যেমন আছেন ব্রাজিলের মুসলমানরা

যেমন আছেন ব্রাজিলের মুসলমানরা

‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর ২০১০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্রাজিলের বর্তমান মুসলমান সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। সংখ্যার বিবেচনায় লাতিন আমেরিকার তৃতীয় সর্বোচ্চ মুসলমান বসবাসকারী দেশ। উইকিপিডিয়াতেও প্রায় অনুরূপ তথ্য রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এই পরিসংখ্যান মোটেও সঠিক নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট’-এর প্রতিবেদনেই ব্রাজিলের মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে তিন ধরণের তথ্য দেয়া রয়েছে। সেখানে একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ৩৫ হাজার ২০০ আরেক হিসাবে বলা হয়েছে ১৫ লাখ এবং আরেক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে ৪ থেকে ৫ লাখ। আবার ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে ২ লাখ। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা ১৫ লাখ থেকে ১৭ লাখ হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। কেন মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে এত মতবিরোধ? এর পেছনে প্রধানত দুইটি বিষয় কাজ করতে পারে, প্রথমত মুসলিম জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানোর প্রবণতা; তাদেরকে আদমশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত না করা। দ্বিতীয়ত, ব্রাজিলের আদমশুমারিতে আলাদাভাবে ধর্মভিত্তিক কোন পরিসংখ্যান না থাকা। এছাড়া লেবানন ও সিরিয়া অঞ্চল থেকে যেসকল মুসলিম জনগোষ্ঠী অভিবাসনের মাধ্যমে ব্রাজিলে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তারা স্বাধীনভাবে দেশটির আদমশুমারিতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না।

ফুটবল বা পেলে-নেইমারের দেশ হিসাবে আমরা চিনে থাকি ব্রাজিলকে; এছাড়া ব্রাজিলে রয়েছে জগত বিখ্যাত অ্যামাজন বন। ব্রাজিলের ২০ কোটি লোকসংখ্যার বেশির ভাগই ক্যাথলিক খ্রিস্টান। ইসলাম সেখানে একটি সংখ্যালঘু ধর্ম, তবে এই ল্যাটিন দেশটিতে দ্রুত ইসলামের প্রচার-প্রসার বাড়ছে। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ব্রাজিলে ইসলামের আগমন আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের সূচনালগ্ন থেকেই। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল বিখ্যাত পর্তুগিজ পরিব্রাজক ও আবিষ্কারক পেড্রো আলভারেস কারব্যাল (১৪৬৭-১৫২০) যখন ব্রাজিল উপকূলে জাহাজ নোঙর করেন, তখন তার সাথে বেশ কিছু স্বনামধন্য, দক্ষ, কর্মঠ ও পারদর্শী মুসলিম নাবিকও আসেন। তাদের মধ্যে শিহাবুদ্দিন বিন মাজেদ ও মুসা বিন সাতি ছিলেন অন্যতম। পরবর্তীতে তাদের হাত ধরেই ব্রাজিলে ইসলাম ও মুসলমানের আবির্ভাব ঘটে। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, আরব বণিকদের হাত ধরে পর্তুগিজদের আগেই ব্রাজিলে ইসলামের আগমন ঘটে।

মূলত ব্রাজিল ছিল পর্তুগিজদের একটি কলোনি। পেড্রো আলভারেস কারব্যালের হাত ধরে ১৫০০ সালের ২২ এপ্রিল এটি পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পর্তুগিজরা ছিল দস্যু প্রকৃতির; তারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষকে দাস-দাসী হিসাবে ধরে এনে ব্রাজিলে আখ চাষের কাজে নিয়োজিত করত, আর এসব আফ্রিকান দাসরা অধিকাংশই ছিল মুসলিম। এসব দাস-দাসীরাই পরবর্তীতে ব্রাজিলে ইসলাম প্রচারের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠলেন। এমনকি ১৮০০ শতাব্দীতে আফ্রিকান দাসদের হাত ধরে ব্রাজিলে স্বাধীনতার জন্য দাস বিদ্রোহের ডাক আসলে সেখানে অনেক মুসলিমও নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।

উল্লেখ্য, ১৮২৪ সালের ৮ মার্চ পর্তুগিজ সৈন্যরা ব্রাজিলের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে এবং ১৮২৫ সালের ২৯ আগস্ট পর্তুগিজরা ব্রাজিলের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি প্রদান করে।

অন্যদিকে যখন স্পেনে মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন হয়, তখন বিপুলসংখ্যক স্প্যানিশ মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার হয়ে পালিয়ে এসে ব্রাজিলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ক্রমান্বয়ে ব্রাজিলে স্প্যানিশ মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থেকে। ব্রাজিলেও তাদের ওপরে নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। এমনকি ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলীয় আলমিরস শহরে ব্রাজিলে বসবাসকারী মুসলিমরা একত্রিত হয়ে একটি মুসলিম রাজ্যও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, যদিও পর্তুগিজদের বার বার হামলার মুখে এই রাজ্য বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি, ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের হাতে নির্মমভাবে আলমিরস মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এরপর ব্রাজিলে তৎকালীন পর্তুগিজ সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘অনুসন্ধান আদালত’ প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে অনেক মুসলমানকে জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এমনকি মুসলমানদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নিদর্শন তখন মুছে ফেলা হয়; অনেক মসজিদ গির্জায় পরিণত করা হয়।

