জার্মানির হারের যত কারণ

জার্মানির হারের যত কারণ

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে চ্যাম্পিয়ন টিমের বাদ পড়ে যাওয়াটা যেমন নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ৯৮ এর চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স বাদ পড়ে ২০০২ এর গ্রুপ পর্বে, ২০০৬ এর চ্যাম্পিয়ন ইতালি বাদ পড়ে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে, ১০ এর চ্যাম্পিয়ন স্পেনও গ্রুপ পর্বেই বিদায় নেয় ব্রাজিল বিশ্বকাপে। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ১৪ এর চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২-০ গোলে হেরে বাদ পড়া নি:সন্দেহে জার্মানির বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে করুণ অধ্যায়। কিন্তু চারবারের বিশ্বকাপজয়ী জার্মানির বিশ্বসেরা দলের এমন বিপর্যয়ের কারণ কী?

জার্মান বস জোয়াকিম লো বরাবরই তার দলকে এমন কিছু হওয়া থেকে সতর্ক করেছেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগে তিনি বলেন, “বিশ্বকাপ জয়ের পর, আমাদের নিজেদের আবারও আবিষ্কার করতে হবে। ২০১০ সালে স্পেন চ্যাম্পিয়ন দল ছিল, কিন্ত একই দল নিয়ে ১৪ বিশ্বকাপে হোঁচট খেয়েছে। তাদের সেরা খেলোয়াড়গুলো ছিল, কিন্ত দলে পরিবর্তন ছিল না। সব সময়ই পরিবর্তনের দরকার হয়।”

কিন্ত জোয়াকিম লো দলে যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল সেটা ফলপ্রসু তো হয়ই নাই, ফলাফল হয়েছে যতটা খারাপ হওয়া সম্ভব ততটাই। এমন বিপর্যয় লো নিজে হয়ত কখনো স্বপ্নেও ভাবেন নাই। তাই আমরা জার্মানির বিপর্যয়ের পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছি।

স্লথ গতির দূর্বল ডিফেন্স

জেরোম বোয়েটাং এবং মেট হুমেলস এর স্লথ গতিকে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করেছিল মেক্সিকো। মেক্সিকোর একের পর এক কাউন্টার অ্যাটাক যেন জানান দিচ্ছিল এই ডিফেন্স নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যাবে না। হলও তাই, চ্যাম্পিয়ন তো ভালো গ্রুপ পর্বই পার হওয়া গেল না। বিপক্ষ দলের প্রতিটি আক্রমণে জার্মানির দুই সেন্টার ব্যাকের দুর্বলতা নজরে এসেছে। গ্রুপ পর্বের এই তিন খেলায় জার্মানির গোলে বিপক্ষ দল শট নিয়েছে ১৪ বার। এ বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র মিশর (১৬ বার) এবং কোরিয়াই (১৪ বার) নিজেদের গোলে এর চেয়ে বেশি শট নেয়ার সুযোগ দিয়েছে।

নো সানে, নো পার্টি

পিএফএ এর বর্ষসেরা উদীয়মান তরুণ খেলোয়াড়কে দল থেকে বাদ দেওয়াটা একটা আশ্চর্যই ছিল। লিরয় সানের বলের ওপর দক্ষতা ও খেলার বৈচিত্রের অভাব এবার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে জার্মানদের মধ্যে। লিরয় সানে একাধারে একজন উইঙ্গার, প্লে মেকার এবং ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলতে পারে। তাছাড়া প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ছিড়ে ড্রিবলিং করার তার যে দক্ষতা সেটা এবারের জার্মান দলের কারো মধ্যেই দেখা যায়নি।

নেই কোন পাকা স্ট্রাইকার

বাছাইপর্বে লো এর দল ৪৩ গোল করে নতুন রেকর্ড গড়ে এবার। কিন্তু ৪৩ গোলের পেছনে ছিল ২১ জন ভিন্ন খেলোয়াড়। শুধুমাত্র থমাস মুলার এবং সান্দ্রো ভাগনার ৫ টা করে গোল করে। বিশ্বকাপের মূল পর্বেও দেখা গেছে একজন গতানুগতিক গোল-স্কোরিং স্ট্রাইকারের অভাব। বিশ্বকাপে করা মাত্র দুই গোলের মধ্যে একটা আসে ক্রুসের পা থেকে, আরেকটা করে মার্কো রয়েস।

কাণ্ডারি শুধুমাত্র ক্রুস

মাঝ মাঠে ক্রুসের সাথে সেমি খেদিরা থাকলেও খেদিরা ব্যর্থ হওয়ায় সব দায়িত্ব এসে পড়ে ক্রুসের কাঁধে। দুই ডিফেন্ডার ও তিন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে যায় ক্রুস। বোয়েটাং বা হুমেলস এর পাস আসে ক্রুসের পায়ে, আর আক্রমণভাগে ওজিল, মুলার, ড্রাক্সলার’রা ক্রুসের থেকে পাসের অপেক্ষা করতে থাকে। মাঝ মাঠের মাত্র একজন কান্ডারি থাকায় সেটা খুব সহজেই প্রতিপক্ষের নজরে আসে। এবং ক্রুসকে আটকে দেয়া সহজ হয়ে যায়।

