনতে আপনি দোকানে যাবেন না, কারণ বড় দোকানগুলোতে দাম অনেক বেশি। তাই তখন আপনি ডি মারিয়ার বাসায় আসবেন এবং তার মা আপনাকে কম দামে সিএফআই দিবে।

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু সব নষ্টের মূলে ছিল বাচ্চা ডি মারিয়া। হ্যাঁ ডি মারিয়া খুবই বজ্জাত ছিল। মানে আমি খারাপ ছিলাম না কিন্তু অনেক অস্থির থাকতাম। আমার মায়ের ভাষ্য মতে, একদিন দোকানে কাস্টমার এসেছিল সাবান নিতে। দোকান দেয়ায় আমাদের দরজা খোলা থাকত কাস্টমারদের সুবিধার জন্যে। তো খোলা দরজা দেখে আমি ওয়াকারে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় চলে যাই। এবং তখনই রাস্তায় একটা গাড়ি আসতে থাকে। মা দৌড়ে যান আমাকে বাঁচাতে। ওইদিনই আমাদের দোকানের শেষ দিন ছিল। মা বাবাকে বলেন, অন্য কোন ব্যবসা দেখতে কারণ এটা আমাদের জন্যে বিপদজনক।

তখন বাবা একজন লোকের সন্ধান পেলেন, যিনি সান্তিয়াগো দেল এস্তেরো থেকে ট্রাকে করে কয়লা নিয়ে আসতেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তখন ব্যবসা শুরু করার মত ন্যূনতম টাকাও বাবার ছিল না। তখন তিনি ওই ড্রাইভারকে অনেক কষ্টে রাজি করান প্রথম শিপমেন্টটা বাকিতে দিতে। তাই যখনই আমি অথবা আমার বোন বাবার কাছে চকলেট আবদার করতাম, বাবা বলতেন, “আমি বাড়ি এবং এক ট্রাক কয়লার ঋণ পরিশোধ করছি।”

মনে পড়ে একদিন প্রচন্ড ঠান্ডায় সকালে আমি বাবার সাথে ব্যাগে চারকোল ভরছিলাম। অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল এবং খুব ঠান্ডাও পড়েছিল। আমাদের মাথার ওপর শুধু একটা টিনের চাল ছিল এবং ঠান্ডায় কাজ করা কঠিন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে আমি স্কুলে গেলাম, এবং স্কুল ছিল উষ্ণ। কিন্ত বাবার সারাদিনই কাজ করতে হয়েছিল, কারণ তা না হলে হয়ত আমাদের ঘরে ওইদিন সন্ধ্যায় খাবার আসত না। আমি ওইদিন মনে মনে ভাবছিলাম এবং নিজেকে বলি, একদিন সব কিছু পরিবর্তন হবে। এবং এই কারণেই আমি ফুটবলের কাছে ঋণী।

অনেক সময় বজ্জাত হওয়া থেকেও ভাল কিছু হয়। আমি অল্প বয়সেই ফুটবল শুরু করি কারণ আমি আমার মাকে পাগল করে ছাড়ছিলাম। এমনকি সে আমাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যান কারণ আমি একটুও স্থির থাকতাম না। মা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন, “ডাক্তার ওর দৌড়াদৌড়ি থামেই না। আমি কি করব?” এবং একজন ভালো আর্জেন্টাইন ডাক্তার হিসেবে তিনি বলেন, “কি করবেন? ফুটবল খেলতে দেন।”

এর মধ্য দিয়েই আমি আমার ফুটবল জীবনে পদার্পন করি। আমি ছিলাম ফুটবলের জন্য পাগল। মনে পড়ে, আমি এত ফুটবল খেলতাম যে দুই মাসেই আমার বুট ছিড়ে যেত। যেহেতু নতুন জুতা কেনার টাকা ছিল না তাই মা আমার ছেঁড়া জুতা আবার আঠা দিয়ে জোড়া দিয়ে দিতেন।

