বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী আবদুল কাদির খান। প্রথম কোন মুসলিম দেশ হিসাবে পাকিস্তানকে পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ করার কৃতিত্ব তার। এজন্য তাকে বলা হয়, পাকিস্তানের জাতীয় বীর বা নায়ক। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের চোখে তিনি একজন বিপদজ্জনক মানুষ বা ভিলেন। তাদের অভিযোগ, কাদির খান দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রগুলোকে পরমাণু প্রযুক্তির তথ্য দিয়ে সহায়তা করছেন।
পাকিস্তানে পারমাণবিক বোমার জনক হিসাবে সবার কাছে তিনি অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। তিনি পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত করার মধ্য দিয়ে, সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এক ‘দুর্ভেদ্য’ অবস্থানে নিয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু যখন তার বিরুদ্ধে ইরান, লিবিয়া এবং উত্তর কোরিয়ায় অবৈধভাবে পরমাণু অস্ত্রের তথ্য পাচারের অভিযোগ উঠল তখন তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন।
এই জের ধরে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীতে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।
গৃহবন্দীতে থাকা অবস্থায় ২০০৬ সালে কাদির খানের মূত্রথলিতে ক্যান্সার ধরা পড়ে, তবে সার্জারির মাধ্যমে তিনি ক্যান্সার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালতের দেয়া এক রায়ের মাধ্যমে কাদির খানের গৃহবন্দীত্ব শিথিল হয়, কাদির খানকে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়ার সুযোগ প্রদান করা হয়৷ এছাড়া তিনি গণমাধ্যমে বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার দেওয়ারও সুযোগ পান। তবে তার চলাফেরার উপরে তীক্ষ্ণ নজরদারি অব্যহত থাকে, কোথাও যেতে চাইলে আগে কতৃপক্ষকে জানাতে হয়, এমনকি ইসলামাবাদের মধ্যে কোথাও যেতে হলেও অনুমতি নিয়ে যেতে হয়। তার সাথে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাবাহিনীর লোক নিয়োজিত থাকে।
কাদির খান ১৯৩৬ সালের ১ এপ্রিল ভারতের ভূপালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তার পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে।
১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানের উপরে তিনি ডিগ্রী নেন। তারপর বার্লিনে চলে যান ধাতব প্রকৌশল বিদ্যার উপরে পড়াশোনা করার জন্য। এরপর উচ্চতর জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামে গমন করেন।
৮১ বছর বয়সী কাদির খানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পাকিস্তানকে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারা; তিনি পাকিস্তানের জন্য পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হন।
নেদারল্যান্ডসের ‘অ্যাংলো-ডাচ-জার্মান পারমাণবিক প্রকৌশল কনভেনশন ইউরেঞ্জো’তে কাজ করার সময় তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ ওঠে। ১৯৭৬ সালে তিনি পাকিস্তান ফিরে আসেন।
দেশে ফেরার পর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে পাকিস্তানের জাতীয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ করেন।
১৯৭৮ সালে তিনি এবং তার দল পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং ১৯৮৪ সালে তারা প্রথমবারের মত পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে সক্ষম হন, পরবর্তীতে এক সংবাদপত্রে দেয়া সাক্ষাৎকারে কাদির খান এ তথ্য জানান।
১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য পাকিস্তানের উপরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং দেশটিতে অর্থনৈতিক ধস নামে।
২০০১ সালে যখন পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় আসেন তখন তার জন্য দুঃসময় শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে পারভেজ মোশাররফ সরকার তাকে ‘কাহুতা রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ’ এর চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যহতি দিয়ে বিশেষ উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করেন।
পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনার এই জনকের বিরুদ্ধে কখনো কারো কোন অভিযোগ ছিল না। সমস্যাটি শুরু হয় যখন জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থার পক্ষ থেকে ইসলামাবাদের প্রতি একটি চিঠি আসে; সেখানে অভিযোগ করা হয়, পাকিস্তানের এই পরমাণু বিজ্ঞানী পারমাণবিক প্রযুক্তির তথ্য পাচারের কাজে যুক্ত।
১৯৯০ সালে ‘পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অফ ন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স’-এ দেয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি উন্নয়নের সময় তিনি বিশ্ব বাজারের সহায়তা নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সকল উপকরণ শুধুমাত্র দেশের মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়”।
আমি আমার দেশকে রক্ষা করেছি
কাদির খান অভিযোগ স্বীকার করে নিলে পারভেজ মোশাররফ সরকার তাকে ক্ষমা করে দেন এবং কাদির খানও তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেন।
২০০৮ সালে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় কাদির খান বার্তা সংস্থা এএফপি কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যখন আমি পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তিধর জাতিতে পরিণত করি, তখন আমি প্রথমবারের মত দেশকে রক্ষা করেছি এবং দায় স্বীকার করার মধ্য দিয়ে আমি দ্বিতীয়বারের মত দেশকে রক্ষা করেছি, আমি সকল অভিযোগ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছি”।
তবে এই পরমাণু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্বে প্রতিরক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
১৯৯৮ সালে আণবিক অস্ত্র পরীক্ষার সময়ে ভারতের সমালোচনার জবাবে কাদির খান বলেন, “আমরা কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইনি, আমরা আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে এটা করতে বাধ্য হয়েছি”।
ছয় বছর আগে কাদির খান রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ‘তেহরিক-ই-তাহাফুক পাকিস্তান (টিটিপি) বা ‘পাকিস্তান রক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি দলও প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১২ সালের জুলাইতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি জয় লাভের আশায় আংশগ্রহনও করেন। কিন্তু ১১১ আসনে প্রার্থী দিয়েও কোন আসন না পাওয়ায় তার স্বপ্নভঙ্গ হয় এবং দল বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
কাদির খান ছয় বছর আগে আরও একটি বিতর্কে জড়িয়ে পরেন, উর্দু দৈনিক জং এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি দুটি দেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নির্দেশে পারমাণবিক প্রযুক্তির তথ্য পাচার করেছিলেন।
খান সেখানে কোন দুটি দেশ তা উল্লেখ করেন নি এবং বেনজির ভুট্টো বেঁচে থাকা অবস্থায় তিনি কখনো এ কথা বলেন নি, ফলে এতে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ২০০৭ সালে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেনজির ভুট্টো নিহত হন।
তিনি উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “আমি স্বাধীন ছিলাম না বরং প্রধানমন্ত্রীর আদেশ মান্য করতে বাধ্য ছিলাম”। অবশ্য বেনজির ভুট্টোর দল ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’ তার এই দাবীকে “বানোয়াট ও ভিত্তিহীন” বলে অস্বীকার করেছে।
তবে এত বছর পরেও, কোন বিতর্কই খানের জনপ্রিয়তায় ধস নামাতে পারেনি। তিনি নিয়মিত বিখ্যাত উর্দু পত্রিকা জং-এ লেখালিখি করে যাচ্ছেন। বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব সবার কাছে তুলে ধরছেন। তিনি বলেন, আমি জানি পাকিস্তান শিক্ষা ক্ষেত্রে খুব একটা ভালো করছে না, তাই আমি এখন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করতে চাই৷
পাকিস্তানে তার নামে বহু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট এবং দাতব্য সংস্থার নামকরন করা হয়েছে। তার চিত্র খোদাই করে বহু স্টেশনারী দ্রব্য, গানের ভিডিও ও ওয়েবসাইট তৈরি করা হচ্ছে।