পুরো বিশ্বকে শোকের প্লাবনে ভাসিয়ে বিদায় নিল আর্জেন্টিনা

পুরো বিশ্বকে শোকের প্লাবনে ভাসিয়ে বিদায় নিল আর্জেন্টিনা

ফ্রান্স              ৪-৩       আর্জেন্টিনা
গ্রিজম্যান ১৩’              ডি মারিয়া ৪১’
পাভার্দ ৫৭’                   মার্কাদো ৪৮’
এমবাপ্পে ৬৪’,৬৮’         আগুয়েরো ৯০+৩’

মূল সময় শেষ হবার পরেও পার হয়ে গিয়েছে দুই মিনিট। নিশ্চিত জয়ের পথে ফ্রান্স। কিন্তু প্রতিপক্ষ শিবিরে যখন লিও মেসি থাকেন তখন দু মিনিট আগেই বোধয় এতটা নিশ্চিত হওয়া ঠিক না। ৯৩ মিনিটে লিটল ম্যাজিশিয়ানের দুর্দান্ত ক্রস জটলার মাঝ থেকে খুঁজে নিল আগুয়েরোর মাথা; নড়েচড়ে বসলো সকলেই। কিন্তু না, অসম্ভবকে আর সম্ভব করা হল না মেসির পক্ষে। দুর্দান্ত এমবাপ্পের জোড়া আর পাভার্দ-গ্রিজম্যানের একটি করে গোলের ওপর ভর করে ৪-৩ ব্যবধানে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কোয়ার্টার নিশ্চিত করল ‘৯৮ এর চ্যাম্পিয়নরা।

সম্পুর্ণ বিপরীত ঘরানার ফুটবলে অভ্যস্ত বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম দুই পরাশক্তির জমজাট লড়াই দেখার প্রত্যাশায় যারা নব্বই মিনিট চোখ রেখেছিলেন কাজানে, কাউকেই নিরাশ করেনি দু দল। চমৎকার লড়াই শেষে যে বেহতার দলটিই জিতেছে সেটি বলাই যায়। এ ম্যাচ দিয়েই বোধয় শেষবারের মত বিশ্বকাপ মাতাতে দেখা গেল পাঁচবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী লিওনেল মেসিকে।

ম্যাচ শেষে নিশ্চিতভাবেই কাঠগড়ায় উঠবে আর্জেন্টিনার রক্ষণ। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ২-১ গোলে লিড পাবার পরেও যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তিনটি গোল ওতামেন্দিরা হজম করেছে সেটি অবিশ্বাস্য। বিশেষ করে সমতা সূচক গোলটি দেবার পর আর্জেন্টাইন রক্ষণকে নিয়ে যেভাবে ছেলেখেলা করলেন গ্রিজম্যান-এমবাপ্পেরা সেটি দেখার পর এ খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপের মত আসরে খেলার যোগ্যতা রাখে কি না এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন কোচ সাম্পাওলিও। গতম্যাচের নায়ক রোহোকে প্রথমার্ধ শেষেই কেন তুলে নিলেন সে প্রশ্নটির জওয়াব তিনিই ভাল দিতে পারবেন।

সাম্পাওলি যখন কাঠগড়ায় তখন ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশম সপ্তম স্বর্গে। ২-১ এ পিছিয়ে পড়ার পরেও যেভাবে তার দল খেলায় ফিরে এসেছে নিশ্চিতভাবেই সেটি গর্বিত করবে ‘৯৮ এর বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে। একই সাথে সময়মত গ্রিজম্যানের জ্বলে ওঠাটাও দিশমের জন্য আশির্বাদ। রক্ষণে তিনটি গোল হজম করার বিষয়টি অবশ্য ভাববার মতো।

খেলার মাত্র ১৩ মিনিটের মাথায়ই এগিয়ে যায় ফ্রান্স। এমবাপ্পের গতিতে পরাস্ত হয়ে রোহো ডি বক্সের ভেতরে তাকে ফেলে দিলে ফ্রান্সের পক্ষে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। ঠান্ডা মাথায় আরমানিকে পরাস্ত করে ফ্রান্সকে লিড এনে দেন গ্রিজম্যান। তার আগেই একটি গোল পেতে পারতেন এই অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ তারকা; যদি না তার নেয়া দুর্দান্ত ফ্রি কিক ক্রসবারে লেগে ফিরে আসত। গোলের মিনিটখানেক পরে আবারো সুযোগ পেয়েছিল ফ্রান্স। আবারো এমবাপ্পেকে বিপদজনক জায়গায় ফাউল করলে ফ্রি কিকের নির্দেশ দেন রেফারি। সুবিধাজনক জায়গায় ফ্রি কিকটি পেলেও সেটি কাজে লাগাতে পারেননি পগবা।