শৈশবের ডি মারিয়া

আমি নিশ্চই ভাল খেলতাম, কারণ যখন আমার বয়স সাত তখন পাড়ার দলের হয়ে আমি ৬৪ গোল করে ফেলেছিলাম। এমনই একদিন মা আমার রুমে এসে বললেন, “রেডিও স্টেশন তোমার সাথে কথা বলতে চায়।” তারপর আমরা রেডিও স্টেশনে গেলাম সাক্ষাৎকার দিতে। আমি এতই লাজুক ছিলাম যে কথা বলাই মুশকিল হয়ে গিয়েছিল।

ওই বছরই একদিন বাবা রোসারিও সেন্ট্রালের ফোন কল পান। তাদের যুব দলের কোচ আমাকে দলে নিতে চান। এখানে একটা মজার ঘটনা রয়েছে, বাবা ছিলেন নিউওয়েল’স ওল্ড বয়েজের পাড় সমর্থক। অন্যদিকে মা ছিলেন রোসারিও সেন্ট্রালের সমর্থক। আর আপনি রোসারিওতে না থাকলে চিন্তাও করতে পারবেন না এই দুই দলের দ্বন্দ্ব কতটা প্রগাঢ়। এটা যেন জীবন মরণের মত। যখন ক্লাসিকো খেলা হত, আমার বাবা মা দুইজনই শেষ শক্তি দিয়ে দলকে সমর্থন দিতেন, এবং যার দল জিতে যেত সে পুরো মাস আরেকজনকে খোঁচাতে থাকত। তাই বুঝতেই পারছেন রোসারিওর ফোন পাওয়ায় মা কতটা উত্তেজিত হয়েছিলেন।

কিন্ত বাবা তখন বলেন, “এখন কি করব। প্রায় নয় কিলোমিটার দূরে। আমাদের তো গাড়িও নাই! কিভাবে নিয়ে যাব এত দূর।”

কিন্ত মা তখন বলেন, “না, না কোন চিন্তা করবে না। আমি ওকে নিয়ে যাব। কোন সমস্যা নেই।”

তখনই জন্ম নেয় গ্রেসিয়েলা। গ্রেসিয়েলা একটা বিবর্ণ হলুদ সাইকেল। এই সাইকেল চড়েই মা প্রতিদিন আমাকে ট্রেনিংয়ে নিয়ে যেতেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সামনে একটা ঝুড়ি এবং পেছনে বসার জায়গা থাকলেও, ট্রেনিংয়ের সময় আমার বোনকেও সাথে নিয়ে যেতে হত, কিন্ত ওর বসার জায়গা ছিল না। তখন বাবা সাইকেলের সামনে একটা ছোট কাঠের বসার জায়গা বানিয়ে দেন। কল্পনা করতে পারেন, পাহাড়ের উঁচু নিচু পথ, বিপদজনক প্রতিবেশের মধ্য দিয়ে আমাকে পেছনে এবং বোনকে সামনে বসিয়ে মা সাইকেল চালিয়ে ট্রেনিংয়ে নিয়ে যেতেন। আর ঝুড়িতে থাকত আমার বুট, জামা ও নাস্তা। বৃষ্টি, শীত, অন্ধকার, কোনকিছুরই পরোয়া না করে মা শুধু পেডেল মেরে চলতেন। যেখানেই যাওয়ার দরকার গ্রেসিয়েলা আমাদের নিয়ে চলত।

সত্যি বলতে রোসারিওতে খেলা তখন মোটেও সহজ ছিল না। মা না থাকলে আমি হয়ত ফুটবল খেলা ছেড়েই দিতাম। আমার বয়স ১৫ হয়ে গেলেও আমি বাড়ছিলাম না একদমই। আমার কোচ ছিলেন ক্ষ্যাপাটে ধরণের। তিনি বলিষ্ঠ এবং আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় পছন্দ করতেন। কিন্ত আমার খেলার ধরণ তেমন ছিল না। তো একদিন ডি-বক্সের মধ্যে আমি হেডের সুযোগ পেয়েও লাফ না দেওয়ায় কোচ আমার ওপর অনেক চটে যান। ওইদিন তিনি আমাকে অপমান করেন দলের সবার সামনে। আমি মাঠেই কান্না শুরু করি এবং দৌড়ে মাঠের বাইরে চলে আসি। বাসায় এসে আমি কিছু না বললেও মা ঠাওর করতে পারেন কোন সমস্যা চলছে। কারণ ট্রেনিং থেকে বাসায় ফিরেই আমি ফুটবল নিয়ে বের হয়ে যেতাম, কিন্ত ওইদিন সোজা ঘরে যেয়ে কাঁদতে থাকি। আমি মাকে বললাম আমি মারামারি করেছি। কিন্ত তিনি আমার মিথ্যা ধরে ফেলেন। পরে উনি আমার আরেক বন্ধুর মায়ের কাছে ফোন করে সত্যিটা জানতে পারেন।

