সারা বিশ্বে যখন বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আলোচনা চলছে। তখন মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিশ্বকাপের এই আলো ঝলমলে আসরের উন্মাদনায় মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে দুটি রোহিঙ্গা ফুটবল ক্লাব খেলেছে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। এটি শুধু ৯০ মিনিটের একটি খেলা ছিল না বরং এটি কিছু সময়ের জন্য তাদের যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা ভোলানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে।
বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। তাদের বিগত এবং বর্তমান জীবনসংগ্রাম ভুলে থাকতে ফুটবল দিয়েছে একটি অবকাশ। যখন কুয়ালালামপুরের মাঠে একজন খেলোয়াড় বল পাস করে এবং দর্শকের ছোট একটা ভিড়ের মধ্যে শট নেয় তখন তাদের বিগত দিনের সমস্ত কষ্ট ছুটি নেয়।
সতেরো বছর বয়েসি মোহাম্মদ ইসহাক জানায়, “ফুটবল ৯০ মিনিটের জন্য আমার কাছ থেকে সমস্ত অশান্তি কেড়ে নেয়। এটি আমাদের কিছু সমস্যা ভুলে থাকতে সাহায্য করে।”
বিশ্বকাপের উন্মাদনায় চলছে নানা গুঞ্জন, কথা হচ্ছে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ম্যাচের ফলাফল নিয়ে, কেউ কেউ গায়ে দিচ্ছে প্রিয় দলের জার্সি।
এ বছর ঈদুল ফিতরের উৎসবে তারা একটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিল, যেখানে নয়টি দল অংশগ্রহণ করে। কেউ কেউ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন, রোহিঙ্গা দল একদিন বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট খেলবে এবং এমন একটি জাতি হিসেবে যাদের ‘স্বদেশ’ বলতে কোন দেশ নেই।
অপেক্ষাকৃত অধিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়েশিয়া রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে কড়া নজরদারি জারি রেখেছে। প্রশাসনিক অনুমতি না থাকায় শরণার্থী সস্তা-শ্রমের উৎস হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে গৃহপরিচারিকা বা দিনমজুর হিসেবেই তাদের কাজে নেয়া হয়। এখানে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের চেয়ে ভাল থাকলেও মালয়েশিয়ার জন্য তাদের ভরণ-পোষণ করা কঠিন। মালয়েশিয়া এখনো তাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেনি।
এমন পরিস্থিতে, ২০১৫ সালে রোহিঙ্গা ফুটবল ক্লাব (আরএফসি) প্রতিষ্ঠিত হয় যাতে এর সদস্যরা অবসর সময়ে গঠনমূলক কিছু করতে পারে। এবং তাদের অনিশ্চিত অস্তিত্ব থেকে কিছুটা রেহাই পেতে পারে। একই সময়ে দেশব্যাপি একই রকম আরও বেশ কটি রোহিঙ্গা ক্লাব গড়ে ওঠে। তারা নিজেদের মধ্যে বা স্থানীয় মালয়েশিয়ান ক্লাবের মধ্যে ফুটবল খেলে থাকে।
আয়োজকরা বলেন, তিনদিন ব্যাপি ঈদ-টুর্নামেন্ট এমন একটা সময়ে তরুণদের পজিটিভ চিন্তার সুযোগ করে দিয়েছিল, যখন তাদের মনে প্রিয়জনদের নিখোঁজ এবং অন্ধকারে বাস করার স্মৃতি বাসা বেঁধেছে।
আরএফসি’র সেক্রেটারি মোহম্মদ ফারুক বলেন, সামরিক আগ্রাসনের অভিজ্ঞতা সকল রোহিঙ্গাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক। এমনকি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্যও।
তিনি আরও বলেন, সেখানে প্রচুর রোহিঙ্গা রয়েছে যারা তাদের পিতামাতা হারিয়েছে, যারা তাদের সহোদর হারিয়েছে, যারা তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে। তাদের অতীতের স্মৃতি ভয়াবহ।
মোহাম্মদ ফারুক রোহিঙ্গা স্কোয়াডকে ‘কনিফা বিশ্ব ফুটবল কাপ’ খেলাতে চান। কনিফা দুই বছর পর পর অফিসিয়াল টুর্নামেন্টে বাদ পড়া দলগুলোকে নিয়ে হয়ে থাকে। এবং যেটি সংখ্যালঘু, বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করে।
দিনের পর দিন হতাশার মধ্যে ফুটবল কিছুটা হলেও রোহিঙ্গা মুসলমান যুবকদের মনে স্বস্তি দিয়েছে। এবং স্থানীয় মানুষের মধ্যে থাকা দেয়াল ভাঙতে সাহায্য করছে। এমনকি বৈষম্য দূর করতেও সহযোগিতা করছে ফুটবল।
মালয়েশিয়ার নতুন সরকার রোহিঙ্গাদের কাজের বৈধতা নিয়ে ভাবছে যার ফলে শরণার্থী সম্মান এবং ভালোভাবে বাচার সুযোগ পাবে সেখানে। কিছুটা হলেও সহজ হবে জীবন সংগ্রাম।