লো’র একগুয়েমি, টের স্টেগেন বেঞ্চে

নয়্যারের যোগ্যতা নিয়ে কখনোই কোন প্রশ্ন ছিল না। এমনকি তাদের বিদায়ের পেছনেও হয়ত নয়্যারের দোষ নাই। কিন্তু ইঞ্জুরির কারণে প্রায় পুরো সিজনেই মাঠের বাইরে ছিলেন নয়্যার। বাছাই পর্বেও মাত্র ৩ খেলায় ছিলেন। অন্যদিকে বার্সার হয়ে পুরো সিজনে দর্শনীয় ফর্ম ছিল টের স্টেগেনের। কিন্তু একগুঁয়ে লো, নয়্যার-কেই বেছে নেয় টের স্টেগেনের জায়গায়।

কিমিচের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা

বাছাই পর্বে ৯টি এসিস্ট দিয়ে জার্মানদের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন বায়ার্ন রাইট ব্যাক জসুয়া কিমিচ। যখনই উদ্ধারের প্রয়োজন হয়েছে রাইট ফ্ল্যাংক থেকে ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভাব হয়েছেন কিমিচ। তাই ফিলিপ লামের উত্তরসূরির ওপর প্রতিপক্ষের বাড়তি নজর ছিল বিশ্বকাপে। আর মূল পর্বে এসে তাই নিজেকে ফুটিতে তুলতে ব্যর্থ হয় জসুয়া কিমিচ এবং রাইট ফ্ল্যাংকে একজনের নির্ভরতার ফল পোহাতে হয়েছে জার্মানদের। আর আক্রমণের একমাত্র হাতিয়ারকে আটকে দেয়ার ফলই হচ্ছে তিন ম্যাচ খেলে জার্মানের দুই গোল মাত্র।

কোথায় ওজিল, কোথায় মুলার

মুলার আর ওজিলকে নিয়ে আসা হয়েছিল আক্রমণে শাণ দেওয়ার জন্যে। মুলার বিশ্বকাপ শুরু করে আগের দুইবারের ১০ গোল নিয়ে। এবার হয়তো নিজেও ভেবেছিল ক্লোসার ১৬ গোলের রেকর্ডটা ভেঙেই ফেলবেন। কিন্ত দলের জন্যে কোন অবদানই রাখতে পারলেন না তিনি। তাছাড়া তার ওপর বিশ্বাস এতটাই কম ছিল যে, এই প্রথম বিশ্বকাপের কোন খেলায় সাবস্টিটিউট হিসেবে রাখা হয়েছে মুলারকে।

অন্যদিকে ওযিল যেন ‘আর্সেনালের ওজিল’ হয়েই বিশ্বকাপে আসল। ওজিলের ধারাবাহিকতা এতটাই কমে গেছে যে এখন আর দলে তার অন্তর্ভুক্তি খেলায় কোন পার্থক্য করে না। তাইতো মেক্সিকোর সাথে হেরে পরের ম্যাচেই তাকে রাখা হয় বেঞ্চে। ধরে নেয়া হচ্ছে ওজিল হয়ত জার্মানির হয়ে তার শেষ ম্যাচটি খেলে ফেলেছেন। মারিও বাসলার তো বলেই ফেললেন, ‘খেলার ময়দানে ওজিলের শরীরী ভাষা একটা মরা ব্যাঙের মতো’।

ছিল না জার্মানদের তেজ

জার্মানি বিশ্বকাপে ভাল দল নিয়ে আসলেও সারা বছর খেলে কেউই পুরোপুরি ফিট ছিলেন না। যদিও বলা যায় কোন জাতীয় দলই ১০০ ভাগ ম্যাচ ফিট হয়ে রাশিয়া আসেনি। কিন্তু বিশ্বাকপের আগে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতেও তাদের খেলার তেজ দেখা যায়নি। অষ্ট্রিয়ার সাথে হার এবং সৌদি আরবের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর জয় থেকেই সেটা টের পাওয়া গিয়েছিল।

জোয়াকিম লো দলে অনেক পরিবর্তন এনেও দল গোছাতে পারেননি। প্রথম ম্যাচ পরেই ওজিলকে বেঞ্চে বসানো, পরের ম্যাচে মুলার ও খেদিরাকে। হয়তো কোচেরও কিছু ভুলের জন্যে খেসারত দিতে হয়েছে তাদের। এবং এর মধ্য দিয়েই ফুটবল হয়তো এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটনের সাক্ষী হল।