যখন মা আমার ঘরে ফিরে আসেন আমি কাঁদতে কাঁদতে বলি, আমি আর ফুটবল খেলব না। পরদিন আমি লজ্জায় ঘর থেকে বের হতে পারিনি। স্কুলেও যেতে চাইলাম না। মা তখন আমার বিছানায় বসলেন এবং আমাকে বললেন, “আনহেল, তুমি ফিরে যাবে। আজকেই যাবে। কোচের সামনে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে তোমার।”

আমি পরদিন ট্রেনিংয়ে গেলাম এবং আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল। ওইদিন কেউ আমার সাথে মজা করছে না বরং আমাকে সাহায্য করছে। তারা নিজেরা জায়গা খালি করে দিয়ে আমাকে সুযোগ দেয় বলে হেড দিতে। লাতিন আমেরিকায় ফুটবলে প্রতিযোগিতা অনেক। সবাই তাদের জীবনকে ভাল জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। কিন্ত আমি ওইদিনের কথা একদমই ভুলতে পারব না।

বয়স ১৬ হয়ে গেলেও আমি তখনও ছোটখাট এবং পাতলা ছিলাম। সেন্ট্রাল সিনিয়র দলে সুযোগও পাচ্ছিলাম না। বাবা একদিন রাতে আমাকে বললেন, “তোমার হাতে ৩টা পথ খোলা রয়েছে। তুমি আমার সাথে কাজে আসতে পার। অথবা তুমি তোমার পড়ালেখা শেষ কর। অথবা তুমি আরো একবছর ফুটবলের জন্যে সময় দাও। কিন্ত যদি ফুটবল দিয়ে কিছু না হয় তাহলে আমার সাথে কাজে লাগতে হবে।”

আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না তখন। আমাদের টাকার প্রয়োজন ছিল। কিন্ত তখনই আমার মা বলে উঠলেন, ‘আরেক বছর ফুটবল।’ এটা ছিল জানুয়ারি মাসের কথা। ঘটনাক্রমে ওই বছর ডিসেম্বরে আমি সেন্ট্রালের হয়ে প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলার ডাক পাই।

ন্যাসিওনালের সাথে কোপা লিবেরতাদোরেস খেলতে কলম্বিয়া যাওয়ার কথা আমি কখনোই ভুলব না। রোসারিওতে তখন কোন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছিল না। আমরা এয়ারপোর্টে যেতাম, যেই প্লেন এয়ারপোর্টে থাকত, কোন প্রশ্ন না করে সেটাতেই উঠে পড়তাম।

একদিন কলম্বিয়ার ফ্লাইট ধরতে আমরা এয়ারপোর্টে উপস্থিত হলাম। অবিশ্বাসের সাথে রানওয়েতে একটা বিশাল কার্গো প্লেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। যে সকল প্লেনে মালামাল নেয়া হয়। এবং এটাই ছিল আমাদের কলম্বিয়া যাওয়ার প্লেন, “হারকিউলিস।”

প্লেনের র‍্যাম্প নিচে নেমে আসল এবং শ্রমিকেরা প্লেনে ম্যাট্রেস উঠাতে লাগল। আমরা সবাই হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলাম। যখন আমরা প্লেনে উঠব, শ্রমিকেরা জানাল, ‘না এখানে না, তোমরা প্লেনের পেছনে র‍্যাম্পে উঠবে। হেডফোন গুলো নাও।’ এটা ছিল অবিশ্বাস্য। সেখানে না থাকলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। এটা ছিল আমাদের নিজেদের প্রাইভেট প্লেন। হারকিউলিস!

