মণিপুর বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল পাহাড়ে ঘেরা এক স্নিগ্ধ ভূমি। ভারতের এ রাজ্যটি নৃতাত্ত্বিক মণিপুরী জাতির আবাসস্থল। নানান বৈচিত্রে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য মণিপুর পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ভারতের অর্থনীতিতেও এ রাজ্যটির রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। আর এই মণিপুরের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নাম ‘ইমা কেইথাল’। ইমা কেইথাল এর অর্থ ‘মা বাজার’। মা বাজার’র বিশেষত্ব হলো, এখানকার সমস্ত বিক্রেতা নারী। অন্তত ৫০০ বছর আগে, অর্থাৎ ষোড়শ শতকে মণিপুরের রাজধানী ইম্পলে যাত্রা শুরু হয় এ বাজার। কারো কারো মতে, এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো বাজার এটি। নারী-সর্বস্ব এই বাজারে নারীরাই ধমনী, শিরা-উপশিরা একথায় চালিকাশক্তি। পুরুষেরা শুধুই ক্রেতা।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা সময়ে উপনিবেশিক শক্তি ধেয়ে এসেছে ভারতবর্ষে। এসেছে সরল জীবনের নিসর্গ মণিপুরের দিকেও। আর ভূখণ্ড রক্ষার জন্য মণিপুরের বেছে নিতে হতো যুদ্ধের পথ। যার ফলে পুরুষদের প্রায়ই থাকতে হতো যুদ্ধে। ঐতিহাসিকদের ধারণা, সেরকম এক সময়ে পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতি চালু রাখতে মণিপুরের নারীরা এই বাজারের জন্ম দিয়েছেন। আর দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শত শত বছর ধরে।
ঐতিহ্যের দিক থেকে মণিপুর নারী প্রধান। সে সমাজে নারীরা সব সময়ই এগিয়ে থাকে। সামাজিক সবধরণের বিপর্জয়ের বিরুদ্ধে তাদের দাঁড়াতে দেখা যায়। হোক তা মদ-মাদকের বিরুদ্ধে, হোক তা আফসপা’র বিরুদ্ধে, কিংবা রাষ্ট্রীয় কোন সিদ্ধান্ত। এই বাজার নিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠেছিলেন এই নারীরা। ১৯৩৯ সালে নুপি লান-এর বা নারীদের যুদ্ধের সময় এই বাজারের নারীরা সভা করে দাবি পেশ করেছিল। আন্দোলন রুখতে ব্রিটিশরা বাজারের বিল্ডিং বিক্রি করে দিতে উদ্যত হয়। নারীরা তাও রুখে দেয়। ২০০৩ সালে ভারত সরকার এই বাজার ভেঙে সুপার মার্কেট করার সিদ্ধান্ত নেয়। মণিপুরী নারীরা তাও প্রতিরোধ করে। ২০১৬ সালে ভুমিকম্পে বাজার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বছর দুয়েক বেচাকেনার গতি বেশ কম থাকলেও এখন আবার তা পূর্বের গতিতে চলছে।
ইমা কেইথাল বা মা বাজার মণিপুরের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। এখানে দোকানের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। এবং প্রতিটি দোকানের বার্ষিক আয় গড়ে ৭৩ হাজার রুপি। এই বাজারের বার্ষিক টার্ন ওভার ৪০-৫০ কোটি রুপি। এই বাজারে শুধু বিবাহিতরাই দোকান নিতে পারেন। প্রতি মাসে যৎসামান্য টাকা দিয়ে ব্যবসা করতে পারেন তারা। প্রতিদিন খুব ভোরেই ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও শাল গায়ে বাজারে হাজির হন নারীরা। এবং সারাদিন বেচা-কেনা করে সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফিরে যান। নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, যেমন চাল ডাল, মাছ-মাংস, শাক-সবজি ছাড়াও এখানে পাওয়া যায় বাঁশ বা ধাতুর তৈরি নানান হস্তশিল্প সামগ্রী, শুটকি, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, দোপাট্টা, চাদর, আদিবাসী সংস্কৃতির শেকড়-বাকড়, ঔষধপত্র ইত্যাদি। পাওয়া যায় অলঙ্কার সামগ্রীও।
এই বাজারকে মণিপুরের অর্জন বলা যেতে পারে। এত বছর আগে গড়ে ওঠা এই বাজারকে তার ধরে রেখেছে স্বমহিমায়। রাজ্যটিতে বিভিন্ন সময়ে যখন জরুরি অবস্থা বা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ জারি করা হতো। এই বাজার বার্তাবাহকের ভূমিকা পালন করতো। এবং জন্ম দিতো রাজনৈতিক প্রতিরোধের। বিগত সময়ে এই ‘ইমা কেইথল’ এর ব্যবসায়ী সমিতি ঐতিহাসিক সকল প্রতিরোধ সংগ্রামে ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংহতি জানিয়েছে। স্থানীয় মৈতি, মুসলমান এবং অন্যান্য সকল পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কোন ধরণের দ্বন্দ্ব বা সাম্প্রদায়িক কোন্দল ছাড়াই এক সাথে বাণিজ্য করে যাচ্ছে।