শুরুর এই ঝড় দ্রুতই সামলে নেয় আর্জেন্টিনা। নিজেদের পায়ে বল রেখে খেলা গুছিয়ে নেন মেসি-মারিয়ারা। কিন্তু ফ্রান্সের রক্ষণ ভাঙার মত কোনো পরিষ্কার সুযোগ কোনোভাবেই তৈরি করা যাচ্ছিল না। উপায় না দেখে প্রথমার্ধ শেষ হবার মিনিট চারেক আগে প্রায় ৩৫ গজ দুর থেকে দুর্দান্ত একটি শ্যুট নেন ডি মারিয়া। ফ্রান্স অধিনায়ক হুগো লরিসকে হতভম্ভ করে তার সে শ্যুট জালে আশ্রয় নিতেই উল্লাসে ফেটে পরে আর্জেন্টাইন সমর্থকরা।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই আর্জেন্টিনাকে উল্লাসে ভাসান মার্কেদো। তবে এটি তার কৃতিত্বের চেয়ে মেসির কৃতিত্বই বেশি। জটলা থেকে নেয়া মেসির শ্যুট থেকে সড়ে যাবার চেষ্টাই করছিলেন মার্কাদো; সেটি তিনি ব্যর্থ হলে শাপেবর হয় আর্জেন্টিনার। ডিফ্লেক্সনে দ্বিধাগ্রস্থ হুগো লরিস অসহায় চোখে চেয়ে দেখেন বল জালে জড়ানোর দৃশ্যটি । ২-১ গোলে এগিয়ে আর্জেন্টিনা।

৫৭-৬৮ এ সময়টুকুতে যেন সুনামি বয়ে গেল আর্জেন্টিনার উপর। খেলায় ফিরতে মরিয়া ফ্রান্সকে চোখ ধাধানো এক ভলিতে সমতায় ফেরান পাভার্দ। ফ্রান্সের জার্সি গায়ে এটাই এই ডিফেন্ডারের প্রথম গোল। প্রথম গোলটিই হলো ছবির মত সুন্দর আর বিশ্বকাপের মত মঞ্চে। এর বেশি আর কিই বা চাইতে পারতেন তিনি?

এরপরেই এমবাপ্পে শো। পায়ের কাজে আর্জেন্টাইন রক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে করলেন নিজের প্রথম গোলটি। আরমানি হাত লাগালেও তা যথেষ্ট ছিল না বলটিকে থামাবার জন্য। ৪৮ মিনিট শেষে ২-১ এ পিছিয়ে থাকা ফ্রান্স ৬৪ মিনিটেই এগিয়ে ৩-১ গোলে। ৬৮ মিনিটে আবারো দৃশ্যপটে এমবাপ্পে। গ্রিজম্যান থেকে পগবা, পগবা থেকে জিরুড, জিরুড থেকে এমবাপ্পে; গোল। চলন্ত বলে দুর্দান্ত প্লেসিংয়ে যেভাবে বলটিকে জালে জড়ালেন তিনি তাতেই বোঝা গেল বয়স বিশ হবার আগেই কেন তাকে পেতে উদগ্রীব ছিল বিশ্বের বড় সব ক্লাবগুলো। পেলের পর এমবাপ্পেই প্রথম টিনএজার হিসাবে নক আউটে করলেন জোড়া গোল।

এমবাপ্পের দ্বিতীয় গোলের দু’ মিনিট আগেই আগুয়েরোকে মাঠে নামান সাম্পাওলি; ৭৫ মিনিটে নামান মেজাকে। এ ম্যাচেও দেখা যায়নি ডিবালাকে। আর্জেন্টাইন কোচের খেয়ালের নির্মম পরিণতিই যেন দেখাচ্ছিল স্কোরবোর্ড। দুই গোলে পিছিয়ে পড়ার পর আর্জেন্টিনাকেও দেখায় হতদম্য। শুধু একজনই বোধয় পরাজয় কবুলে নারাজ ছিলেন; তিনি লিওনেল মেসি। আর সে জন্যই তৃতীয় গোলটির দেখা পায় আর্জেন্টিনা।

সন্দেহ নেই এ পরাজয়টি আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বুকে শেলের মত বিঁধেছে। কিন্তু সন্দেহ নেই ফ্রান্সই ছিল যোগ্য দল। গতি, ফিনিশিং প্রয়োজনীয় সব জায়গাতেই আর্জেন্টিনাকে পেছনে ফেলেছেন দেশম শিষ্যরা। বিশেষ করে এমবাপ্পে যেমন খেললেন, সে ধারাবাহিকতা যদি তিনি ধরে রাখতে পারেন তাহলে তার ওপর ভর করে বড় স্বপ্ন দেখতেই পারেন দেশম।

ম্যাচসেরা : কিলিয়ান এমবাপ্পে (ফ্রান্স)