এখন আমি ওইসব স্মৃতি হাসি মুখে মনে করি। আর্জেন্টিনায় ফুটবল ক্যারিয়ার গড়তে হলে যা করা দরকার তার সবটাই আপনার করা লাগবে। যেই প্লেনই আসুক, কোন প্রশ্ন না করে উঠে যেতে হবে। আর ঘটনাক্রমে যখনই সুযোগ আসবে লুফে নিতে হবে। আমার জন্য সুযোগ এসেছিল পর্তুগাল থেকে, বেনফিকায় খেলার সুযোগ। হয়ত মানুষ আমার ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে বলবে, “ওয়াও ও বেনফিকায় খেলেছে, তারপর রিয়াল মাদ্রিদ, তারপর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, পিএসজি।” হয়ত তাদের মনে হবে এটা সহজ অনেক। কিন্ত আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না এর মাঝে কত ঘটনা ঘটে গেছে। যখন আমি বেনফিকায় যাই, আমার বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। প্রথম দুই মৌসুমে আমি দলে সুযোগই পাইনি। মাকে কয়েক হাজার মাইল পেছনে ফেলে বাবাও পর্তুগাল এসেছিলেন আমার সাথে। এমনও অনেক রাত কেটেছে যখন বাবা ফোনে মায়ের সাথে কথা বলতে যেয়ে কাঁদতেন, কারণ বাবা তাকে অনেক মিস করতেন। আর তখনই আমার মনে হয়েছিল, আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। আমি দলে সুযোগও পাচ্ছিলাম না। চাইছিলাম সব ছেড়েছুড়ে বাড়ি ফিরে যেতে।

কিন্ত তখনই অলিম্পিক ২০০৮ এসে আমার জীবন পাল্টে দিল। আমি বেনফিকার হয়ে সুযোগ না পেলেও আর্জেন্টিনার হয়ে অলিম্পিকে যেতে আমাকে দলভুক্ত করা হল। আমি যা কখনোই ভুলব না। এই টুর্নামেন্টই আমাকে সুযোগ দিয়েছিল মেসির সাথে খেলার। ফুটবল খেলা এর আগে কখনোই আমার কাছে এত মজার ছিল না। আমার শুধু দৌড় শুরু করে জায়গা মত পৌঁছতে হত, বল আমার পায়ে এসে যেত! যেন জাদু।

লিও’র চোখ আমাদের চোখের মত না। আমরা শুধু এপাশ থেকে ওপাশ দেখতে পারি। কিন্ত লিও যেন ওপর থেকেও সব দেখে। পাখির মত। আমি জানি না কিভাবে এটা সম্ভব।

সেবার ফাইনালে নাইজেরিয়ার সাথে গোল করে দলকে জেতানো! আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না এই অনুভূতি। আর্জেন্টিনার হয়ে স্বর্ণপদক জেতা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মূহুর্ত। আপনার বুঝতে হবে, আমার বয়স তখন মাত্র ২০, এবং আমি বেনফিকায় সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আমার পরিবার আলাদা হয় আমার জন্যে। আমি হতাশায় ডুবেছিলাম। তখনই আর্জেন্টিনা আমাকে ডাকে। এবং দুই বছরের মধ্যে আমি অলিম্পিক স্বর্নপদক জিতি, বেনফিকার দলে সুযোগ পাই এবং তারপর আমি রিয়াল মাদ্রিদে যাই।

অনেকেই বলতেন, বাবা আমার থেকেও ভাল ফুটবল খেলতেন, কিন্ত কৈশরেই তার হাঁটু ভেঙে যায় এবং ভেঙে যায় তার স্বপ্ন। তারা বলতেন, আমার দাদা আমার বাবার চেয়েও ভালো ফুটবল খেলতেন, কিন্ত ট্রেন এক্সিডেন্টে তিনি দুই পা হারান, তারও স্বপ্ন ভেঙে যায়।

আমার স্বপ্নও অনেকবার ভেস্তে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। কিন্ত আমার বাবা সেই টিনের চালের নিচে কাজ করতে থাকেন, মা পেডাল মারতে থাকেন, এবং আমি মাঠে দৌড়ে স্পেস খুজতে থাকি।

আমি জানি না আপনারা ভাগ্যে বিশ্বাস করেন কি না, কিন্ত রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে আমার প্রথম গোল কাদের বিপক্ষে ছিল জানেন?