ব্রাজিলের মুসলমানদের জন্য সুদিন আসতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে। এ সময়ে লেবানন, ফিলিস্তিন, মিসর ও সিরিয়া থেকে অনেক মুসলমান ব্রাজিল আসতে থাকে; বিশেষত আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ও লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময়ে। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলের রাজা মিসর, লেবানন ও সিরিয়ায় সফর করেন। রাজা দ্বিতীয় পেড্রোর সঙ্গে চুক্তি হয় লেবাননের। লেবানিজরা ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ লাভ করে ব্রাজিলে। ফলে একটা সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি হয়। বর্তমানে ব্রাজিলের অর্থনীতিতে বেশ ভাল ভূমিকা রাখছেন সেসব মুসলিম ব্যবসায়ীরা। ব্যবসার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন চাকরি, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও খেলাধুলায়ও মুসলমানরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। অন্যদিকে আরব বসন্তের পর গত কয়েক বছরে চার শতাধিক সিরিয়ান ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের শতাধিক মুসলিম পরিবার ব্রাজিলে আশ্রয় নিয়েছে।

ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওর একটি দোকানের সামনে কয়েকজন মুসলিম কথা বলছেন। Image : A. Dias

এমন বাস্তবতায় বিবিসির মত প্রভাবশালী গণমাধ্যম যেখানে বলছে ল্যাটিন আমেরিকায় মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে না; সেখানে বাস্তবতায় দেখা গেছে ব্রাজিলে দ্রুতই মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু বছর আগেও স্থানীয় একটি ক্যাথলিক গির্জার পাদ্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন ওমর ইসরাফিল। বর্তমানে তিনি একজন মুসলিম। তিনি তার ইসলাম গ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন বার্তা সংস্থা এএফপির সাংবাদিকদের কাছে, সেখানে তিনি বলেন, “আমি ইসলামে সবকিছুর সমন্বয় পেয়েছি, আমি যেগুলো সব সময় কামনা করেছি তার সমাধান পেয়েছি। যেমন আল্লাহ নিরাকার, আমি ঠিক তাকে তেমনভাবেই পেয়েছি। ঐতিহ্যবাহী লম্বা পোশাক পরিহিত ৪০ বছর বয়স্ক গ্রাফিক ডিজাইনার ওমর তার সরকারি নাম জানাতে অস্বীকার করেন। এর পরিবর্তে শুধু এটুকু বললেন আমি একজন মুসলমান আমার নাম ওমর ইসরাফিল দাউদ বিন ইবরাহিম।” ওমর আরও বলেন, “আপনি আগ্রহী হলে জানতে পারবেন ইসলাম হচ্ছে একত্ববাদী ধর্ম।”

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরে ওমরের স্ত্রী আলেকসান্দ্রা ফারিয়া তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিও স্বামীর অনুরূপ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেন। মুসলমান হওয়ার পর তিনি তার নাম পরিবর্তন করে ফাতিমা রাখেন। তিনি ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর হিজাব পরা শুরু করেন ফাতিমার হিজাব দেখে রিওডি জেনেরিওর রাস্তায় অনেকে ভ্রু কুঁচকাতে পারে। কারণ এখানকার বেশিরভাগ মহিলাই মিনি বিকিনি পরে রাস্তায় চলে। তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস আমি এখানে খুঁজে পাই। প্রথম দিকে আমার মা আমার সঙ্গে বাইরে বের হতে লজ্বাবোধ করতেন। আমি যে মুসলিম তা দেখানোর জন্যই হিজাব পরে বের হই। আমি যে সংখ্যালঘুদের একটি অংশ তা প্রদর্শনও আমার লক্ষ্য। রিওডি জেনেরিওর উত্তর শহরতলী টিজুকায় তারা যে মসজিদে নামাজ আদায় করেন সে সমজিদে মুসল্লিদের অনুদানে সংস্কার কাজ চলছে। এখানে ৪শ’ মুসল্লির নামাজের স্থান সংকুলান হবে।

বর্তমানে ব্রাজিলের প্রায় প্রতিটি শহরেই মসজিদ রয়েছে। এর সংখ্যা প্রায় ১৩০টি। ২০০০ সালের তুলনায় ব্রাজিলের মসজিদ সংখ্যা প্রায় চারগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের হামলার পর ইসলাম সম্পর্কে ব্রাজিলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়েছে। ব্রাজিলের বেনিফিসেন্ট মুসলিম সোসাইটি (এসবিএমআরজে)-এর মুখপাত্র সামি ইসবেল বলেন, “এদেশে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে এবং এর মধ্যে অধিকাংশই ব্রাজিলীয় নওমুসলিম। আমরা অনলাইনেই অধিকাংশ সদস্য সংগ্রহ করি। রিওডি জেনেরিওতে ৫শ’ মুসলিম পরিবার বসবাস করছে। তাদের শতকরা ৮৫ ভাগই ব্রাজিলীয় নওমুসলিম। তবে সাও পাওলো রাজ্য ও ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলের পরিস্থিতি ভিন্ন। সেখানকার মুসলমানরা এদেশে জন্মগ্রহণ করলেও তাদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন আরব।”

ব্রাজিলে পঞ্চাশটির মতো ইসলামি সংস্থা মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিমদেরও নিরন্তরভাবে দাওয়াত, শিক্ষা ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে। ইসলাম সম্পর্কে তাদের জানার প্রচুর আগ্রহ রয়েছে। সাওপাওলোর মসজিদগুলোতে দেখা যায়, প্রতিদিনই ব্রাজিলের অনেক খ্রিস্টান নারী ইসলাম সম্পর্কে জানতে আসেন। ব্রাজিলের আদমশুমারিতে মুসলমানদেরকে এখনো আলাদাভাবে গণনা করা হয় না। কিন্তু ক্যাথলিক, ইভানজেলিক্যাল, ইহুদী, অতিপ্রকৃতবাদী ও আফ্রো-ব্রাজিলীয় ধর্মের অনুসারিদেরকে গণনা করা হয়।