হারকিউলিস সিএফ।

আমরা অনেক দূর চলে এসেছি। এখন হয়ত আপনারা বুঝতে পারছেন কেন ফাইনালের আগে আমি সাবেলার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। আমি চাপে ছিলাম না। আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছিলাম না। এমনকি ম্যাচে খেলা নিয়েও ভাবছিলাম না। বুকে হাত দিয়ে বলছি, সত্যিটা হল, আমি শুধু আমাদের স্বপ্ন সত্যি করতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম আমাদের দেশের মানুষ যেন আমাদেরকে আজীবন কিংবদন্তি হিসেবে মনে রাখে। আমরা স্বপ্ন পূরণের খুব কাছে ছিলাম…

আমার মন ভেঙে যায় যখন আমি দেখি আমাদের প্রতি আর্জেন্টাইন গণমাধ্যমে বিরূপ আচরণ করা হয়। অনেক সময় এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এটা স্বাস্থ্যকর না। কারণ আমরা সবাই সাধারণ মানুষ। আমাদের জীবনেও অনেক কিছু ঘটে যা আপনারা দেখেন না।

এমনকি বাছাই পর্বের শেষ খেলার আগে আমি এত ভেঙে পড়েছিলাম যে আমি মনোবিদের স্মরণাপন্ন হই। অন্য যেকোন সময় এমন সময়ে আমি আমার পরিবারের কাছে আশ্রয় খুঁজি। কিন্ত এবার চাপ অনেক বেশি ছিল। আমি নিজেকে মনে করিয়ে দেই, আমি বিশ্বের সেরা দলের অংশ ছিলাম, এবং আমি আমার দেশের জন্য খেলছি। শৈশবে যা আমার স্বপ্ন ছিল, তা এখন বাস্তব।

এখন সবাই ইন্সটাগ্রাম বা ইউটিউবে শুধু খেলার ফলাফলটা দেখেন, কিন্ত তারা দেখেন না এর পেছনে আমাদের ত্যাগ। তারা আমাদের পথচলাটা দেখেন না। তারা দেখেন আমি আমার মেয়েকে নিয়ে হাসিমুখে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফি ধরে আছি, এবং তারা ভাবে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। কিন্ত মানুষ জানে না এই ছবি তোলার এক বছর আগেই আমার মেয়ে অপর্যাপ্ত সময়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা জানেন না জন্মের পরে আমার মেয়ে দুই মাস হাসপাতালে টিউবের ভেতরে চিকিৎসাধীন ছিল। তারা আমাকে ট্রফি হাতে কাঁদতে দেখে এবং ভাবে আমি হয়ত ফুটবলের জন্য কাঁদছি। কিন্ত সত্য বলতে আমি কাঁদছি কারণ এই আনন্দ ভাগ করে নেয়ার জন্যে আমার কোলে আমার মেয়ে আছে।

তারা বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখেন, এবং তারা দেখে শুধু খেলার ফলাফল, ০-১।

কিন্ত তারা দেখেন না আমাদের মধ্যে অনেকেরই কত কষ্ট করতে হয়েছে এই মূহুর্তে পৌঁছতে।

তারা আমার ঘরের রং সাদা থেকে কালো হওয়ার গল্প জানেন না।

তারা জানেন না ছোট্ট টিনের চালের নিচে আমার বাবার সংগ্রাম।

তারা জানেন না গ্রেসিয়েলাকে নিয়ে বৃষ্টি অথবা ঠান্ডার পরোয়া না করে সন্তানের জন্যে আমার মায়ের অভিযান।

এবং তারা জানেন না হারকিউলিসের কথা।

 


লেখাটি দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে ২৫ জুন ২০১৮ তারিখে ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হয়। জবানের পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন দেওয়ান মারুফ শুভ।